- শৈলী
- জমিদার নেই আছে বাড়ি
জমিদার নেই আছে বাড়ি

কোনো এক ছুটির দিনে পরিবার ও সন্তানদের নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন ধনবাড়ী জমিদারবাড়ি থেকে। অল্প খরচ ও স্বল্প সময় ব্যয় করেই ৭০০ বছরের পুরোনো জমিদারবাড়ির ঐতিহ্য, ঐশ্বর্য ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা পাবেন। মোগল, নবাব ও ব্রিটিশ আমলের দুর্লভ সংগ্রহ দেখতে পাবেন। লিখেছেন জাকারিয়া জাহাঙ্গীর
টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ীতে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা খান বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী (১৮৬৩-১৯২৯) আনুমানিক ১৮০০ শতকে জমিদারবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এটি 'নওয়াব আলী-হাসান আলী রয়েল রিসোর্ট' নামে পরিচিত এবং সর্বসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত। স্থানীয়রা এটি নওয়াববাড়ি বা নওয়াব মঞ্জিল হিসেবে চেনেন। জমিদারবাড়িটিতে মোগল আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় ৭০০ বছরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার প্রথম প্রস্তাবক এবং অবিভক্ত বাংলায় ব্রিটিশ সরকারের প্রথম মুসলিম মন্ত্রী।
ব্রিটিশদের কাছ থেকে বাহাদুর, নওয়াব, সিআইই খেতাবপ্রাপ্ত জমিদার হিসেবে বৃহত্তর অঞ্চলের শাসনভার পরিচালনার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জমিদারবাড়ি। বাড়িটি ঘিরে সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে সেনাপতি ইস্পিঞ্জর খাঁ ও মোনোয়ার খাঁ 'ধনপতি সিংহ'কে পরাজিত করে এ এলাকায় জমিদারির সূচনা করেন। পরবর্তী সময়ে জমিদারির কর্তৃত্ব পান সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। বলা হয়ে থাকে, ১৯১৯ সালে তৎকালীন ইংরেজ লর্ড রোনাল্ডশ্যকে জমিদারি পরিদর্শনে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য নওয়াব আলী চৌধুরী বাড়িটি নির্মাণ করেন।
পরবর্তী সময়ে ৩০টি সুসজ্জিত হাতিবহরের মাধ্যমে লর্ড রোনাল্ডশ্যকে তিনি এই বাড়িতে অভ্যর্থনা জানান। নওয়াব আলী চৌধুরীর মৃত্যুর পর বাড়ির মালিকানা প্রাপ্ত হন তাঁর ছেলে সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী (যিনি পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন)। হাসান আলী চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর কন্যা সৈয়দা আশিকা আকবর বাড়িটির স্বত্বাধিকারী ছিলেন। গত বছরের ২৫ এপ্রিল আশিকা আকবর মারা যান এবং বর্তমানে তাঁর ছেলে (নওয়াব আলী চৌধুরীর প্রপৌত্র) আফিফ উদ্দিন আহমেদ এটির মালিক।
