নারীর একা জীবন প্রতিবন্ধকতা

অলংকরণ ::বোরহান আজাদ
নিশাত সুলতানা
প্রকাশ: ২১ মে ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২১ মে ২০২২ | ২৩:৫৭
কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারীরাও এগিয়ে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে বাড়ছে নারীর একলা চলার চর্চাও। আমাদের পরিবার ও আর্থসামাজিক বাস্তবতায় নারীর নতুন এই জীবনযাপন যদিও এখনও সহজাত হয়ে ওঠেনি, তবু নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁরা এগিয়ে যাচ্ছেন। নারীর জীবনের এই নতুন অগ্রযাত্রার বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখেছেন নিশাত সুলতানা
অনামিকা চৌধুরী (ছদ্মনাম), বড় হয়েছেন ঢাকায় একটি রক্ষণশীল পরিবারে। পরিবারে তাঁর মতামতের দাম কেউ কখনোই দেননি। এমনকি তাঁর মায়ের মতামত কখনও গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে- এমন কোনো ঘটনা কখনও মনে পড়ে না অনামিকার। রোজ বাসা আর স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই জীবনের সীমানা টানা ছিল তাঁর। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে একদিন একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি শুরু করলেন অনামিকা। ভেবেছিলেন, এবার হয়তো কিছুটা হলেও জীবনে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া যাবে; তাঁর মতামত অন্তত কিছুটা হলেও গুরুত্ব পাবে। তাঁর অফিসে আসা-যাওয়া নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না; কিন্তু কয়েক দিনের মাথায় ভুল ভাঙল তাঁর। অফিস থেকে ফিরতে সামান্য দেরি হলেই বাসায় ফিরে হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় অনামিকাকে। কয়েক মাস মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করার পর অবশেষে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল তাঁর। বাড়ি থেকে বের হয়ে একা থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন অনামিকা। বিয়ের পর জবাবদিহির চাপ আগে থেকেই অনুভব করে ভবিষ্যতে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কয়েক বছর এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে। যদিও একাকী, তবুও এই জীবন নিয়ে ভালো আছেন তিনি।
ছন্দা ভৌমিক (ছদ্মনাম), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ভালোবেসে ছিলেন সহপাঠী রেজওয়ানুল হককে (ছদ্মনাম)। তাঁদের এই সম্পর্ক নিয়ে দুই পরিবারেই প্রবল আপত্তি ছিল। তবে ছন্দা আর রেজওয়ানুল আশা করেছিলেন, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পরিবারের অমতে হলেও বিয়ে করবেন তাঁরা। কিন্তু চাকরি পাওয়ার পর হঠাৎ এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে গেলেন রেজওয়ানুল। পরিবারের অসম্মতিতে ছন্দাকে বিয়ে করতে পারবেন না জানিয়ে প্রেমের সম্পর্কের ইতি টানেন। দুই মাসের মাথায় মা-বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুললেন রেজওয়ানুল। অন্যদিকে ছন্দার আর বিয়ে করা হলো না। রেজওয়ানুল বিয়ে করার পর কেমন যেন নিজেকে ভীষণ ছোট লাগতে শুরু করল তাঁর। নতুন করে কারও সঙ্গে ঘর-সংসার করার বিষয়টিও চিন্তা করতে পারছিলেন না তিনি। একদিকে বিয়ের জন্য পরিবারের চাপ, অন্যদিকে বিয়ে নিয়ে ভীতি- এসব নিয়ে দ্বন্দ্বের একপর্যায়ে বাড়ি ছেড়ে একা থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।
