
মডেল: তামান্না, মেকওভার: জারা’স বিউটি লাউঞ্জ, ছবি: ফয়সাল সিদ্দিক কাব্য
কর্মব্যস্ততার ফাঁকে একটু নিজের যত্ন নিন। ত্বকের মলিনতা, রুক্ষভাব, মরা চামড়া দূর করে ত্বককে করে তুলুন প্রাণবন্ত ও উজ্জ্বল। ত্বকের মাধুর্য ও লাবণ্য বাড়াতে বেছে নিতে পারেন ভেষজ উপাদান। লিখেছেন রিক্তা রিচি
মিসরের মোহনীয় রানী ক্লিওপেট্রা ত্বকচর্চা করতেন রাজকীয় স্টাইলে। গাধার দুধের সঙ্গে মধু, অলিভ অয়েল মিশিয়ে স্নান করতেন তিনি। রানী সলিড সোনার মাস্ক ব্যবহার করতেন– এমনটাও শোনা যায়। রাজকীয় রূপচর্চার পাশাপাশি সৌন্দর্যচর্চায় রানী ব্যবহার করতেন তাজা ঘৃতকুমারী। ঘৃতকুমারীর জেলের সঙ্গে মধু মিশিয়ে ফেস মাস্ক বানিয়ে ত্বকে লাগাতেন। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, ভুবনমোহিনী কতটা গুরুত্ব দিতেন ভেষজ উপাদানকে। ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে হলুদ, তুলসী, নিম, দারচিনি, লবঙ্গ, রসুন, আমলকী, আদা, থানকুনি, ঘৃতকুমারী ইত্যাদি উপাদানগুলোর জুড়ি নেই। যুগ যুগ ধরে দাদি-নানিরা হলুদ, আমলকী এসব উপাদান সৌন্দর্যচর্চায় ব্যবহার করছেন।
হলুদের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি উপাদান ব্রণ সারাতে ভালো কাজ করে। আবার উজ্জ্বলতা বাড়াতেও কাজ করে হলুদ। ভেতর থেকে ত্বক যেন উজ্জ্বল ও সুন্দর হয়, এ জন্য অনেক রূপবিশেষজ্ঞ রোজ হলুদ-দুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন। আবার বিয়ের আগের দিনও বর-কনের ত্বকে কাঁচা হলুদ লাগানোর রেওয়াজ আছে। উঠানে পাটা ফেলে তার ওপর বেশ কয়েকটি কাঁচা হলুদ বেটে, উল্লাস ও হুড়োহুড়ি করে পাড়ার কিশোরী, ভাবি ও অন্যদের ত্বকে লাগিয়ে দেওয়ার প্রথা অনেক আগের। যাক সে কথা। ত্বকের যত্নে এখন কেবল ঘরোয়া ও ভেষজ উপাদান ব্যবহৃত হয়, তা নয়। বিভিন্ন উপাদানের নির্যাস দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ক্রিম। সেসব প্রক্রিয়াজাত পণ্যে কৃত্রিম রং, ঘ্রাণের জন্য সুগন্ধি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। মোড়কীকরণও হয় ক্রেতার মনোযোগকে কেন্দ্র করে। যার ফলে সেসব পণ্যের দাম স্বাভাবিকভাবেই বেশি হয়। তাই বাজারের সেসব পণ্য ব্যবহার না করে, ঘরেই ভেষজ উপাদান দিয়ে ত্বকের যত্ন নিতে পারেন। এতে একদিকে বাড়তি খরচ হবে না, অন্যদিকে ত্বক থাকবে সুন্দর। জারা’স বিউটি লাউঞ্জের স্বত্বাধিকারী ও রূপ বিশেষজ্ঞ ফারহানা রুমি জানান, প্রাকৃতিক গুণে সমৃদ্ধ বেশকিছু ভেষজ উপাদান ত্বককে সুন্দর, সুস্থ ও লাবণ্যময় করে তোলে। এসব উপাদানের নিয়মিত ও পরিকল্পিত ব্যবহার আপনাকে বাহ্যিকভাবে অনন্য ও অসাধারণ করে তুলবে। শুধু তাই নয়, এসব ভেষজ ব্রণ, র্যাশ, ছোপ ছোপ দাগ দূর করে আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে সাহায্য করে।
