বেগম রোকেয়ার সমাজ-ভাবনা
বেগম রোকেয়া [৯ ডিসেম্বর ১৮৮০-৯ ডিসেম্বর ১৯৩২]
শাহেরীন আরাফাত
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:২৮
সমাজে নারীমুক্তির পথে যারা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, তারা অবশ্যই স্মরণীয়। তাদেরই একজন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। ৯ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন এবং প্রয়াণ দিবস। ১৮৮০ সালে জন্মকালে এ অগ্রসর চিন্তার মানুষটির নাম ছিল রোকেয়া খাতুন। পরবর্তী সময়ে তিনি ‘বেগম রোকেয়া’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ৯ ডিসেম্বরকে ‘রোকেয়া দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়।
১৮ বছর বয়সে ১৮৯৮ সালে রোকেয়ার বিয়ে হয় বিহারের ভাগলপুর নিবাসী উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট; তদুপরি সমাজসচেতন, কুসংস্কারমুক্ত এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন। স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় রোকেয়া দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান এবং ক্রমেই ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। রোকেয়ার নারীমুক্তির পথে অগ্রণী ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে এ মানুষটির অবদান অনস্বীকার্য। রোকেয়া ১৯০২ সাল থেকে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। ১৯০৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয় রোকেয়ার প্রথম গ্রন্থ মতিচূর (প্রথম খণ্ড)। ১৯০৯ সালে সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যু হয়। বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’, যা ১৯৩০ সালে হাইস্কুলে পরিণত হয়।
বেগম রোকেয়ার চিন্তা শুধু সামাজিক কাজের মধ্য দিয়েই বোঝা সম্ভব নয়; বরং তা বুঝতে হলে তাঁর লেখার বিশ্লেষণ জরুরি। ‘সুলতানার স্বপ্ন’, ‘অবরোধ-বাসিনী’, ‘পদ্মরাগ’ এবং ‘মতিচূর’-এর মতো গ্রন্থে তিনি তাঁর সমাজ-ভাবনা তুলে ধরেছেন।
‘সুলতানার স্বপ্ন’ গ্রন্থে রোকেয়া যে নারীস্থানের চিন্তা তুলে ধরেছেন; ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসে সেই চিন্তা আরও অগ্রসর ও বাস্তবিক হয়ে তারিণী-ভবনের রূপ লাভ করে। সেখানে নানা ধর্ম-বর্ণের নির্যাতিত, নিপীড়িত নারীদের ঠাঁই হয়েছে। সেখানে তিনি এক মুক্ত নারী-জীবনের চিত্র তুলে ধরেছেন। উপন্যাসটি ১৯২৪ সালে প্রকাশিত। এটিতে তিনি নিজের সমাজ-ভাবনা আরও দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করেছেন।
‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র পদ্মরাগ ওরফে আয়েশা সিদ্দিকা বিয়ে-পরবর্তী করুণ নির্মমতার শিকার। তারিণী-ভবনে প্রধান কর্মীদের মধ্যে চারুবালা, সৌদামিনী, হেলেন, জাফরি, রাফিয়া, সাকিনা, রসিকা, ঊষা প্রমুখরাও স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতা বা নির্দয়তার শিকার।
সিদ্দিকা গভীরভাবে ভালো বেসেছিল ব্যারিস্টার লতিফ আলমাসকে; কিন্তু সমাজের প্রচলিত রীতিনীতিতে আবদ্ধ হয়ে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। তারিণী-ভবন সংসারের চিত্র নয়, সংসার থেকে পালানো মেয়েদের ছবি। চরিত্রদের স্মৃতিচারণায় যে সংসার চিত্র পাওয়া যায় তার মধ্যে প্রচলিত ধর্মীয় আচার-বিচার বা রান্না খাওয়ার কথা নেই। তার বদলে রয়েছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের জটিলতার কথা। তারিণী-ভবন এমন এক জায়গা, যেখানে নেই ধর্মীয় বিধিনিষেধ। আয়েশা সিদ্দিকা এক নতুন নারী; কিন্তু তাঁর সংসারত্যাগের সিদ্ধান্ত তৎকালীন ভদ্রমহিলাদের বিশ্বাসের বিপরীতে এক ভিন্ন চরিত্র।
‘তারিণী-ভবন’ কার্যত বেগম রোকেয়ার কল্পনা নয়। তাঁর জীবনের আদর্শ– অভিজ্ঞতা ও আত্মোপলব্ধির বিকশিত রূপ’। সে জন্যই আদর্শ, শিক্ষা ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে তিনি যে আলোচনা তুলে ধরেছেন, তা নিখুঁত ও সুন্দর। ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসটি লেখকের নিজ জীবনের অপূর্ণতা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। দীনতারিণী ও পদ্মরাগ– প্রধান চরিত্র দুটির মাধ্যমে এর প্রকাশ ঘটে। দীনতারিণী ব্রাহ্ম; কিন্তু তাঁর আশ্রম এবং বিদ্যালয় হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান– সবার জন্যই উন্মুক্ত। আশ্রম ও বিদ্যালয়ের কর্মীরা কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, কেউ বা খ্রিষ্টান। বাস্তবে রোকেয়া যে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ তৈরি করতে পারেননি তাঁর সাখাওয়াত মেমোরিয়ালে, তারিণী-ভবনে তিনি তা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর অসাম্প্রদায়িক চিন্তাই এতে ফুটে উঠেছে।
সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার যে বাড়বাড়ন্ত; নারীর কাজ, পোশাক থেকে শুরু করে টিপ পরা নিয়ে পর্যন্ত যে আগ্রাসী মনোভাব, নারীবিদ্বেষী চেতনা– এটি এক দিনে তৈরি হয়নি। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এ বিষবৃক্ষ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে নারী অধিকারে সংগ্রামী অর্জনগুলো মুছে ফেলা হচ্ছে। বিগত সরকারের আমলের কথিত উন্নয়নের জোয়ারে নারীর ক্ষমতায়ন ছিল কেবলই শো-অফ। অথচ রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেছে। সব ধারার রাজনীতিতে একই চিত্র। তবে কথিত মূলধারার মিডিয়ায় এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় খুব সামান্যই।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণই এটিকে সফল করেছে। কারণ সমাজে অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে বাইরে রেখে কোনো গণআন্দোলন সফল হতে পারে না। অথচ গণঅভ্যুত্থানের পর নারীকে সেভাবে দেখা যাচ্ছে না গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিতে। এর পেছনেও রয়েছে সমাজে বিদ্যমান প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ পুরুষতান্ত্রিক চেতনা।
এমন এক সমাজে নারীকে ঘরের বাইরে আসার, স্বাবলম্বী হওয়ার, ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতা ও পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দিচ্ছেন বেগম রোকেয়া। তাই নারীর শিক্ষা ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এই সমাজ সংস্কারক আজ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। v
- বিষয় :
- বেগম রোকেয়া