থামছে না গণপরিবহনে হয়রানি

সকাল-বিকাল অফিস বা স্কুলের সময়ে অনেক ক্ষেত্রে নারী যাত্রীকে বাসে উঠতে বাধা দেওয়া হয়
শেখ ফাতিমা পাপিয়া
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৪ | ২৩:৪৪ | আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৪ | ১২:০৮
ঢাকা শহরে চলাচলের প্রধান বাহন বাস। নারীরা বাসেই সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হন। গণপরিবহনে নারী যাত্রীর বড় একটি অংশ চাকরিজীবী এবং স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির জরিপ অনুযায়ী, মোট ৩৬ শতাংশ কর্মজীবী নারীর ৮০ ভাগই গণপরিবহনে যাতায়াত করেন এবং তারা অধিকাংশ সময়ে হয়রানির মুখোমুখি হন।
পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কর্মক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন; কিন্তু সকাল-বিকাল অফিস বা স্কুলের সময়ে অনেক ক্ষেত্রে নারী যাত্রীকে বাসে উঠতে বাধা দেওয়া হয়। গণপরিবহনে নারীর সঙ্গে বৈষম্যপূর্ণ আচরণ নতুন কিছু নয়। আজকের দিনে যেখানে সব প্রতিযোগিতামূলক জায়গায় নারীরা অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছে, সেখানে গণপরিবহনে বৈষম্য ও হয়রানিতে কোনো পরিবর্তন নেই।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দেশের গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।’
রাইদা বাস মালিক সমিতির একজন হেল্পার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, ‘সিট না থাকলে মহিলা যাত্রীদের উঠাই না। তারা একজন দাঁড়িয়ে গেলে আমার পাঁচজন যাত্রী নষ্ট হয়। তা ছাড়া একটু টাচ লাগলে মহিলারা চিল্লান, এতে গ্যাঞ্জাম হয়। তাই মহিলাগোর জন্য আলাদা বাস করলেই ভালো হয়।’ সংরক্ষিত আসনের ব্যাপারে জানতে চাইলে মিডলাইন পরিবহনের লাইন ম্যানেজার জানান, বাসের দরজার পাশের ৬টি সিট প্রতিবন্ধী, শিশু ও নারীর জন্য সংরক্ষিত। এ ছাড়া যদি আসন ফাঁকা থাকে, তাহলে নারীরা বসতে পারেন। বাকি সিটগুলো সবার জন্য বরাদ্দ। আগে উঠলে আগে বসবেন। তবে পুরুষ যাত্রীরা সহনশীল হলে তারা সিট ছেড়ে দেন।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সাথী আক্তার। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সংরক্ষিত আসন জিনিসটা কী; এটা চালক, সহকারী এবং সাধারণ পুরুষ যাত্রীদের জানানো ও বোঝানো উচিত। ওরা ভাবে ৪২টি আসনের মাত্র ৬টি মহিলা সিট আর বাকিগুলো পুরুষ সিট। সাধারণ সিটে মহিলারা বসলে মাঝেমাঝে আপত্তিজনক কথা বলে।’
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী স্মৃতি আক্তার ও রহিমা আক্তার মৌয়ের মতে, সংরক্ষিত আসন মানে ইঞ্জিন কাভারের ওপর আসন নয়। গাড়ির দরজার পাশে সিট ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। গাড়িতে ভিড় থাকলে পুরুষ উঠতে পারবে, নারী উঠতে পারবে না– এমনটা হতে পারে না। পাশের সিটে বসা আরও কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী জানান, যৌন হয়রানি ও হেনস্তা থেকে রেহাই পেতে নারীর জন্য আলাদা পরিবহন ব্যবস্থা একটা ভালো সমাধান। এ ব্যবস্থা সরকারিভাবে গ্রহণ করতে হবে এবং সব রুটে পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকতে হবে।
বাসে পুরুষ যাত্রী ও হেলপারদের থেকে নারীকে প্রায়ই কটূক্তি শুনতে হয়– ‘সমান অধিকার চান, তাহলে কেন সংরক্ষিত আসন?’ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে নারীর জন্য সংরক্ষিত কোনো আসন ব্যবস্থা থাকে না। তবে শিশু, বৃদ্ধ ও শারীরিক অক্ষমদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকে। সেখানে নারী সংরক্ষিত আসন না থাকার কারণ– নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে না। কিন্তু আমাদের দেশে নিরাপত্তাহীনতা একটা বড় বিষয়, যে কারণে নারী সব সময়, সবখানে চলাফেরা করতে পারে না। বাসে যাত্রীর ভিড়ের মধ্যে নারী যৌন হয়রানির শিকার হন বেশি। নারীকে অযাচিত স্পর্শ, শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বা ভিড়ের মধ্যে নারীর পোশাক কেটে বিকৃত সুখ খুঁজে পান অনেকে। এভাবে নারীর মানসিক মনোবল ভেঙে যায়, তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।
আমাদের দেশে যাত্রীর তুলনায় পর্যাপ্ত গণপরিবহন নেই। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। পরিবহন খাতের এ অব্যবস্থাপনা নারীকে আরও পিছিয়ে দিচ্ছে। তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব হয়রানি নারীর আত্মনির্ভরশীলতার সঙ্গে আত্মবিশ্বাসী হওয়ার পথে এক বড় অন্তরায়।