নিমে নিরাময়: নিমের পাতা, ডাল সবকিছুরই গুণ রয়েছে। ত্বকের বিভিন্ন প্রদাহ দূর করতে নিম কার্যকরী। রূপচর্চায় নিমের ব্যবহারও বেশ জনপ্রিয়। রূপবিশেষজ্ঞ ফারহানা রুমি জানান, কয়েকটি নিমের পাতা, অল্প হলুদের গুঁড়া এবং ঠান্ডা তরল দুধ দিয়ে পেস্ট তৈরি করে ত্বকে লাগিয়ে ম্যাসাজ করুন। ১৫ মিনিট পর শুকিয়ে গেলে পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। নিম ও হলুদ ত্বকের সংক্রমণ এবং ব্যাকটেরিয়া দূর করে। এ ছাড়া তৈলাক্ত ভাব, ব্রণের প্রকোপ কমায়। এটি ত্বকের ব্ল্যাকহেডস ও রোদে পোড়া দাগ দূর করে। ত্বক উজ্জ্বল ও সুন্দর করতেও নিয়মিত ব্যবহার করতে পারেন নিমপাতার ফেসপ্যাক। নিমপাতা পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। ১ ঘণ্টা পর বেটে নিন। এরপর নিমের পেস্ট ১ ঘণ্টা ত্বকে লাগিয়ে রেখে ধুয়ে ফেলুন। এটি ত্বকের র্যাশ ও চুলকানি দূর করবে।
হলুদে উজ্জ্বল: হলুদের অ্যান্টিসেপটিক, অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান ত্বকের বিভিন্ন প্রদাহ দূর করে ত্বককে উজ্জ্বল করে। শোভন’স মেকওভারের স্বত্বাধিকারী ও কসমেটোলজিস্ট শোভন সাহা জানান, ত্বকের যত্নে কাঁচা হলুদ বাটা বেশি ভালো কাজে দেয়। শুষ্ক ত্বকে ১ চামচ কাঁচা হলুদের পেস্টের সঙ্গে এক চামচ দুধের সর এবং ১ চামচ পানি মিশিয়ে ব্যবহার করলে উপকার মিলবে। তৈলাক্ত ত্বকের জন্য ঘৃতকুমারীর জেলের সঙ্গে কাঁচা হলুদ বাটা এবং মুলতানি মাটি মিশিয়ে প্যাক বানিয়ে মুখে লাগাতে পারেন। সব ধরনের ত্বকে ব্যবহারের জন্য ১ চামচ হলুদ বাটা, ১ চামচ মুলতানি মাটি, ১ চামচ গোলাপের পাপড়ি পেস্ট ও দুধের সর মিশিয়ে প্যাক তৈরি করুন। এটি মুখে লাগিয়ে শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তিনি জানান, কাঁচা হলুদ কিংবা হলুদের গুঁড়া কখনও সরাসরি ব্যবহার করা ঠিক নয়। ব্যবহার করতে হবে অন্য উপকরণের সঙ্গে মিশিয়ে। আবার হলুদ ব্যবহারের পর তিন থেকে চার দিন চুলার কাছে, সূর্যের আলোয় যাওয়া ঠিক নয়। এতে ত্বক কালো হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।
দারচিনিতে দারুণ: ব্রণের দাগ, মেছতা, কালো দাগ দূর করতে সাহায্য করে দারচিনি। একইসঙ্গে মুখের রোমকূপ পরিষ্কার করে এ উপাদান। ব্রণ প্রতিরোধক ফেসমাস্ক বানাতে তিন টেবিল চামচ মধুর সঙ্গে এক চা চামচ দারচিনির গুঁড়া নিন। প্রয়োজনে অল্প পরিমাণ পানি মেশান। এটি মুখে লাগিয়ে ১০-১৫ মিনিট রাখুন। এ মিশ্রণ ব্যাকটেরিয়া রোধ করবে। মধু মুখের লালচে ভাব কমিয়ে ত্বককে নরম ও কোমল করবে। শুষ্ক ত্বকের অধিকারীরা দারচিনি দিয়ে স্ক্রাব বানাতে পারেন। লবণ, বাদাম তেল, অলিভ অয়েল, মধু ও দারচিনির মিশ্রণে একটি স্ক্রাব তৈরি করুন। এটি শুষ্ক ত্বকে ব্যবহার করে কয়েক মিনিট ম্যাসাজ করুন। এরপর ধুয়ে ফেলুন।