জমিদারবাড়িতে যা দেখতে পাবেন :পুরো জমিদারবাড়িটি সুপ্রশস্ত প্রাচীরে ঘেরা। পূর্বদিকে রয়েছে বড় একটি তোরণ। জমিদারবাড়িতে ঢুকেই প্রথমে বিশাল যে প্রাসাদটি দেখতে পাবেন, সেটি হলো চার গম্বুজবিশিষ্ট মোগল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি নওয়াব প্যালেস বা দরবার হল। প্রাসাদটি দক্ষিণমুখী এবং দীর্ঘ বারান্দা সংবলিত। চুন-সুরকি, চীনামাটি ও পাথরে নির্মিত এই প্রাসাদে বসেই খান বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিচারকার্য, খাজনা আদায় তথা জমিদারি পরিচালনা করতেন। প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো এই প্রাসাদের দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে সুদৃশ্য নকশা, পাথরে খচিত দুর্লভ কারুকাজ এবং জমিদারি আমলে বাঁধাইকৃত বিভিন্ন দুর্লভ সাদাকালো ছবি; যা আপনাকে এক মুহূর্তের জন্য ইতিহাসের স্বর্ণালি দিনে নিয়ে যাবে। নওয়াব প্যালেসে চাইলে আপনি রাতযাপনও করতে পারবেন। এ ছাড়া সভা-সেমিনারও করা যাবে। এ জন্য অবশ্য নির্ধারিত ফি পরিশোধ করতে হবে।
নওয়াব প্যালেস দেখে আরেকটি গেট পার হওয়ার পরই মূল জমিদারবাড়ি বা মূল প্রাসাদটি দেখতে পাবেন। এটিকে নওয়াব মঞ্জিল বলা হয়। যা খান বাহাদুরের বাসভবন ছিল। এই মঞ্জিলের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে ঐতিহ্য, ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্য। এখানেই নওয়াব আলী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা থাকতেন। পাথর, চুন-সুরকি, চীনামাটি দ্বারা নির্মিত এই প্রাসাদের সুদৃশ্য নকশা ও পাথরে কারুকাজ আপনাকে মুগ্ধ করবে। মঞ্জিলের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নিজেকে রাজপ্রাসাদের একজন ঐতিহ্যের সাক্ষী করে নিতে পারবেন। মঞ্জিলটির ভেতরে সুরক্ষিত ও সাজানো রয়েছে মোগল, নবাব ও ব্রিটিশ আমলের দুর্লভ সংগ্রহ, জমিদারি আমলের স্মৃতিচিহ্ন এবং জমিদার পরিবারের ব্যবহূত জিনিসপত্র। প্রাসাদের পাশেই তোরণসংলগ্ন ঘরে থাকতেন পাইক-পেয়াদারা। পাশেই রয়েছে বৈঠকখানা, গোমস্তা ও নায়েবদের বসতিঘর, দাস-দাসীদের চত্বর এবং ২০০ বছরের প্রাচীন টিনশেড কাচারিঘর।
পুরো বাড়িটি সুবিস্তৃত বাগানবেষ্টিত। যেন গোলাপের পাপড়ি, কামিনীর ডাল কিংবা শতবর্ষী গাছগুলোর পাতায় পাতায় জড়িয়ে আছে রাজা-রানীর রোমান্টিকতার স্মৃতিচিহ্ন। ভ্রমণপিয়াসু ও ইতিহাসপ্রেমীরা কোনো ফুলের স্পর্শে অনুভব করবেন কোনো ফুলে থাকা বংশপরম্পরায় রাজকুমারীর হাতের স্পর্শ। নওয়াব মঞ্জিলের পাশেই রয়েছে ৩০ বিঘার বিশালাকার দিঘি; যার গভীরতা সম্পর্কে কেউ বলতে পারেন না। দিঘির মনোরম শান বাঁধানো ঘাটে দাঁড়িয়ে হয়তো আপনার বিশ্বাসই হবে না- এখানে জমিদার পরিবারের সদস্যরা জলোৎসব করতেন। ইচ্ছা করলে পর্যটক এই দিঘিতে নৌকা ভ্রমণ ও মাছ শিকারও করতে পারেন। এ জন্য অবশ্য বাড়ির ম্যানেজারের অনুমতি নিতে হবে।
আরও যা দেখতে পাবেন :নওয়াব প্যালেসের মূল প্রাচীরের বাইরে ঠিক পাশেই রয়েছে ৭০০ বছরের পুরোনো মোগল আমলের মসজিদ। ধারণা করা হয়, ইস্পিঞ্জার খাঁ ও মোনোয়ার খাঁ মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মসজিদের ইমাম হাফেজ মুফতি ইদ্রিস হোসাইন জানান, শুধু চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি সুদৃশ্য তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি এত বছরেও কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। মসজিদের অভ্যন্তরে মোগল আমলের তিনটি ঝাড়বাতি শোভা পাচ্ছে। মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন এ মসজিদের মোজাইকগুলো এবং মেঝেতে মার্বেল পাথরে নিপুণ কারুকার্য অসাধারণ। মসজিদটির সামনেই দুই মিনারবিশিষ্ট দুটি কক্ষ রয়েছে। যার একটিতে নবাব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর মাজার। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে এখন পর্যন্ত এখানে ২৪ ঘণ্টা (নামাজের সময় ছাড়া) কোরআন তেলাওয়াত চলে আসছে। এ জন্য পাঁচজন হাফেজ নিযুক্ত আছেন।
