- শৈলী
- গহনার দুনিয়া
গহনার দুনিয়া

একসময় স্বর্ণের গহনা নারীর পছন্দের তালিকায় শীর্ষে ছিল। বিয়ে ও যে কোনো অনুষ্ঠানে অভিজাত পরিবারের নারীর কানে দেখা যেত কানপাশা, বড় ঝুমকা, হাতে মোটা বালা, রত্নচূড়, গলায় জড়োয়া নেকলেস, সীতাহার ইত্যাদি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বর্ণের গহনার পরিবর্তে নারীরা বেছে নিয়েছেন পাথর, বিডস, সুতা, গামছা, কড়ি, সামুদ্রিক শাঁস, কাঠ, মাটি ইত্যাদি দিয়ে তৈরি গহনা। গহনার আকার, আকৃতি, নকশা সবকিছুতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। বেশ কয়েক বছর ধরে বাজারে দাপটের সঙ্গে টিকে আছে পিতল, ব্রোঞ্জ, অক্সিডাইজ ও মুক্তার গহনা। সেসব গহনার কারুকাজও মনোমুগ্ধকর। বলতে দ্বিধা নেই, বিয়ের কনেরাও এখন সানন্দে বেছে নেন পাথর, মুক্তা, ব্রোঞ্জের গহনা। এসব গহনার সুবিধা হচ্ছে- নিজের ইচ্ছেমতো পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে পরা যায়। পাথরের গহনায় ইচ্ছেমতো রঙিন পাথর কাস্টমাইজ করা যায়। দুল, নেকলেস, চোকার, মালা- সব ধরনের গহনাই এখন পাওয়া যায় কম দামে। তরুণী ছাড়াও সব বয়সী নারীকে এসব গহনা মানিয়ে যায়। যে কোনো ধরনের পোশাকের সঙ্গে পরা যায় সেসব গহনা।
বিশ্বরঙে গোল্ড প্লেটেড, অক্সিডাইজ, কাঠের বিডস, সুতা, পাথর, কড়ি, বোতাম, সুতা, মাটির গহনা পাওয়া যায়। এখনকার গহনায় প্রচুর ফিউশন আছে বলে মনে করেন বিশ্বরঙের স্বত্বাধিকারী বিপ্লব সাহা। পুঁতি ও মেটালের সংমিশ্রিত গহনা পাওয়া যায়। ভিন্ন মোটিভের গহনাও আছে।
প্রকৃতির রং-রূপ :আকাশে উড়ে যাওয়া ভেজা তুলোর মতো মেঘ, বিলের মাঝে ফুটে থাকা লাল শাপলা, ঘাটের কোণে বেঁধে রাখা ছোট ডিঙ্গি নৌকা, আকাশে উড়ে যাওয়া ছোট ছোট পাখি, বাগানে হাসি ছড়িয়ে থাকা হলুদ সূর্যমুখী- কী নেই গহনায়! মোটামুটি প্রকৃতির সব অনুষঙ্গই ঠাঁই পাচ্ছে। অনলাইন প্রতিষ্ঠান রূপসা মাটি, কাঠ, সুতা, বিডস, গামছা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি গহনা নিয়ে কাজ করে। রূপসার স্বত্বাধিকারী ঝুমকি বসু জানান, কাঠ, গামছা, বাটিক, মাটি, কড়ির গহনার চাহিদা এখন বেশি। গহনায় ফিউশন পছন্দ করছেন অনেকেই। কাঠের সঙ্গে মেটালের ফিউশন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
কাঠের গহনায় মনের মাধুরী মিশিয়ে রং করা যায়। হ্যান্ডপেইন্টের সাহায্যে মনের মতো করা যায়। শাপলা, সূর্যমুখী, পাখি কিংবা প্রিয় কোনো কবির প্রতিকৃতি, দেবীমুখও ফুটিয়ে তোলা যায়। ফিউশনধর্মী পোশাকের সঙ্গে এসব গহনা বেশ ভালো মানায়। তরুণীদের কাছে এসব গহনার চাহিদাও বেশি বলে মনে করেন ঝুমকি বসু।
গহনায় পাখির ঝরাপালক, পাটের সুতা, সামুদ্রিক শাঁস :গহনা এখন কেবল নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আটকে নেই। পাখির ঝরে যাওয়া পালক থেকে শুরু করে ঝিনুক, শামুক ও সামুদ্রিক শাঁস দিয়েও তৈরি হচ্ছে গহনা।
