সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাব
পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা

চিত্রকর্ম : জন কুনান
শাহেরীন আরাফাত
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৮:৪৪
আর্থসামাজিক অবস্থার ভূমিকাই বেশি
কামাল চৌধুরী
অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের প্রধান কর্মক্ষম ব্যক্তিটি পরিবারের জন্য কিছু করতে না পারার ব্যর্থতা থেকে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করতে পারেন। হয়তো তাঁকে দোষারোপ করা হচ্ছে। ক্ষোভ, হতাশা, ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ নেতিবাচকভাবে ঘটতে পারে। তিনি হয়তো এটিকে একটি সমাধান বলে মনে করেছেন। আবার তিনি যেহেতু জানেন এটি সমাজ বা আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়, সেহেতু তিনি আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজেকে শেষ করার চেষ্টা করেছেন। এখানে তিনি পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যার মতো একটি অপরাধ করেছেন। এটিকে বলা যায়, ‘হোমিসাইডাল সুইসাইড’।
আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থায় নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো কীভাবে চলছে, তারা এর সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে কিনা, বেকারত্ব বাড়ছে কিনা, সৎভাবে কিছু করে চলার সুযোগ কমে যাচ্ছে কিনা– এর ফলে কেউ কেউ অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থার ভূমিকাই বেশি। এ ঘটনাগুলো যখন বাড়ছে, তখন বুঝতে হবে আমাদের নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য পরিবর্তিত সমাজ বাস্তবতা নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। আর্থসামাজিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে বেঁচে থাকার তাগিদ থেকে অনেকের মধ্যে এক ধরনের বেপরোয়া ভাব তৈরি হয়েছে। নিজের ক্ষতি হোক বা অন্যের ক্ষতি হোক– এটি দেখার বিষয় নয়। হয় বাঁচব, নয়তো শেষ হয়ে যাব। এর আগে অন্যদেরও শেষ করে দেব। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তারা বিভিন্ন অঘটনের জন্ম দিচ্ছে। এর সঙ্গে কিছু পূর্বপরিকল্পিতভাবে অপরাধও হচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিরও একটা ভূমিকা রয়েছে। তবে বিচ্ছিন্নতার কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি বাড়ছে নাকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তির কারণে বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে, তা বলা মুশকিল। দুটি বিষয়ই এখানে একসঙ্গে
ক্রিয়াশীল। v
নারীর ওপর বিশাল চাপ
শিরীন হক
সদস্য ও প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী, নারীপক্ষ
একজনের আয়ে সংসার চলে না। আর্থসামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে নারীকে আয়-উপার্জনের জন্য বাড়ির বাইরে যেতেই হবে। এটি নারীর ওপর এক বিশাল চাপ। নারী যেমন বাসে নিরাপদ নয়, তেমনি রাস্তাঘাটেও নিরাপদ নয়। আবার তার শিশুকে নিরাপদ জায়গায় রেখে আসার সুযোগ থাকে না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। আগে যৌথ পরিবার ছিল। শাশুড়ি বা মায়ের কাছে শিশুসন্তানকে রেখে যেতে পারত। এখন সেই সুযোগ নেই। শুনেছি, অনেকে সন্তানকে বাড়িতে তালা মেরে কাজে যান। সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। আবার তালা মেরে না গেলেও ঝুঁকিপূর্ণ। মা-বাবা বাড়িতে না থাকা অবস্থায় শিশু ধর্ষণের কথা আমরা প্রায়ই শুনি।
একটা সময়ে সরকারি পর্যায়ে ডে-কেয়ার সেন্টার বা দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনের কথা ব্যাপকভাবে আলোচিত হতো। নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক কাজে যুক্ত করার জন্যই তা করা হয়। কথা ছিল দিবাযত্ন কেন্দ্র দেশব্যাপী আরও বৃহৎ পরিসরে দাঁড়াবে; কিন্তু তা হয়নি। বিভাগীয় শহরগুলোয় আংশিকভাবে তা করা হয়েছে। নারীদের জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র একটা বড় সমস্যা।
নারীর আর্থিক কাজে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবহন আরেকটি বড় বিষয়। নারীকে বাসে হেনস্তা হতে হয়। নারীদের গায়ে হাত দেওয়া অনেকটা নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। নিরাপদ পরিবহন না থাকলেও তাকে যেতে হচ্ছে বাইরে। v
যোগাযোগ কমে গেছে
শরমিন্দ নীলোর্মি
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আগে আত্মীয়স্বজন একসঙ্গে বাস করেছে। এমনকি বাড়ি ভাগ হওয়ার পরও ভাইবোনরা পাশাপাশিই থেকেছে। মানুষ এখন শহরমুখী হয়েছে। সেই সঙ্গে জায়গাও কমে গেছে। ফলে এখন ইচ্ছা থাকলেই সবাই একসঙ্গে থাকা যাচ্ছে না। মধ্যবিত্ত সমাজে মা-বাবা দু’জনকেই কাজে যুক্ত হতে হচ্ছে। ফলে সন্তানকে আগেকার মতো সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আগে পাড়ার একটা প্রভাব ছিল। পাড়ার লোকজন একে-অপরকে চিনত। ছেলেমেয়েদের দিকে তখন অনেকগুলো চোখ লক্ষ্য রাখত। এখন পাড়ার কনসেপ্টই নেই।
প্রযুক্তির প্রভাবে যন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বাড়ছে। তবে তা সরাসরি যোগাযোগের সুযোগটা কমিয়ে দিয়েছে। আমাদের অনেক প্রয়োজনই এখন ভার্চুয়াল মাধ্যমে পূরণ হয়ে যাচ্ছে। ফলে সামনাসামনি কফি খেতে খেতে আর আড্ডা দেওয়া হচ্ছে না।
সন্তানদের ডিভাইস ব্যবহার করতে দিতে হবে। তবে মা-বাবাকে তা নিয়ন্ত্রণ করতেও জানতে হবে। ওই দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো সময় থাকতে হবে। ব্যস্ততার অজুহাতে
মা-বাবা দায় এড়াতে পারেন না। আবার নতুন প্রজন্মের
সঙ্গে তাল মেলাতে হলে মা-বাবাকে আপডেটেড থাকারও প্রয়োজন রয়েছে। v