
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে আয়োজিত হলো শিল্পী স্বপন কুমার সানার প্রথম একক প্রদর্শনী।
সম্প্রতি ‘যোজন বিয়োজন’ শীর্ষক এই প্রদর্শনীতে উঠে এসেছে শিল্পীর এ পর্যন্ত পথচলা।
একদা মন্ড্রিয়ান যেমন ভেবেছিলেন, শিল্পকে হটিয়ে দেবে বাস্তবতা, অর্থাৎ বাস্তবতার গুরুত্ব বেড়ে যাবে শিল্পের চেয়ে, আদতে তা হয় না। বরং শিল্প আজীবনই বাস্তবতার কোনো এক সমান্তরালে চলা পথ।
সেখানে তবে শিল্পীর কাজ কী? নানান তাত্ত্বিক, মনস্তাত্ত্বিক দিকের আলোচনার পরে দেখা গেল, এ সমস্ত আলোচনাই মিলে যায় একটি জায়গাতে। শিল্প বরাবরই শিল্পীর জীবনের বহিঃপ্রকাশ, সেখানে ফুটে ওঠে নানান অধ্যায়, এক বিস্তৃত পথ। শৈশব থেকে কৈশোর, এরপর একের পর এক বছর পাড়ি দিতে দিতে নিজেকে বারংবার দেখা। শিল্প তাই শিল্পীরই জীবন খুঁটে দেখা। এখানে জীবন আর কর্ম অভিন্ন।
তাই চিরাচরিত বাস্তবতায় শিল্প এসে যোগ করে নতুন ভাবান্তর, কিছু যোজন, কিছুটা বিয়োজন।
স্বপন কুমার সানাও নিজের শিল্পীজীবনের পথচলায় রোজকার নানান বিষয় তুলে ধরেছেন নিজের ভাবনায়। কিছু জায়গায় বাস্তবতাকে একটু হটিয়ে দিয়েছেন, আবার অতিরিক্ত গ্রাহ্যতাও আছে। তাই শিল্পীর নিজের প্রথম একক প্রদর্শনীর এই ‘যোজন বিয়োজন’ নামকরণটি সার্থক।
শিল্পকলায় ‘ছাপচিত্র’ মাধ্যমটিকে বলা যেতে পেরে ঋণাত্মক-ধনাত্মকের সম্পর্ক। এখানে উডকাট, লিথোগ্রাফ, একুয়াটিন্ট, ড্রাইপয়েন্ট প্রতিটি মাধ্যমেই যেসব পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়, সেসব ক্ষেত্রে কোনো একটি অংশকে বাদ দিলে অন্য অংশ ফুটে ওঠে।
শিল্পী স্বপন কুমার সানা এই ছাপচিত্র বিভাগেরই ছাত্র ছিলেন। গোটা ছাত্রজীবনে স্বল্পভাষী এই শিল্পী মনোযোগ আর নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেছেন ছাপচিত্রের নানান মাধ্যম নিয়ে। তবে এই প্রদর্শনীতে তাঁর ছাত্রজীবনের প্রথম দিকের কাজগুলো। যেমন– পেন্সিল স্কেচ এবং ড্রয়িং, নানান ল্যান্ডস্কেপ, ফিগার স্টাডি, পরবর্তী সময়ে জলরঙে করা কাজগুলোও আছে। গ্যালারিতে তাই ৩৬০° তে তাকালে দেখা গেছে একটি যাত্রার ছবি; যেখানে হামাগুড়ি থেকে উঠে দাঁড়ানো দেখা যায়।
প্রদর্শনীর মোট ৫০-এর অধিক শিল্পকর্মের কিউরেশন করেছেন স্বপন কুমার সানা নিজেই। দরজা দিয়ে ঢুকেই চোখে পড়ে বিশাল বিশাল চেয়ারের ছবি। ২০১৭-তে আঁকা এই ছবিগুলো মূলত শিল্পীর সবচেয়ে পরিণত সময়ের কাজ। কিংবা ‘মুক্ত’ও বলা যেতে পারে। ‘রিয়েলাইজেশন’ নামক এই সিরিজটির সব কাজ তিনি এই প্রদর্শনীতে না রাখলেও যে ক’টি রেখেছেন, তাতেই উঠে আসে সমাজের নানান গল্প। চেয়ারকে সিম্বলিক কিংবা মেটাফোরিকভাবে এঁকেছেন তিনি; যেখানে কুকুর কিংবা কোলাব্যাঙের বেশে অযোগ্যরা এসে দখলদারিত্ব করছে। ফ্যাসিবাদ এখানে পিঁপড়ের মতন কুরে কুরে কাটে চেয়ারের গদি, কোলাব্যাঙের নৃত্য এখানে রাষ্ট্রের প্রতি করা স্যাটায়ার।
‘রিয়েলাইজেশন’ সিরিজে শিল্পী আরও কিছু সাবজেক্ট নিয়ে কাজ করেছেন। সেখানে চারুকলা অনুষদের বিভিন্ন অংশ যোগ করেছেন সূক্ষ্মভাবে। যেমন– একটি বাল্বের ভেতর চারুকলার Serious Discussion ভাস্কর্যটি। এখানে বাল্বের ফিলামেন্টের জায়গায় একটি পেন্সিল ঢোকানো।
