উপকূলীয় অঞ্চলে বাড়ছে বাল্যবিয়ে

ফাইল ছবি
সাজিদা ইসলাম পারুল
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:২৪ | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ১২:২২
‘কেউই নিজের মেয়ের খারাপ চায় না। আমাদের এলাকায় থাকতি কষ্ট, পানিতে কষ্ট। খাওনের পানি কিনি খাওয়া যায়, ব্যবহারের পানি তো কেনা সম্ভব না। শারীরিক নানা সমস্যাও হয়। তাই মেয়েগুলোর তাড়াতাড়ি বিয়ে দিই। পরে যেন সমস্যায় পড়তি না হয়।’ কথাগুলো বলছিলেন সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবন উপকূলবর্তী বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের নীলডুমুরিয়া গ্রামের আঞ্জুমান আরা নামের এক অভিভাবক। শুধু আঞ্জুমান আরাই নন, এ অঞ্চলের বেশির ভাগ অভিভাবকের মুখে একই সুর। তারা মনে করেন, এখানকার পানিতে লবণ অনেক বেশি। লবণপানি ব্যবহার করার জন্য গায়ের রং কালো হয়ে যায়। অল্প বয়সেই চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে।
সাতক্ষীরার আলীপুর আজিজিয়া দাখিল মাদ্রাসায় চলতি বছর দশম শ্রেণিতে একজন মেয়েও নেই। অথচ এ ব্যাচটি যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ছিল, তখন শ্রেণিকক্ষে ২৪ জন মেয়ে ছিল। একই এলাকার আরেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাহমুদপুর গার্লস কলেজিয়েট স্কুলের দশম শ্রেণিতে বর্তমানে ১০ জন ছাত্রী রয়েছে। অথচ এ ব্যাচটি যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ছিল, তখন ছাত্রীসংখ্যা ছিল ৪২ জন। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে এ অঞ্চলে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই কন্যাশিশুরা লেখাপড়া থেকে ছিটকে পড়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে পড়ে মেয়ে শিক্ষার্থীশূন্য।
স্থানীয় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটির সদস্য শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘স্কুলগুলোয় ছাত্রী ঝরে পড়ার এ হার দেখেই বোঝা যায়, এখানে বাল্যবিয়ে কতটা প্রকট। লবণাক্ততার কারণে বেশির ভাগ অভিভাবক বয়স হওয়ার আগেই মেয়েকে বিয়ে দেন। এ ছাড়া শারীরিক জটিলতাও তৈরি হয়। যেমন দীর্ঘ সময় ধরে মাসিক চলার কারণে অপুষ্টিহীনতায় ভোগে অনেকেই। গাইনি সমস্যাও দেখা দেয়।’
বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটির তথ্য অনুযায়ী, সাতক্ষীরা জেলায় মেয়েদের বাল্যবিয়ের হার ৭০ শতাংশের বেশি। জেলার ১২টি উপজেলায় নারী ও শিশুদের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করে বেসরকারি সংস্থা ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স। সংস্থাটির পরিকল্পনা কর্মসূচি পরিচালক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘২০১৯-২০ সালে আমরা এ এলাকায় একটি সার্ভে করি। এতে দেখা যায়, বর্ষা থেকে শীতের আগ পর্যন্ত পাঁচ-ছয় মাস এলাকার মানুষের কর্মের সুযোগ কমে যায়। লবণাক্ততাসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে অভিভাবকরা তখন তাদের সন্তানদের কম বয়সে বিয়ে দেন।’
নকল ভলিউম বইয়ে বাল্যবিয়ে
বাল্যবিয়েপ্রবণ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নকল ভলিউম বইয়ের মাধ্যমে বিয়ে দেওয়া হয়। প্রাপ্তবয়স্ক না হলে সেই খাতায় ছেলে ও মেয়ের তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়। উচ্চহারে নিবন্ধন ফিও নেওয়া হয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ছেলেমেয়ের বিয়ে দিলেও সেটি আইনসম্মতভাবে রেজিস্ট্রি হয় না।
মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল সায়মার (ছদ্মনাম)। বর্তমানে তাঁর বয়স ১৯ বছর। তিনি জানান, বিয়ের পরপরই যৌতুকের জন্য স্বামী চাপ দিতে থাকেন। দু’দফায় তাঁকে ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আরও টাকা চান। যৌতুক দিতে না পারায় চলে শারীরিক নির্যাতন। তাই তাঁকে তালাক দেন তিনি। প্রমাণ না থাকায় দেনমোহর ও ভরণপোষণের কিছুই পাননি সায়েমা।
লবণাক্ততায় প্রজনন স্বাস্থ্যের ঝুঁকি