মনসিজ ক্রাফটের স্বত্বাধিকারী ও শিল্পী সাদিয়া শারমিন জানান, যুগোপযোগী চলতি প্রথা বা রীতিকেই ফ্যাশন বলা হয়। তাই মনসিজ ক্রাফট যুগের চাহিদা আর সময়ের ধরনের কথা মাথায় রেখে গহনার ভিন্নধর্মী প্রকাশকে গুরুত্ব দেয়। বিশেষ করে সেই সব প্রাকৃতিক উপকরণ, যেসব উপকরণ যুগে যুগে মানুষের বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সঙ্গে আবহ তৈরি করেছে। যেমন কড়ি, শামুক, ঝিনুক, কাঠের পুঁতি, কাচের পুঁতি, বিভিন্ন রঙের ঝরা পাখির পালক, পাটের সুতা ইত্যাদি।
সাদিয়া বলেন, 'সাময়িক সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও ব্যক্তিত্ব প্রকাশের ক্ষেত্রে পোশাকের সঙ্গে গহনা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। অন্যদিকে পৃথিবীতে প্রাকৃতিক এমন অনেক উপকরণ আছে, যা মানুষের শারীরিক ও মানসিক উদ্দীপনা আনতে সাহায্য করে। এমন অনেক লোকজ বিশ্বাস বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে। তাই এমন উপকরণ দিয়ে গহনা তৈরির ক্ষেত্রে মনসিজ বেশি উদ্যমী।'
সমুদ্রে জোয়ার-ভাটার সময় পূর্ণিমার আলোতেই ঝিনুক তার রং-রূপ ধারণ করে। তাই সেই ঝিনুক ও মুক্তা দিয়ে যখন কেউ গহনা পরে, তার মধ্যে প্রাকৃতিক পজিটিভ এনার্জি কাজ করে। পাখি সূর্যের কাছাকাছি পৌঁছতে পারা একমাত্র প্রাণী। তার শরীরে পালকের মধ্য দিয়েই সূর্যের শক্তি পৌঁছে। ঝরাপালক গহনা পরা অবস্থায় সূর্যের মতো একটি পজিটিভ এনার্জি সেই ব্যক্তি অনুভব করেন বলে মনে করেন সাদিয়া।
শুধু তাই নয়, দেশকে উপস্থাপন করে বিভিন্ন ধরনের ডাকটিকিট, ম্যাচবক্স নিয়েও কাজ করছেন মনসিজ ক্রাফট ও শিল্পী সাদিয়া শারমিন। একজন কারুশিল্পী হিসেবে এমন ভিন্নধর্মী গহনাকে 'ওয়্যারঅ্যাবল আর্ট' বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি।
ধাতুর তৈরি গহনা :বিভিন্ন ধাতু যেমন- তামা, ব্রোঞ্জের তৈরি গহনার চাহিদাও শীর্ষে। যে কোনো দাওয়াতে গেলে এসব গহনায় নিজেকে রাঙিয়ে নেওয়া যায়। আর পোশাকের সঙ্গে মানানসই গহনা না হলে সাজ ঠিক পূর্ণতা পায় না বলে জানান অঞ্জন'সের স্বত্বাধিকারী শাহীন আহমেদ। তিনি জানান, অঞ্জন'সে বিভিন্ন ধাতুর তৈরি গহনা আছে। আছে মুক্তা ও পাথরের তৈরি গহনাও। বিভিন্ন আকৃতি ও নকশার কানের দুল, আংটি, নেকলেস, মালা, চোকার, ব্রেসলেট ইত্যাদি আছে।
আয়তাকার, ডিম্বাকার, বুলেট আকৃতির, বৃত্তাকার- এগুলোর সঙ্গে ফিউশন লক্ষ্য করা যায় অঞ্জন'সের গহনায়। ঝালরযুক্ত আংটিও আছে সেখানে। শাহীন আহমেদ জানান, ব্র্যান্ডটিতে রূপার তৈরি ও গোল্ড প্লেটের গহনাও আছে। সেই সঙ্গে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী কড়ি, বিডস, কাঠ, সুতা, পুঁতির গহনা রাখা হয়েছে। সময়, ঋতু, উৎসব ও পরিবেশের সঙ্গে মিল রেখে এসব গহনার চাহিদা বাড়ে।