ঘৃতকুমারীতে টানটান ত্বক: ভেষজ পণ্যের প্রতিষ্ঠান ‘আমলকী’র স্বত্বাধিকারী এবং ভেষজ বিশেষজ্ঞ নন্দিতা শারমিন জানান, অ্যালোভেরা তথা ঘৃতকুমারীর ব্যবহার বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত। প্রাচীনকাল থেকেই ত্বকের সমস্যায় অ্যালোভেরা ব্যবহার হয়ে আসছে। আয়ুর্বেদেও লেখা আছে অ্যালোভেরার গুণ। তিনি জানান, ত্বকের বয়স রুখে দিতে ও ত্বকে বলিরেখা মলিন করতে কাজ করে ঘৃতকুমারী। কারণ অ্যালোভেরায় আছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টস; যা ত্বকের গভীরে পুষ্টি জোগান দেয়। রুক্ষ-শুষ্ক ভাব দূর করে ত্বককে আর্দ্র রাখতে সাহায্য করে অ্যালোভেরা তথা ঘৃতকুমারীর জেল। অ্যালোভেরায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে এনজাইম, অ্যান্টিফ্লেমেটরি উপাদান ও ভিটামিন। এসব উপাদান ব্রণ ও ব্রণের দাগ কমাতে সাহায্য করে। মুলতানি মাটির সঙ্গে অ্যালোভেরা মিশিয়ে ব্যবহার করার পরামর্শ দেন নন্দিতা শারমিন। চাইলে এর সঙ্গে ঠান্ডা দুধ মেশাতে পারেন। অ্যালোভেরা তথা ঘৃতকুমারীর জেলের সঙ্গে এক চিমটি হলুদের গুঁড়া, এক চা চামচ মধু, কয়েক ফোঁটা গোলাপ জল মিশিয়ে ত্বকে লাগাতে পারেন। এই মিশ্রণ ত্বকে লাগিয়ে ২০ মিনিট রাখুন। এরপর কুসুম গরম পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিন। সপ্তাহে দু’বার এটি ব্যবহার করলে ত্বক উজ্জ্বল ও সুন্দর হবে। ত্বক টানটান ও শীতল রাখতে তাজা অ্যালোভেরার জেল মুখে লাগাতে পারেন।
তুলসীতে তুলতুলে ত্বক: তুলসীর ঔষধি গুণের কথা সবাই জানেন। ভেষজ এ উপাদানটি দিয়ে ত্বকের লাবণ্য বাড়ানো যায়। যাদের ত্বকে ছোপ ছোপ দাগ আছে, যাদের ত্বক রোদে পুড়ে কালচে হয়ে গেছে তারা তুলসী পাতার পেস্ট লাগাতে পারেন। তুলসী পাতার পেস্টের সঙ্গে ডিমের সাদা অংশ ভালো করে মিশিয়ে নিন। এটি ত্বকে লাগিয়ে ২০ মিনিট রাখুন। এটি ছোপ ছোপ দাগ কমাতে এবং পোরসের ছিদ্র ছোট করতে ভূমিকা রাখে। ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে ১০টি তুলসী পাতা বেটে পেস্ট করে নিন। এর সঙ্গে আধা চা চামচ গুঁড়া দুধ মিশিয়ে নিন। এই মিশ্রণটি ত্বকে লাগিয়ে ১৫-২০ মিনিট অপেক্ষা করুন। শুকিয়ে গেলে ধুয়ে, পরিষ্কার তোয়ালে দিয়ে মুছে নিন।
যাদের প্রচুর ব্রণ হয়, তারা ১০-১২টি তুলসী পাতার সঙ্গে ৮-১০টি নিমপাতা বেটে পেস্ট করে নিন। এর সঙ্গে মেশান আধা চা চামচ চন্দনের গুঁড়া এবং পরিমাণমতো গোলাপ জল। এ প্যাক ত্বকে লাগিয়ে ২০ মিনিটের মতো রাখুন। এরপর ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
আমলকীতে অনন্য: আমলকী সব ধরনের ত্বকেই ব্যবহার করা যায়। ত্বকের পিগমেন্টেশন দূর করে এটি। নিয়মিত ব্যবহারে ত্বক হয় প্রাণবন্ত ও উজ্জ্বল। ঘরে বসেই ত্বকে মরা চামড়া দূর করতে আমলকীর স্ক্রাব বানিয়ে নিন। এক চা চামচ কাঁচা হলুদ বাটার সঙ্গে এক চা চামচ আমলকীর গুঁড়া ও পরিমাণমতো পানি মিশিয়ে নিন। এটি দিয়ে আলতোভাবে ত্বকে ম্যাসাজ করুন। ২ চা চামচ টক দইয়ের সঙ্গে ১ চা চামচ মধু ও ১ চা চামচ আমলকীর পেস্ট মিশিয়ে নিন। এটি ত্বকে লাগিয়ে ১৫-২০ মিনিট রাখুন। সপ্তাহে দু’বার ব্যবহারে ত্বকের নিস্তেজ ভাব দূর হবে।
মন্তব্য করুন