সামাজিক হতাশা থেকে অপরাধ

সামিনা লুৎফা
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৮:৩৫
সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো একটি অপরটির সঙ্গে খুবই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি প্রতিষ্ঠানের কোনো বড় পরিবর্তন এলে, সে প্রতিষ্ঠানের প্রভাব অন্য প্রতিষ্ঠানের ওপরও পড়ে। পরিবার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান। পাশ্চাত্যে আরও অনেক আগে থেকেই পরিবারের মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন শুরু হয়। সত্তরের দশক থেকে শুরু হয়ে সেটা এখন অনেক বড় পরিবর্তনের দিকে গেছে। পরিবর্তনের আগে পর্যন্ত আমাদের পরিবার পুরোনো ধাঁচের ছিল। পরিবারের এ পরিবর্তনটা কিন্তু এমনি এমনি ঘটেনি, এটা ঘটেছে যেমন সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তনের প্রভাবে।
আগে ছিল কৃষিভিত্তিক সমাজ। কৃষির সঙ্গে বড় পরিবার, পরিবারের ভেতর আন্তঃসম্পর্ক খুব জরুরি। কৃষিতে পরিবারের সদস্যদের শ্রম, যে শ্রমের জন্য টাকা দিতে হয় না, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যতটা আমরা কৃষি থেকে সরে শিল্পায়নের দিকে এগিয়েছি, এ ধরনের সম্পর্কের মধ্যে মমতা, সম্পর্কের প্রেম-ভালোবাসা ধরে রাখার সামর্থ্যটাও কমে গেছে এবং এ কারণে মনে হচ্ছে, পরিবার ভেঙে যাচ্ছে বা পরিবারের সে আগের রূপ আর নেই। এ পাল্টানোর মধ্যে আরও খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় আছে– বিশ্বায়ন তেমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বের অন্য কোথাও পরিবর্তন এলে সেটার প্রভাবও আমাদের এখানে পড়ে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে সমাজের ভেতরের শ্রেণি বা স্তরগুলো অনেক বেশি বৈষম্যময় হয়ে ওঠে। তার মানে, সমাজের নিচের দিকের মানুষ কোনোভাবেই আর ওপরের দিকে উঠতে পারে না। গুটি কয়েক মানুষের পুঁজির সঞ্চারণ বাড়তে থাকে। বৈষম্য বেড়ে গেলে এর নানা রকম প্রকাশ এসে যুক্ত হয় বা চেপে বসে।
আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত, আইনের শাসনও একই অবস্থা। মানুষ যে কোথাও গিয়ে ক্ষোভ ঝাড়বে, সে অবস্থা নেই। এমনকি ফেসবুকে দুটি কথা বলার সুযোগও নেই। কারণ, সেখানে তো সাইবার নিরাপত্তা আইন রয়েছে। এসব কারণে মানুষ আসলে জানে না কোথায় গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করবে।
আরেকটা বিষয় হলো, অপরাধমূলক বিষয়ের ক্ষেত্রে আপনি যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হন, তাহলে শাস্তি হবে না, মানে আইনের শাসন আসলে নেই। আপনি যদি প্রভাবহীন বলয় থেকে আসেন, তাহলে শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অভাবের তাড়নায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে নানা রকম অপরাধ হতে পারে। দেখা যাচ্ছে, বাবা সন্তানদের হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন।
কৃষকদের আত্মহত্যার খবরও আমরা জানি। অনেক ঘটনা মানুষকে এক্সট্রিম অবস্থায় ফেলে দিতে পারে। যখন সমাজের বিচারব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজ করে না, ভারমুক্তভাবে কাজ করতে পারে না, শাসনযন্ত্র বা পুলিশ একসঙ্গে কাজ করে। সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকার জন্য অনেক ধরনের ছোট অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়। অপরাধেরও তো অনেক ধরনের প্রকারভেদ আছে। যেমন ২ হাজার কোটি টাকা পাচার করে দিলেন, সেটাও তো বড় অপরাধ। সেটার শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। এগুলো যে ঘটছে, তা যে আমরা দেখি না তা নয়। আমরা দেখি, আমরা দেখে দেখেই শিখি, এগুলো প্রভাবশালীর সঙ্গে যুক্ত। সে ক্ষেত্রে টাকা দিয়ে পার পাওয়া যায়, নানাভাবে এগুলোকে কেনা যায়, সেজন্য না করতে উৎসাহিত হয় না, এটা একটা বিষয় আর কী। এর সঙ্গে পরিবার ভেঙে যাওয়ার সরাসরি সম্পর্ক হয়তো নেই; কিন্তু পরিবার ভেঙে যাওয়াই এর সবটাই সমাজের পরিবর্তনের ফলাফল। v
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়