বাল্যবিয়ে
গ্রাম-বাংলার কঠিন বাস্তবতা
দারিদ্র্য ও নিরাপত্তার অভাবে বাড়ছে বাল্যবিয়ে

ছবি :: হিমু/ইউনিসেফ
ড. আনেয়ারা বেগম/ইফরাত জাহান
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৩:৪৪
সাভার উপজেলার নবীনগর গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তান রাশেদা বানু (ছদ্মনাম)। ছয় বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। রাশিদার বাবা সাভার বাজারের একজন সবজিবিক্রেতা আর মা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছুটা বুয়ার কাজ করেন। একটি পুত্রসন্তানের আশায় রাশিদার পিতামাতা পরপর ছয়টি কন্যাসন্তান জন্ম দেন। চরম অভাবের সংসারে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও রাশিদার পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, পিতামাতা কর্মজীবী হওয়ার কারণে রাশিদাকে তাঁর ছোট বোনদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে হয়। সে স্কুলে চলে যাওয়ার পর বোনরা বাসায় একা থাকত। তাছাড়া সরকারি বিদ্যালয় হলেও লেখাপড়ার সরঞ্জমাদি, প্রাইভেট পড়া, প্রতিদিন অটোতে চড়ে স্কুলে যাতায়াত–এসব খরচ চালানো রাশিদার পিতামাতার পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছিল। স্কুলে যাতায়াতের পথে গ্রামের কিছু বখাটে ছেলে রাশিদাকে বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করত, গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করত।
অভিভাবক রাশিদার পড়াশোনা বন্ধ করে তাঁকে বাসায় রাখার সিদ্ধান্ত নেন এবং বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা শুরু করেন। বেশির ভাগ পাত্রপক্ষ রাশিদার গায়ের রং কালো বলে বিয়েতে অনাগ্রহ দেখায় আর যারা রাজি হয় তারা মোটা অঙ্কের যৌতুক দাবি করে; যা দেওয়ার ক্ষমতা রাশিদার পিতার ছিল না। এভাবেই এক বছর কেটে যায় এবং রাশিদা ১৪ বছরে পা রাখে। এমন সময় সাভারের হেমায়েতপুরের এক ব্যবসায়ী মোবারক মিয়ার (ছদ্মনাম) সঙ্গে বাজারে রাশিদার বাবার পরিচয় হয়। মোবারক মিয়ার বয়স তখন ৫৮ বছর এবং তিনি একজন ফল ও মাছ ব্যবসায়ী। রাশিদাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা জানার পর তিনি সরাসরি রাশিদাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং রাশিদার বাবাও কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই মেয়েকে এক সপ্তাহ পর বাসায় মৌলভি ডেকে মোবারক মিয়ার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন। রাশিদা ছিল মোবারক মিয়ার তৃতীয় স্ত্রী। বিয়ের রাতেই রাশিদা ভয়ানক অভিজ্ঞতার শিকার হয়। কেননা, মোবারক মিয়ার শারীরিক চাহিদা রাশিদার পক্ষে পূরণ করা সম্ভব হয়নি। বিয়ের পরের দিন রাশিদাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে রাশিদা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দুই ব্যাগ রক্ত নেওয়ার পর সে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। সুস্থ হওয়ার পর রাশিদা বাবার বাড়ি ফেরত আসতে চাইলেও অভিভাবকদের আপত্তির মুখে তাঁকে মোবারক মিয়ার বাসায় ফিরে যেতে হয় এবং প্রতি রাতেই অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। মাত্র ১৬ বৎসর বয়সে রাশিদা গর্ভধারণ করে। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর নানা শারীরিক জটিলতা শুরু হয় এবং অসুস্থ স্ত্রীর প্রতি মোবারক মিয়ার আকর্ষণ কমতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তিনি রাশিদাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। এর কয়েক মাস পর রাশিদা বাবার বাড়িতে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়। মা ও ছেলে উভয়ই অপুষ্টিজনিত কারণে দুর্বল ছিল। এক পর্যায়ে চিকিৎসার অভাবে রাশিদার সন্তানের মৃত্যু হয়। রাশিদার মা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের বাসায় বুয়ার কাজ করতেন। সেই শিক্ষক সব জানার পর বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের স্থানীয় কার্যালয়ের ঠিকানা দিয়ে সেখানে রাশিদার মাকে পাঠিয়ে দেন। সংগঠনের সভাপতি সব জানার পর মোবারক মিয়াকে তাদের অফিসে ডেকে পাঠান।
