ঢাকা বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

অবহেলিত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা

অবহেলিত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা

প্রতীকী ছবি

 কামাল চৌধুরী

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪ | ২৩:০৫ | আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৪ | ১৩:২৬

আমরা যখন বাড়ি বানাই সেখানে শুধু ইট, বালু, সিমেন্ট, লোহা, টিন থাকে না– চেষ্টা করি, সামর্থ্য অনুযায়ী একটি সুন্দর, পরিপাটি বাড়ি যেখানে জানালা দিয়ে আলো-বাতাস আসবে, আরামদায়ক সময়ের জন্য চেয়ার-টেবিল, বিছানা থাকবে, দেয়ালজুড়ে রং থাকবে, ঘর সাজানোর টুকিটাকি থাকবে, টবে গাছ থাকবে, সব মিলিয়ে অনেক কিছু। কল্পনা করুন, একটি বাড়ি যেখানে জানালা নেই, আলো-বাতাস নেই, ফার্নিচার নেই, ঘরের শোভা বাড়ানোর কিছুই নেই– সেটি কি বাড়ি মনে হবে, নাকি কারাগারের ঘর? সেই বাড়িতে কি আপনি থাকবেন? সেই বাড়িতে আপনার সন্তান তার শৈশব, কৈশোরের আনন্দের সময় কাটাবে সে রকম কি আপনি চাইবেন? এত কথা বললাম শুধু বোঝানোর জন্য– বাস করার জন্য একটি সুন্দর বাড়ি শুধু ইট-পাথরের কাঠামো দিয়ে হয় না, সেখানে ভালোভাবে থাকতে হলে আরও কিছু জরুরি আনুষঙ্গিকের প্রয়োজন।

আজকের এই নতুন বাংলাদেশে সব ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি উঠে আসছে; কিন্তু হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করছি, সেই গতানুগতিক ধারায় মানসিক স্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করার প্রবণতা– ইটপাথর হলেই চলবে, আলো বাতাসের মধ্যে মনের শান্তি নিয়ে বেঁচে থাকাটা জরুরি না। স্বাস্থ্যের পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞায় মানসিক স্বাস্থ্য একটি অপরিহার্য উপাদান, যাকে বাদ দিয়ে কখনোই একটি জাতি সুস্থ বাক্তিত্বসম্পন্ন, কর্মক্ষম, দেশ ও সমাজের জন্য সঠিক সেবা আর নেতৃত্ব দানকারী প্রজন্ম তৈরি করতে বারবারই ধাক্কা খাবে। মানসিকভাবে সুস্থ থাকাটা একটি দেশের সব বয়সী মানুষের জন্য কতটা জরুরি তা আমাদের নীতিনির্ধারকরা কখনোই বুঝতে চাযন না বা বুঝলেও সেইভাবে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০১৮-১৯ এর জরিপের তথ্য থেকে ধারণা করা যায়, দেশে বর্তমানে তিন কোটিরও বেশি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন। তার মানে এই হিসাব অনুযায়ী, প্রায় তিন লাখ মানুষের জন্য মাত্র একজন মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী দেশে আছেন। 

সাতক্ষীরা থেকে ফোন পেয়েছি জনৈক নারীর, তাঁর স্বামী গুরুতর মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। সমস্যার বর্ণনা শুনে বুঝেছি, জরুরি মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন, মনোচিকিৎসকের কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন নিতে হবে। বলেছি– খুলনায় হাসপাতালে নিয়ে ডাক্তার দেখানোর জন্য। কিন্তু তিনি অপারগ, অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে এতদূর যেতে পারবেন না, কীভাবে সাহায্য করব তা নিয়ে আমরা অসহায় বোধ করি। কারণ, সাতক্ষীরাতে নিয়মিত মানসিক চিকিৎসা দেওয়ার মতো কেউ তখন ছিল না, এখনও খুব সম্ভবত নেই। এ রকম প্রায় প্রতিদিনই ফোন পাই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসহায় মানুষের, যারা বুঝতে পারছেন নিজের বা পরিবারের কারও মানসিক সমস্যা হয়েছে। তারা জানতে চায়– কোথায় গেলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাবেন। আমরা খুঁজে পাই না, তাদের কোথায় যেতে বলব। সবার পক্ষে ঢাকায় বা বিভাগীয় শহরের হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয় না।

