মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য তরুণ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজন। তাঁরা বলেছেন, সংস্কৃতি চর্চা দেশকে কখনও পথ হারাতে দেয় না। কারণ, এই সংস্কৃতির মধ্যেই বাঙালির আত্মপরিচয় নিহিত। অনেক কিছু চর্চার অভাবে হারিয়ে গেছে। সেই হারানো সংস্কৃতি ফিরে পেলে আমরা শিকড়ের কাছে ফিরে যেতে পারব।

বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় বিশিষ্টজন এসব কথা বলেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সংগঠনটি 'উগ্র মৌলবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক তামসিকতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদীপ্ত ধর্মনিরপেক্ষ মানবিকতার সংস্কৃতির বিকাশ ঘটুক' শীর্ষক এই আলোচনা সভার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন নরওয়ের লোকসংগীত গবেষক, লেখক ও আলোকচিত্রশিল্পী ওয়েরা সেথের।

সভায় আরও বক্তব্য দেন ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের সাম্মানিক সভাপতি নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, ১৯৭১ :গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ ও ফরিদা পারভীন ফাউন্ডেশনের সভাপতি সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রজন্ম ৭১ এর সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর তন্ময়।

প্রধান অতিথির বক্তৃতায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, '১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আমরা দেখেছি রাজাকারদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। এর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় এবং নির্মূল কমিটির সহযোগিতায় রাজাকারদের বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখনও সেই বিচারকাজ চলছে। রাজাকারদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা হবে।'

সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ বলেন, 'সংস্কৃতি ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে আমরা যাত্রাপালা ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছি। আমার একটি প্রস্তাব থাকবে- সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চকে যাত্রামঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য।'

নরওয়ের লোকসংগীত গবেষক ওয়েরা সেথের বলেন, 'এই বাঙালি সংগীত ও সংস্কৃতি যদি না থাকত, এই সাংস্কৃতিক চেতনা যদি মনের গভীরে না থাকত, তবে এই বাংলাদেশ হতো না। এই দেশের ভাষা আমি জানতাম না।'

নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, 'আমাদের বাঙালির আত্মাটা আছে লোকসংস্কৃতির মধ্যে- এটা আমরা ভুলে যাই। আমরা অবকাঠামোগতভাবে অনেক উন্নতি করেছি, কিন্তু আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি। আমরা এই সরকারকে সংস্কৃতিবান্ধব সরকার বলি, কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বরাদ্দ তলানিতে পড়ে আছে আজও।'

নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, '১৯৭১ সালে আমাদের একটি সাংস্কৃতিক স্কোয়াড ছিল, যেখানে শাহরিয়ার কবিরের লেখা 'রূপান্তরের গান' ভারতের বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো, যা মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। আজও বাংলাদেশের এই দুঃসময়ে শাহরিয়ার কবিরের নেতৃত্বে নির্মূল কমিটিই নতুনভাবে পথ চলতে শুরু করা 'জাগরণ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড' এরও নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যা খুবই আশাব্যঞ্জক।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, 'সংস্কৃতি মানুষকে উজ্জীবিত করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংস্কৃতির ভূমিকা অনেক। বর্তমান সময়ে সরকার ওয়াজে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য তেমন ব্যয় করে না। ধর্মের সঙ্গে আমাদের বিরোধ নেই। সারাদেশে ৬৪টি জেলায় যেভাবে মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে, সেভাবে ৬৪টি জেলায় মডেল সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যেন নির্মাণ করা হয়- সরকারের কাছে আমাদের এই প্রস্তাব থাকবে।'