মসজিদের পাশেই রয়েছে অনেক পুরোনো কবরস্থান। যেখানে খান বাহাদুরের পরিবারের লোকজন ছাড়াও জমিদারবাড়ির তিনটি হাতির কবর রয়েছে। জমিদারবাড়ির সামনে রয়েছে সরকারি ধনবাড়ী নওয়াব আলী ইনস্টিটিউশনের সুদৃশ্য ভবন এবং বিশালাকৃতির তোরণ। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুল আলিম জানান, ১৯১০ সালে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এটি স্থাপন করেন। যার মূল ভবনে ছোট-বড় ১৬টি গম্বুজ রয়েছে। অনেক ভ্রমণপিয়াসু শতবর্ষের চেয়ে বেশি পুরোনো এই ভবনের সুদৃশ্য কারুকাজ দেখতে আসেন।
ভ্রমণের টুকিটাকি
যেভাবে যাবেন
ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এখানে ভ্রমণ আরামদায়ক। দেশের যে কোনো স্থান থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি বা বাসে সহজেই ধনবাড়ী যাওয়া যায়। জমিদারবাড়িতে যেতে প্রথমে ধনবাড়ী বাসস্ট্যান্ডে নামতে হবে। সেখান থেকে পূর্বদিকে মাত্র তিন-চার মিনিট হেঁটে কিংবা রিকশায় পৌঁছা যাবে জমিদারবাড়িতে। রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা ভাড়ায় ঢাকা-ধনবাড়ী বিনিময় বাস সার্ভিস চালু রয়েছে। এ ছাড়া ধনবাড়ী হয়ে যাতায়াতকারী মহানগর, রাজীব, জয়ন্তী, শুভেচ্ছা পরিবহনসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বাসেও ধনবাড়ী যাওয়া যায়। এখানে ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিংয়ের সুব্যবস্থা আছে।
থাকা-খাওয়া
স্বল্পমূল্যে থাকার জন্য ধনবাড়ী থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার উত্তরে মধুপুর শহরে বেশ কিছু আবাসিক হোটেল আছে। ভিআইপিরা থাকতে পারবেন ধনবাড়ী সরকারি ডাকবাংলোতে। তবে জমিদারবাড়িতেই চাইলে আপনি নবাবি স্টাইলে থাকতে পারবেন। সেটি নির্ভর করবে আপনার সামর্থ্যের ওপর। নওয়াব এস্টেটের ম্যানেজার শরিফ উদ্দিন জানান, জমিদারবাড়িতে রাতযাপনের জন্য চার ধরনের আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে ২৪ ঘণ্টার জন্য নওয়াব প্যালেসে (রাজ দরবার) দুই শয্যার এক কক্ষ ৭ হাজার টাকা এবং ২০০ বছরের পুরোনো টিনশেড বাংলো, ভিলা ও কটেজ ৪ হাজার টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়। পর্যটকরা ভেতরেই খেতে চাইলে নির্ধারিত মেন্যু পছন্দ করে দাম পরিশোধ করে খাবার অর্ডার করতে পারেন। টিকিট ব্যবস্থাপক প্রদীপ রাজভর জানান, জমিদারবাড়িতে প্রবেশমূল্য জনপ্রতি ১০০ টাকা। শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ছাড়ের ব্যবস্থা। বিশেষ করে শিক্ষা সফরকারীদের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়।
মন্তব্য করুন