জরিপে উঠে আসা সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য হচ্ছে, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে এমন মানুষের ৯০ শতাংশেরও বেশি চিকিৎসার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের কাছে যাচ্ছে না। তারা হয় সমস্যা গোপন রাখছেন, কোনোভাবে ম্যানেজ করে চলছেন; আর নয়তো অবৈজ্ঞানিক ঝাড়ফুঁক চিকিৎসকদের কাছে যাচ্ছেন। এর পেছনের কারণ কী জানতে চাইলে অনেকেই বলবেন, মানসিক সমস্যা নিয়ে স্টিগমা বা ট্যাবুর কথা। তবে আমি মনে করি, এটি আংশিকভাবে ঠিক হলেও মূল সমস্যা হলো, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে চরম অবহেলা ও উপেক্ষা। দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য খাতে পুরো বাজেটে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ আছে মাত্র ১ শতাংশেরও নিচে। বিষয়টি অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। এসডিজি ৩ নম্বর লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা। এই সেবা সহজলভ্য করে গণমানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। এত অপর্যাপ্ত বাজেট নিয়ে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা আকাশকুসুম কল্পনা করার মতোই।

গত সরকারের সময়কালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই সেবা নিয়ে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে, ঘুনে ধরা পাগলামি আইন-১৯১২ বাতিল করে মানসিক স্বাস্থ্য আইন-২০১৮ হয়েছে, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যনীতি-২০১৯ হয়েছে, এমনকি একটি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মপরিকল্পনা ২০২০-২০৩০ তৈরি হয়েছে। দুঃখজনক হলো– এতসব কর্মপরিকল্পনার বেশির ভাগ শুধু কাগজে-কলমেই আছে। খুব কমই দৃশ্যমান। যেটুকু আছে, সেটির প্রচারও ঠিকমতো হয়নি। কারণ, বাজেট নেই। অর্থাৎ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কিন্তু সেই গতানুগতিক অবহেলা আর উপেক্ষার চক্রেই পড়ে আছে। দেশের প্রতিটি জেলা/সদর হাসপাতালে একটি মানসিক স্বাস্থ্য কর্নার চালু করার জন্য অনেক বলার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অল্প কিছু হাসপাতালে সে রকম কিছু করার চেষ্টা করেছে; যদিও সেখানে গেলে সেবা এখন আর পাওয়া যায় না, কারণ সেবা দেওয়ার মতো মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়নি। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অবশ্য জেলা শহরের হাসপাতালগুলোতে ধাপে ধাপে মোট ৩৫টি শিশু বিকাশকেন্দ্র স্থাপন করেছে, যেখানে সব বয়সী শিশু-কিশোরকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য শিশু মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেখানে নিয়োজিত মনোবিজ্ঞানীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে, সেবা দিয়ে, সেবাগ্রহীতার মন জয় করে নিয়েছেন। যে কারণে সেবা নেওয়ার চাহিদাও দিনে দিনে বাড়ছিল। সম্প্রতি শুনতে পাচ্ছি, এই শিশু বিকাশকেন্দ্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, কারণ এই প্রজেক্টের অর্থায়ন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। সেখানে যারা সেবা দিচ্ছেন তারা গত তিন মাস বেতন পায়নি এবং আগামীতে বেতন পাবেন কিনা বা তাদের চাকরি থাকবে কিনা সেটি তারা এখনও জানেন না। 

এবারের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগান করা হয়েছে ‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব নিশ্চিত করার এখনই সময়’। নতুন বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি সব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ওপর গুরুত্ব দেওয়ারও এখনই সময়। 
মানসিক স্বাস্থ্যহীনতা শুধু মানসিক রোগ তৈরি করে না, নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত, অপরাধ আর দুর্নীতিমনস্ক জনগোষ্ঠী তৈরিতেও ভূমিকা রাখে; যার উদাহরণ আমরা আজকে চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত না করে আমাদের সম্ভাবনাময় শিশু-কিশোরদের মোবাইল/ইন্টারনেট নির্ভরতা আর মাদকের প্রতি ঝুঁকে পড়ার জন্য দায়ী করার আগে ভেবে নেওয়া দরকার– আমাদের দায় কতখানি।

টবের ফুল গাছ ঘরের ভেতর ছায়ায় রেখে দিয়ে সেখানে যতই পানি ঢালুন আর যত্ন করুন, সেখানে ফুল ফোটানো দুঃসাধ্য। আশা করি, আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্যের সংস্কার ও উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা নীতিনির্ধারকরা আর যারা কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিয়োজিত আছেন, তারা বিষয়টা মাথায় রাখবেন।
লেখক: অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

আরও পড়ুন

×