তিনবার সালিশ হওয়ার পর রাশিদার সঙ্গে মোবারক মিয়ার মৌখিকভাবে তালাক হয় এবং মোবারক মিয়া দেনমোহর ও ক্ষতিপূরণসহ রাশিদাকে দুই লাখ টাকা দেন। সেই টাকা মহিলা পরিষদ কর্তৃপক্ষের সহায়তায় রাশিদার নামে একক ব্যাংক হিসাব খুলে সেখানে জমা করা হয়। কাপড় সেলাইয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে রাশিদা এখন বাসায় বসে দর্জির কাজ করছেন এবং সাভার নিউমার্কেটে তিনি সেলাই করা কাপড় বিক্রি করেন।
রাশিদা জানান, স্কুলে তাঁর রোল নম্বর সব সময় এক থেকে পাঁচের মধ্যে ছিল। শিক্ষকরা তাঁকে স্নেহ করতেন; কিন্তু বাবার ভুল সিদ্ধান্ত ও অভাবের সংসারে জন্ম হওয়ার কারণে আজ এই করুণ পরিণতি হয়েছে। তিনি চান না–বোনদের জীবন তাঁর মতো হোক। তিনি কাজ করে নিজের যাবতীয় খরচের পাশাপাশি বোনদের পড়াশোনার খরচও বর্তমানে চালাচ্ছেন।
অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া একটি আইনগত অপরাধ এবং দেশে এ-সংক্রান্ত একটি আইন রয়েছে। রাশিদা ও তাঁর মা এ ব্যাপারে জানেন কিনা, জানতে চাওয়া হলে তারা বলেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ থেকে তাদের এ ব্যাপারে জানানো হয়েছে। রাশিদার মা জানান, তাদের গ্রামে বাল্যবিয়ে একটি প্রথা বলা যায়। আর বিয়েতে যৌতুকও দিতে হয়। অন্যথায় মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে অপমানিত হতে হয়। তাদের গ্রামে মেয়েদের দেরিতে বিয়ে হলে সবাই নোংরা মন্তব্য করে। অনেক সময় মেয়ের চরিত্র নিয়ে কুৎসা রটনা করে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে দেখা যায়, ২০২২ সালে ১৫ বছরের বেশি কিন্তু ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের ঘটনা বেড়ে ৪০ দশমিক ৮৫ শতাংশে পৌঁছেছে। আগের বছর যা ছিল ৩২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে, ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের ঘটনা আগের বছরের চেয়ে ২০২২ সালে প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এ ধরনের বিয়ের ঘটনা বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল ৪ দশমিক ৭২ শতাংশ।
ব্র্যাকের গবেষণা থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের ৬০ শতাংশেরও বেশি পরিবারে বাল্যবিয়ের চর্চা হচ্ছে। বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েদের ৬ দশমিক ৯ শতাংশের বয়স ১৫ বছরের নিচে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে পিরোজপুর, সেখানে বাল্যবিয়ের হার ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ। এই হার সবচেয়ে কম নেত্রকোনায় ২৪ দশমিক ১ শতাংশ। বাল্যবিয়ের কারণগুলোর মধ্যে ১৮ শতাংশ দারিদ্র্য, ১০ শতাংশ বরপক্ষ যৌতুক কম বা না চাওয়া, ৭ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, মেয়ে পড়ালেখায় ভালো না হওয়াকে ৬ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণের কথা বলেছেন আরও ১৫ শতাংশ অভিভাবক।
বাল্যবিয়ে রোধের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ জরুরি–
১. গ্রামের চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে প্রচলিত আইনের প্রচারণা বৃদ্ধি;
২. সরকারি প্রতিনিধি ও এনজিওর সহায়তায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উঠান বৈঠক, পথনাটকসহ বিভিন্ন ধরনের অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম;
৩. স্কুলের পাঠ্যসূচিতে বাল্যবিয়ের কুফল বর্ণনা এবং এটি প্রতিরোধের জন্য করণীয়, সেইসঙ্গে হটলাইন নম্বর ও লাল কার্ড কর্মসূচি সম্পর্কে বিস্তারিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্তীকরণ;
৪. দরিদ্র ছাত্রীদের উপবৃত্তি দেওয়ার পাশাপাশি স্কুলের তত্ত্বাবধানে যাতায়াতের ব্যবস্থা করলে তারা একদিকে পাড়ার বখাটেদের দ্বারা উত্ত্যক্ত হওয়া থেকে মুক্তি পাবে, অন্যদিকে তার পরিবারকে মেয়ের যাতায়াতের খরচ বহন করতে হবে না। ফলে তারা অভাবের কারণে মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ করতে উদ্যোগী হবে না।
ড. আনোয়ারা বেগম, গবেষণা পরিচালক
ইফরাত জাহান, গবেষণা কর্মকর্তা
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)
- বিষয় :
- বাল্যবিয়ে