ভোগান্তি পেরিয়ে স্বস্তির দেখা
নাগরিক ভোগান্তি নিয়ে নিজের মতপ্রকাশের একটি মাধ্যম ‘আমিও জিততে চাই’
তাহসিন রেজা
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:০৭ | আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১১:০৯
ছোট্ট মেয়ে রূপকথা। বয়স মাত্র পাঁচ। রূপকথার সমবয়সীরা স্কুলে যায়। তাদের দেখে রূপকথাও স্কুলে যেতে চায়। তার মা তাসনিয়া বেগম ঘরেই মেয়েকে অক্ষরজ্ঞান দিয়েছেন। এখন স্কুলে ভর্তি করাতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এজন্য চাই জন্মনিবন্ধন সনদ। রাজধানীর পান্থপথ এলাকার বাসিন্দা তাসনিয়া মেয়ের জন্মনিবন্ধন করতে যান সিটি করপোরেশনে। তাঁকে জানানো হয়, মেয়ের জন্মনিবন্ধন করার আগে বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন করাতে হবে।
তাসনিয়া ভেবেছিলেন, তিনি ও তাঁর স্বামীর জন্মনিবন্ধন করা সহজ হবে। কিন্তু বিষয়টি বেশ জটিল হয়ে ওঠে তাঁর জন্য। ঢাকায় তাসনিয়ার বাবার নামে ফ্ল্যাট আছে, সে কারণে তিনি শেষ পর্যন্ত ঢাকার ঠিকানায় জন্মনিবন্ধন করতে পেরেছেন। কিন্তু তাঁর স্বামীর জন্মনিবন্ধন করতে হয় গ্রামের ঠিকানায়। তাসনিয়াকে মেয়ে রূপকথার জন্মনিবন্ধনেও গ্রামের ঠিকানা দিতে বলা হয়েছিল। তিনি রাজি হননি। এরপর পরিচিত একজনের সহায়তায় কাজটা করেছেন। ততদিনে এক জন্মনিবন্ধনের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে চলে গেছে দুই মাস। তাঁর মতে, জন্মনিবন্ধনের প্রক্রিয়া আরও সহজ করা উচিত।
রূপকথার স্কুল ছুটির আগে অন্য অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসে বিষয়টি। এ সময় এক অভিভাবক বলেন, তারা এসব ভোগান্তির কথা জানাতে পারেন ‘আমিও জিততে চাই ডট কম’ ওয়েবসাইটে। সেখানে অনেকেই তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলেন। তাসনিয়া কিছুটা দ্বিধা নিয়ে জানান, তাঁর মতো সাধারণ গৃহিণীর কথা কে শুনবে? অন্য অভিভাবকরা তাঁকে সাহস দেন। তাসনিয়া ওয়েবসাইটটি ভিজিট করেন। সেখানে চোখে পড়ে অসংখ্য মানুষের ভোগান্তির কথা। নিরাপত্তাহীনতা, ভোটাধিকার, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো নিয়ে লিখছেন অনেকেই। এতদিন তারা নিজেদের ভোগান্তির কথা বলার প্ল্যাটফর্ম পাননি।
তাসনিয়ার মতোই একজন সাধারণ গৃহিণী আকলিমা খাতুন। স্বামীর মৃত্যুর পর পেনশনের জন্য মৃত্যুসনদ আনতে গিয়েছিলেন। তখন সিটি করপোরেশন থেকে জানানো হয়, তাঁর দেওয়া জন্মনিবন্ধন চলবে না। নতুন করে বানাতে হবে। বাধ্য হয়ে মৃত স্বামীর জন্মনিবন্ধন করেছিলেন তিনি। শুধু তাসনিয়া বা আকলিমা নন; জন্মনিবন্ধন নিয়ে ভোগান্তির শিকার হননি– এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। এসব ভোগান্তির কিছুটা ওয়েবসাইটে চোখে পড়ে তাসনিয়ার। বাংলাদেশে প্রায় ১৮ রকমের নাগরিক সেবার জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্সের মতো অতিগুরুত্বপূর্ণ সেবা।
ইউএসএইডের স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ (এসপিএল) প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত ওই ওয়েবসাইট থেকে তাসনিয়া বুঝতে পারেন, তাঁর মতো ভোগান্তির শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা কম নয়। সরকার নির্ধারিত ফি থাকলেও অনেকক্ষেত্রে অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে নাগরিকদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো টাকা নেওয়া হচ্ছে বা দিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। ওয়েবসাইটটিতে রেজিস্ট্রেশন করার প্রক্রিয়াও সহজ। তাসনিয়াও নিজের কষ্টগুলো লিখে পোস্ট করেন। তিনি জানান, অন্য শিশুদের মতো তাঁর মেয়ে রূপকথারও স্কুল ড্রেস পরে ক্লাসে যাওয়ার বায়নার কথা। কিন্তু জন্মনিবন্ধনের ভোগান্তির কারণে মেয়েকে স্কুলে দেওয়ার আনন্দ পাননি তিনি।
তাসনিয়া আরও যোগ করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় অনেক সময় পরীক্ষার ফল বা পড়ালেখা নিয়ে চাপ সৃষ্টি করা হয়, এতে সন্তানদের মূল্যবোধ তৈরির বিষয়টি কম গুরুত্ব পায়। প্রতিটি পোস্টে ছবি ও ভিডিও যুক্ত করার সুবিধা থাকায় তাসনিয়া অভিভাবকদের ওয়েটিং রুম নিয়ে একটি ভিডিও ধারণ করেন। এতে তাদের সংকট আরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। অন্য ব্যবহারকারীরা তাঁর এসব পোস্টে মন্তব্য করেন এবং বিষয়টি সমাধানের পরামর্শও দেন।
‘আমিও জিততে চাই’ বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তনের পথে একটি বড় পদক্ষেপ। এই প্ল্যাটফর্মের লক্ষ্য দেশের প্রান্তিক জনগণের কথা শোনা এবং প্রশাসনের নজরে আনা। এই ওয়েবসাইটের প্রতিটি পোস্টে উল্লেখ করা সমস্যাগুলো পৌঁছে যাবে নীতিনির্ধারকদের কাছে।