আগরদাঁড়ী ইউনিয়নের আবাদেরহাট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী স্বপ্না (ছদ্মনাম), পৌরসভার বাটকেখালী গ্রামের ১৩ বছর বয়সী জুই (ছদ্মনাম), বৈচনা গ্রামের পল্লীশ্রী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী লামিয়া বাল্যবিয়ের শিকার হতে যাচ্ছিল। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের কর্মীরা জেলা প্রশাসন, উপজেলা জেলা প্রশাসন, জেলা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটির লোকজন তাদের বিয়ে ঠেকাতে সক্ষম হন। ওই সময় তাদের পরিবারকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, এই বয়সে বিয়ে না করে তাদের একটা কিছু হতে হবে। এখন তারা পড়াশোনাও করছে ভালোভাবে।
তবে মাসিকের সময় স্বপ্না ও জুঁইয়ের পেটে ব্যথা হয়, জরায়ুর মুখে জ্বালাপোড়া করে। সাতক্ষীরার সদর উপজেলার ফিংড়ী, আগরদাঁড়ী ও আলিপুর ইউনিয়ন; শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনীর নীলডুমুর গ্রাম, পইকখালীর সাহেবখালীর অনেক কিশোরীই জানায় এমন কথা। উপকূলীয় এ অঞ্চলে সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রমের কারণে কোথাও কোথাও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব হলেও, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সৃষ্ট শারীরিক সমস্যা থেকে মুক্তি নেই তাদের। এসব এলাকার মধ্য বয়সী নারীরাও জানান প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যার কথা। উপকূলীয় এলাকায় অল্প বয়সেই প্রজনন ক্ষমতা হারানো, গর্ভপাত, উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভকালীন খিঁচুনি আর অপরিণত শিশু জন্ম আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার তথ্য উঠে আসে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের গবেষণায়।
জানা যায়, শুষ্ক মৌসুমে নারী ও কিশোরীদের একটা বড় অংশ চিংড়ি ঘেরে কাজ করে। সকাল সাড়ে ৬টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত লবণাক্ত পানিতে থাকে। ফলে তাদের জরায়ুর সমস্যা দেখা দেয়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে তারা পানির অভাবে দূর থেকে মিষ্টি পানি সংগ্রহ করে। এ সময় পানি কম খায়, পরিচ্ছন্নতার জন্য লবণাক্ত পানি ব্যবহার করে। বাল্যবিয়ের প্রবণতা ও কারণ জানতে গত বছর অক্টোবর মাসে ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচি ২৭টি জেলার প্রায় ৫০ হাজার খানায় জরিপ চালিয়েছে। যেখানে দেশের ৬০ শতাংশের বেশি পরিবারে বাল্যবিয়ে হওয়ার চর্চা রয়েছে বলে উঠে এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে, গত পাঁচ বছরে এসব পরিবারের যেসব মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা পুত্রবধূ হিসেবে যারা এসেছে তাদের ৬০ শতাংশেরও বেশি মেয়ের বিয়ের বয়স ১৮ বছরের কম ছিল।
জরিপের তথ্য বলছে, এসব জেলায় ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ মেয়ে ১৮ বছরের আগেই বাল্যবিয়ের শিকার হয়। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে পিরোজপুর, সেখানে বাল্যবিয়ের হার ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ। গবেষণায় বলা হয়েছে, বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েদের ৬ দশমিক ৯ শতাংশের বয়স ১৫ বছরের নিচে।
নারী ও শিশুর মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের প্রোগ্রাম ম্যানেজার শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলে বাল্যবিয়ের হার বাড়ার অন্যতম কারণ দারিদ্র্য। অর্থনৈতিক দুর্দশা অনেক পরিবারকে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিতে বাধ্য করে, যাতে পরিবারের খরচ কমানো যায়। এ ছাড়া এখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বেশি থাকে; কাজের সন্ধানে পরিবারের অভিভাবক বছরের দীর্ঘ একটি সময় অন্যত্র গমন করেন, যা পরিবারের মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কারণ। তাই মেয়েদের দ্রুত বিয়ে দিয়ে নিরাপদ করার চেষ্টা করা হয়। ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স শিশু সুরক্ষা নীতিমালা তৈরিসহ সরকারি দপ্তরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কমিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তি, ক্যাম্পেইন, পথনাটক, খেলা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা ও অনুষ্ঠান আয়োজন করছে নিয়মিত। শিশুদের উন্নয়নকল্পে শিশু সুরক্ষা নেটওয়ার্ক গঠন করা হয়েছে।’
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘বাল্যবিয়ে মেয়েদের জীবন বিকশিত হতে বাধাগ্রস্ত করে। অভিভাবকদের দায়িত্ব সন্তানদের বিকশিত হতে সাহায্য করা।’
- বিষয় :
- বাল্যবিবাহ
- বাল্যবিয়ে
- নারী
- নারী ও শিশু নির্যাতন