গহনায় ঐতিহ্য :পোশাকের মতো এখন গহনায় ফিরে এসেছে পুরোনো নকশা। আগেকার দিনে দাদি-নানিরা যেসব নকশার গহনা পরতেন, এখন আবারও সেসব নিয়ে কাজ করছেন সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরির স্বত্বাধিকারী লরা খান। সেখানকার গহনার নকশা নিমেষেই আপনার মন কাড়বে। পুরোনোর সঙ্গে নতুনের মিশেলও আছে বিভিন্ন গহনায়। পিতল ও তামা নিয়ে কাজ করলেও সেগুলোতে স্বর্ণ-রূপার প্লেটিং দেওয়া হয়, যার কারণে গহনা পায় ভিন্নমাত্রা। বিয়ে, পানচিনি, বাগদানে এসব গহনা অনায়াসে পরা যায়।
পোশাকভেদে গহনা :বিপ্লব সাহা বলেন, 'শাড়ির পাড়ে যদি সোনালি রং থাকে, তাহলে পাথরের গহনা মানিয়ে যায়। এখন অনেকে কন্ট্রাস্ট তথা বিপরীত রঙের গহনা পরেন। সবুজ রঙের শাড়ির সঙ্গে লাল কিংবা মেরুন গহনা পরেন। অনেকে ঝোলানো গহনা পরতে পছন্দ করেন। যদি পোশাকের গলা শর্ট ও চাপানো হয়, তার সঙ্গে ঝোলানো গহনা পরলে ভালো দেখায়। কাপড়ের মধ্যে সাদার প্রাধান্য বেশি থাকলে মুক্তার গহনা মানিয়ে যায়।'
সুতি শাড়ির সঙ্গে কাঠ, সুতা, কড়ি, পুঁতির গহনা মানাবে। সিল্ক্ক, কাতান, জামদানি এসব পোশাকের সঙ্গে সিলভার, মুক্তা, পাথরের গহনা মানাবে। কুর্তা ও কামিজের সঙ্গে টার্সেল, সুতা, কড়ির গহনা বেশ ভালো মানায়। পশ্চিমা পোশাকের সঙ্গে ছোট টপ, ভারী গলার মালা মানায়। আজকাল ওঠানো গলার পোশাকের সঙ্গে চোকার ধরনের গহনা বেশ চলছে। নিয়মিত যারা অফিস কিংবা ক্লাস করেন, তারা হালকা নকশার গহনা বেছে নিতে পারেন। ছিমছাম কুর্তি, কুর্তা কিংবা কামিজের সঙ্গে টেরাকোটা ও বিমূর্ত মোটিফের নকশা করা মালা পরলে ভালো লাগবে।
যত্ন
বাইরে থেকে এসে সব ধরনের গহনা খুলে বাতাসের সান্নিধ্যে রাখা উচিত। এতে ঘাম শুকিয়ে যাবে।
- পাথরের গহনা পরলে খেয়াল রাখতে হবে কোনো কিছুর সঙ্গে লেগে যেন পাথর পরে না যায়। মুক্তার গহনার ক্ষেত্রেও একই সতর্কতা মানতে হবে।
- সব গহনা একই বাক্সে রাখা যাবে না। এতে দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবে। গহনা টিস্যুতে মুড়িয়ে আলাদা বাক্সে তুলে রাখতে পারেন। মুক্তার গহনা সিল্ক্কের পাউচে রাখলে ভালো থাকবে।
- কাঠের গহনা, সুতা, বিডস ও কড়ির গহনা, ধাতুর গহনা পানিতে যেন না ভিজে, সেদিকে খেয়াল রাখবেন। এতে রং উঠে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সুতা ও টার্সেল ভিজে গেলে গহনার স্থায়িত্ব নষ্ট হতে পারে। ধাতুর গহনা পানির সান্নিধ্যে গেলে দ্রুতই কালচে হয়ে যেতে পারে।
- গহনা ময়লা হলে প্রথমে সুতি কাপড় ও টিস্যুর সাহায্যে মুছে নিন। সরাসরি পানি ও ডিটারজেন্টের সাহায্যে ধুতে যাবেন না। এতে রং পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে।
মন্তব্য করুন