আবার, একটি বড় টেবিলের মতন সমাবর্তনের টুপির ওপর এসে পড়েছে বিশাল এক পৃথিবী। সেই ভার সইছে পিঁপড়ের মতন ছোট এক প্রাণী। আরেকটি উডকাটে করা কাজে সদ্য গ্র্যাজুয়েটেড একজন বসে আছে গিটার হাতে; চোখেমুখে নির্লিপ্ত কাঠিন্য। এসবই আমাদের রোজকার জীবন, রোজকার চাহিদা। হঠাৎ কাঁধের ওপর এসে পড়া বোঝার ভার, কিংবা নিজের পুষে রাখা ইচ্ছেটা বাঁচিয়ে রাখবার তাড়না।
‘রিয়েলাইজেশন’ সিরিজের প্রায় সব ছবিই লিথোগ্রাফিতে করা। এই মাধ্যমটিতে অনেক কেমিক্যাল ব্যবহার করে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় প্রিন্ট নিতে হয়। এই গোটা প্রক্রিয়ায় কোথাও কোনো ত্রুটি হলেও ফল আশানুরূপ হয় না। কিন্তু শিল্পী এই কঠিন মাধ্যমটিই বেছে নিয়েছেন। নিজের বিএফএ এবং এমএমএ-তেও তিনি প্রিন্ট মেকিংয়ের নানান মাধ্যমে দক্ষতার সাথে কাজ করে গেছেন। তবে এই এক্সিবিশনে তাঁর উডকাট, একুয়াটিন্ট মাধ্যমের কিছু ফিগার স্টাডি, ল্যান্ডস্কেপ রয়েছে; যেগুলোতে শিল্পীর ছোট থেকে বেড়ে ওঠার সময়কার প্রভাব দেখা যায়। সাতক্ষীরার কলারোয়ার গ্রামটি বোধহয় সবুজে ঘেরা ছিল, নদীর ধারে মহিষ দেখা যেত, হয়তো বর্ষার সময়ে সেসব মহিষের রং আর বর্ষার রং মিলে মাখামাখি হয়ে যেত। তাই শিল্পীর ‘বাফেলো’ সিরিজের জলরঙে আঁকা ছবিগুলোর ট্রিটমেন্টে সেসব রং উঠে এসেছে।
এ ছাড়া তাঁর অনুশীলনের সময়ের ছবিগুলোতে চারুকলার নানান ল্যান্ডস্কেপ, ভাস্কর্যের ছবি আছে। সেগুলোরই যোজন-বিয়োজন তিনি করেছেন পরবর্তী এক্সপেরিমেন্টাল কাজগুলোতে।
প্রদর্শনীটির দিকে হঠাৎ তাকালে মনে হতে পারে, প্রাতিষ্ঠানিক কাজের পরিমাণের তুলনায় এক্সপেরিমেন্টাল কাজগুলো বরং কম। তবে শিল্পী সম্প্রতিই তাঁর শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন। তাই নতুন চিন্তায় আরও কাজ করবার আগে হয়তো দেখতে চাচ্ছিলেন নিজের অবস্থান, খতিয়ে দেখে নিচ্ছিলেন নিজের যাত্রাটি। তাই শুরু থেকে করে আসা পেন্সিল, জলরং, উডকাটের পরে অন্যান্য মাধ্যমে করা কাজগুলোতে ব্যতিক্রমী যে পরিণয়, আরও পরিণত যে ভিজুয়াল, তা খুব স্পষ্ট চোখে পড়ে। এ ছাড়া একটি কোণে তিনি পাশাপাশি নিজের ২০১৫-এ করা ফিগার স্টাডি আর ২০২২-এ করা ফিগার স্টাডিগুলো পাশাপাশি রেখেছেন। তাই পরিবর্তনটাও দেখা যায় পাশাপাশি।
শিল্পী স্বপন কুমার সানার দক্ষতা বোঝা যায় তাঁর ‘রিয়েলাইজেশন’ সিরিজটির দিকে তাকালেই। তবে এ ধরনের কাজ আরও করতে গেলে নানান প্রতিকূলতা, পরিস্থিতি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ নিয়ে আক্ষেপও করেন তিনি। তাই আগেই উল্লেখ করলাম, এই প্রদর্শনীটি তাঁর যাত্রার হামাগুড়ি থেকে উঠে দাঁড়ানো। তবে যে দক্ষতা আর ইচ্ছে নিয়ে তিনি দাঁড়ালেন, এবার এ যাত্রায় তিনি দৌড়াবেন নাকি স্থিরভাবে এগিয়ে যাবেন, সেসব সিদ্ধান্ত শিল্পীর। আমরা বরং সামনে তাকাই তাঁর এই পথের দিকে। অপেক্ষা করি শিল্পীর আরও সব নতুন চিন্তার জন্য।
মন্তব্য করুন