ঢাকা রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫

৩ ডিসেম্বর– বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস

বিকশিত ভবিষ্যতে এগিয়ে চলা

বিকশিত ভবিষ্যতে এগিয়ে চলা

অলংকরণ :: বোরহান আজাদ

শাহেরীন আরাফাত

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:০৯ | আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১১:১৬

আমাদের সমাজে আজও প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে বিভ্রান্তি ও ছুৎমার্গ রয়েছে। ‘প্রতিবন্ধী’ শব্দটিই যেন এক বৈষম্যের প্রতিধ্বনি! তবে এটি শুধু শব্দগত বিষয় নয়। অন্য শব্দ ব্যবহৃত হলেও সমাজে বিদ্যমান নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সেই শব্দকেও নেতিবাচক করে তুলবে। এই নেতিবাচকতা কার্যত সমাজের একটি বড় অংশকে জনবিচ্ছিন্ন রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অথচ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে না পারলে আমাদের সমাজে প্রকৃত গণতান্ত্রিক উত্তরণ সম্ভব হবে না। প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের সঙ্গে জাতীয় উন্নয়ন যুক্ত। প্রতিবন্ধীদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হলে তারা জাতীয় উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতায় প্রভূত অবদান রাখতে পারবেন।

রাজধানীর উত্তরার আশকোনা এলাকায় থাকেন ওসমান খান (৩২)। ছোটবেলায় ওষুধের বিষক্রিয়ায় হারিয়েছেন হাঁটাচলার শক্তি। তবে দমে যাননি। এইচএসসি পাসের পর তিনি কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন মোবাইল ফোন রিপেয়ারের দোকান দিয়েছেন। কষ্টে হলেও তিনি কারও দয়াদাক্ষিণ্য না নিয়ে সংসার চালাতে পারছেন। এজন্য তাঁর মা-বাবা বেশ গর্ব অনুভব করেন।

ফিরোজ মিয়ার (৫৩) বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর উপজেলায়, সুলতানপুর গ্রামে। প্রায় ১০ বছর আগে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর শরীরের এক পাশে কম বল পান। তবে লাঠিতে ভর করে চলতে পারেন। নিজের কাজটুকু করতে পারেন। তখন তিনি কাপড়ের ব্যবসা করতেন। সদরে দোকান ছিল তাঁর। অসুস্থ হয়ে সব বিক্রি করতে হয়েছে। তবে জীবনে চলার পথে হার মানেননি। সংসার চালানো জন্য মুদি দোকান দেন মূল সড়কের পাশে। সেখান থেকে যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চালান। ফিরোজ জানান, তিনি দুর্বলতা সহকারেই নিজে কিছু করতে চেয়েছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাননি। পরে এ নিয়ে আর চেষ্টাও করেননি।  

হাবিবুর রহমানের (৪৩) বাড়ি যশোরের কেশবপুর উপজেলার মূলগ্রাম সানাপাড়ায়। ২০০৯ সালের শেষ দিকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পথে কুমিল্লায় একটি ট্রাক অপর একটি ট্রাকের পেছনে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে ট্রাকচালকের সহকারী হাবিবুর রহমানের একটি পা থেঁতলে যায়। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর বাঁ পা কেটে ফেলতে হয়। চিকিৎসা শেষে বাড়িতে ফিরে ব্যাটারিচালিত ভ্যান চালানো শুরু করেন। তিনি বলেন, যত কষ্টই হোক, কখনও কারও কাছে হাত পাতবেন না।

এই স্বাধীনচেতা মানুষগুলোই প্রকৃত বাংলাদেশের চিত্র। শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধকতার জন্য প্রায়ই তাদের মূলধারার বাইরে মনে করা হয়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাদের খুব সামান্যই যুক্ত করা হয়। অথচ তাদের সংযুক্তিতে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাপক পরিসরে বাড়ানো সম্ভব। এজন্য দরকার যথাযথ প্রশিক্ষণ ও কর্মক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক পরিবেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক সমীক্ষা থেকে জানা যায় বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক বৃহৎ অংশ বিভিন্ন প্রতিবন্ধিতার শিকার, যার পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মতে, দেশে প্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তির সংখ্যা ৩০ লাখ। বর্তমানে তাদের মধ্যে ২৩ লাখ ব্যক্তি ৮৫০ টাকা করে ভাতা পান।

দেশে দীর্ঘদিন ধরে ‘বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস’ পালন করা হয়; কিন্তু এর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। প্রায় এক যুগ আগে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ; কিন্তু এতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিশেষ করে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে, তাদের মধ্যে অনেকে মানবেতর অবস্থায় রয়েছেন।

প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা গ্রহণের হার আগের চেয়ে বাড়লেও চাকরির বাজারে অনেকেই যোগ্যতা অনুযায়ী টিকে থাকতে পারছেন না। দেশের সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপযোগী পরিবেশ ও ন্যায্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছিল ২০১৩ সালে করা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে। আইনে ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার কথা বলা হয়েছে– অটিজম, শারীরিক, মানসিক, দৃষ্টি, বাক, বুদ্ধি, শ্রবণ, শ্রবণ-দৃষ্টি, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা ও অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা। যদিও স্কুলগুলোতে সেই ব্যবস্থা করা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সাধারণ স্কুলগুলোতে ভর্তিই নেওয়া হয় না।

সম্প্রতি বাংলাদেশ বিজনেস অ্যান্ড ডিজঅ্যাবিলিটি নেটওয়ার্কের (বিবিডিএন) ট্রাস্টি মনসুর আহমেদ চৌধুরী এক গোলটেবিল বৈঠকে বলেন, ‘৫০ বছর আগে সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারিনি। আমাকে একটি মাত্র কারণে চাকরি দেওয়া হয়নি, তা হচ্ছে আমি চোখে দেখি না, আমি নাকি শ্রেণিকক্ষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। এটিই হচ্ছে একটি অজুহাত। অথচ আমি সেই সুদূর নরওয়ের থমসন ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছি। আমি নিজের দেশে সে সুযোগ পাইনি।’ 

দেশের প্রতিবন্ধী জনগণের সার্বিক উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের জনগণ, সংশ্লিষ্ট সব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তাই একজন প্রতিবন্ধী মানুষকে কেবল প্রতিবন্ধী হিসেবে অনুগ্রহ নয়, দিতে হবে মানুষ হিসেবে যথাযোগ্য সম্মান। 

বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাসের (বি-স্ক্যান) সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব বলেন, ‘আইন, নীতি, প্রশিক্ষণকেন্দ্র সবই আমাদের আছে। কিন্তু ঠিক সময়ে ঠিকঠাক তথ্য আমরা পাচ্ছি না। প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোয় প্রবেশগম্যতা ও উপযুক্ত শৌচাগারের ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া কর্মসংস্থান খাতে যারা কাজ করেন, তারা এখন পর্যন্ত প্রতিবন্ধকতা অনুযায়ী কাজের ধরন ও সুযোগের বিষয়টি নিয়ে ওয়াকিবহাল নন। এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক যোগাযোগের অভাবও রয়েছে। এসব বিষয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।’

আরও পড়ুন

×