আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। আমরা একটি নিজের দেশ পেয়েছি, রাষ্ট্র পেয়েছি। এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য অর্জন, এমন নয়। আমি মনে করি গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে এটা গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এ দেশের মানুষ নিজেরা যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। ভারত-পাকিস্তান যখন সৃষ্টি হলো, যখন ব্রিটিশ কলোনি অন্যান্য দেশেও ছিল, তখন আলোচনার ভিত্তিতে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আন্দোলন হয়েছে, সংগ্রাম হয়েছে; কিন্তু পরবর্তী সময়ে নেতারা বসে চুক্তির মাধ্যমে তা ঠিক করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এ দেশের সব মানুষ যে যার অবস্থান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং যুদ্ধ করেছে। 

গোটা দেশের ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠন সবাই এক হয়ে গেছে। একই দাবি, একই আন্দোলন করায় ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুবের পতন হলো, ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এলেন। ইয়াহিয়া খান তার প্রতিশ্রুতি রাখলেন না। এর পর পূর্ব পাকিস্তানের সবাই স্বাধিকার আন্দোলনের ব্যাপারে আরও সচেতন হলো।

গোটা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে তাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা ইয়াহিয়া খান মানতে চাইলেন না। ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করেছেন। কিন্তু পাকিস্তানিরা চায়নি বাঙালিরা রাজত্ব করুক। যখন মার্চের প্রথম দিকেই ছাত্ররা বুঝল ওরা ক্ষমতা দেবে না, তখন তারা আন্দোলনে নেমে গেল। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলো। ট্যাক্স দেব না, পাকিস্তানি পণ্য বর্জন করব, পাকিস্তানে আমাদের টাকা যেন না যায়, পাকিস্তানিদের ব্যবসা-বাণিজ্য কোনো কিছুতে অংশগ্রহণ করা হবে না, সব কলকারখানা বন্ধ, সবকিছু অচল থাকবে ইত্যাদি ছিল দাবি। পুরো দেশ অচল হয়ে গেল। পাকিস্তানিদের সঙ্গে একত্রে নয়, বাংলাদেশেই পণ্য বানাতে শুরু করল। সবাই আমরা তাঁতের কাপড় কিনতে শুরু করলাম। আমি মনে করি, সেখান থেকেই সারাদেশের সব মানুষ যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মানুষ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সংগঠিত হলো। পাকিস্তানিরা দমননীতি শুরু করে। তারা মনে করে গুলিতে স্তব্ধ করে দেবে বাঙালিদের। আমি নিজে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সাক্ষী। রাস্তাঘাট, কমলাপুর রেলস্টেশন, সদরঘাটের লঞ্চঘাটসহ যেখানে-সেখানে সাধারণ মানুষ ঘুমিয়ে ছিল। সবাইকে নির্বিচারে পাকিস্তানিরা গুলি করে। কিছু কিছু বস্তি পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেওয়া হয়।

২৫ মার্চের পর বাঙালিরা প্রতিরোধে দুর্বার হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবস শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ঘোষণা। তার আগে থেকেই অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই গোটা জাতি এক হয়ে যুদ্ধ করেছে। সবাই তো অস্ত্রধারী যোদ্ধা ছিল না। সব গ্রামের মানুষ, নারী-পুরুষ-কিশোর– সবাই সম্মিলিতভাবে যার যার অবস্থান থেকে যুদ্ধ করেছে। ওই ৯ মাসে কোনো শ্রেণিবিভেদ ছিল না।

যুদ্ধের সময় পরিবারসহ ধানমন্ডিতে ছিলাম। আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনেছি, আকাশবানি, বিবিসি ও রেডিও মস্কো শুনেছি। কোনো জায়গায় কোনোভাবে পাকিস্তানিদের হটিয়ে দেওয়া হলে কিংবা সক্ষম কর্মসূচি নেওয়া হলে, পাকিস্তানিদের বধ করা হলে আমাদের হৃদয় ভরে উঠত।
২৬ মার্চের আগে আমাদের এলাকায় মানে ধানমন্ডিতে একই ফকির, একই রিকশাওয়ালা, একই ফেরিওয়ালা বারবার দেখতে পেতাম। ওরাই ঘুরে ফিরে এটা-সেটা বিক্রি করতে আসত। কিন্তু ২৬ মার্চের পরে অপরিচিত রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা বেড়ে যেতে লাগল। মা বলল– ওরা গুপ্তচর। বিক্রি করতে আসার ছলে বাড়িতে কোনো মুক্তিযোদ্ধা আছে কিনা তার খোঁজ নিতে আসে।

ভয়, শঙ্কা, অনিশ্চয়তা ছিল। কিন্তু আমরা ভয় পেতাম না। প্রিয় মাতৃভূমি ছিল সবার আগে। আমরা সবাই ভেবেছি, একদিন দেশ স্বাধীন হবে। কিন্তু কবে হবে জানি না। কত বছর লাগবে জানি না। তবে আমাদের সাহস ও একতা দেখে পাকিস্তানিরা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। v