ফারিন তাসনিয়া (ছদ্মনাম), উচ্চবিত্ত বাবার একমাত্র মেয়ে। ফারিন বড় হয়েছেন যৌথ পরিবারে। ফারিনের মা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে মাস্টার্স। ফারিন কখনও তাঁর মাকে সম্মানিত হতে দেখেননি বাবার পরিবারে। তিনি ছিলেন পরিবারের সবচেয়ে প্রয়োজনীয়, কিন্তু সবচেয়ে উপেক্ষিত একজন। দাদার বাড়ি লোকজনের কথার খোঁটা তো আছেই, তাসনিয়ার বাবাও তাঁর মাকে প্রায়ই শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেন। মায়ের ওপর নির্যাতন দেখে বেড়ে ওঠা ফারিন পুরুষের প্রতি ঘৃণা নিয়ে বড় হন। বিয়ের পর যদি স্বামীও তাঁর ওপর এ ধরনের নির্যাতন করে- এ ভাবনা থেকে তিনি বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য প্রতিমুহূর্তে পরিবার থেকে চাপ আসতে শুরু করে। একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে ফারিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। কয়েক দিন পর খোঁজ পেয়ে বাড়ির লোকজন তাঁকে নিতে আসেন। এই কয়দিনে তিনি অনেকটাই নিজেকে গুছিয়ে ফেলেছেন; বাসাও ভাড়া করেছেন। তিনি কোনো অবস্থাতেই নিজের বাড়ি কিংবা শ্বশুরবাড়িতে ভবিষ্যতের দিনগুলো কাটাতে রাজি নন। এভাবে একা একা প্রায় ১০টি বছর কেটে গেছে ফারিনের।
অনামিকা, ছন্দা কিংবা ফারিনের নামগুলো ছদ্মনাম হলেও গল্পগুলো কিন্তু জীবন থেকে নেওয়া। এই গল্পগুলো স্বাবলম্বী ও স্বাধীনচেতা নারীদের গল্প, যাঁরা জীবনকে একটু অন্যভাবে দেখেন। সমাজে প্রচলিত বিয়ে করে সংসারী হওয়ার চিরায়ত প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা ও আস্থা রেখে একা চলার সিদ্ধান্তে অবিচল থাকতে দেখা যায় আজকাল অনেক নারীকেই। বেশ কয়েক বছর আগেও শুধু পশ্চিমা বিশ্বের নারীদের এ ধরনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম আমরা। কিন্তু গত কয়েক বছরে বাংলাদেশেও এমন নারীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রচলিতের বাইরে গিয়ে নিজের সিদ্ধান্তকে এগিয়ে নেওয়ার পথটি যে কতটা কঠিন, তা একমাত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরাই জানেন। সমাজের বেঁধে দেওয়া প্রত্যাশার চাপে অনেক সময়ই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে এসব নারীর জীবন। প্রশ্ন হলো, তারপরও নারীরা একা থাকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কেন? তাঁদের এই সিদ্ধান্তে সমাজের সমস্যাটাই বা কী?
বিয়ে না করে একা থাকা এই নারীদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো, তাঁদের নিয়ে সমাজের নেতিবাচক মূল্যায়ন। কারণ ছাড়াই তাঁদের সম্পর্কে অনুমাননির্ভর নানা ধারণা পোষণ করা কিংবা ধারণার জন্ম দেওয়া। চারিত্রিক দোষ-ত্রুটি খুুঁজে বের করা, জন্মদান করতে পারার সক্ষমতাসহ শারীরিক নানা সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা, পারিবারিক ইতিহাস খুঁজে বের করার প্রবণতা প্রবলভাবে লক্ষ্য করা যায় সমাজের। অথচ কারও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অধিকার বা প্রয়োজন নেই সমাজের, যতক্ষণ না তা অন্যের ক্ষতির কারণ হয়।
একটি বিষয় লক্ষণীয়- অনামিকা, ছন্দা কিংবা ফারিনরা সমাজের উচ্চবিত্ত কিংবা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা পরিবারকে প্রতিনিধিত্ব করেন। সমাজে পিছিয়ে থাকা নারীদের পক্ষে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া আরও অনেক বেশি কঠিন। তবে সময়ের পরিবর্তন হচ্ছে, নারীরাও শিক্ষিত ও স্বনির্ভর হচ্ছেন। শিক্ষা ও যোগ্যতার সঙ্গে আত্মমর্যাদার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অনামিকা, ছন্দা কিংবা ফারিনদের মায়েরা যে সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারেননি; অনামিকা, ছন্দা কিংবা ফারিনরা সাহস করে সেই সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছেন। তাই সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নারীর সিদ্ধান্তের স্বাধীনতার বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। নারীর অবস্থানের পরিবর্তন ও অগ্রযাত্রাকে মাথায় রেখে সমাজ যত তাড়াতাড়ি শিক্ষিত, স্বনির্ভর ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারীর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে, সব দিক থেকে ততই মঙ্গল।
লেখক :উন্নয়নকর্মী
- বিষয় :
- নারীর জীবন
- কর্মক্ষেত্রে নারী
- পরিবার