ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

পরিবেশবান্ধব চামড়াশিল্পের স্বপ্ন

পরিবেশবান্ধব চামড়াশিল্পের স্বপ্ন

তাসলিমা মিজি

আফরোজা চৈতী

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২২:৫০ | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১১:০২

বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতে ৬০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা। তবে এ নারী উদ্যোক্তা বেশির ভাগ কাজ করছেন খাবার, কাপড় বা গহনা নিয়ে। তাদের মধ্যে তাসলিমা মিজির গল্পটা একটু অন্যরকম। তিনি প্রচলিত পণ্য ও বিষয়ের বাইরে বেছে নিয়েছিলেন ভীষণ চ্যালেঞ্জিং একটি ক্ষেত্র। সেটি হলো চামড়াজাত পণ্য ও হস্তশিল্প।

একটি ফেসবুক পেজ খুলে যাত্রা শুরু করেছিলেন তাসলিমা মিজি। তাঁর সেই ছোট্ট ‘গুটিপা’ আজ গুটি গুটি পায়ে নাম লিখিয়েছে দেশের চামড়াশিল্প ব্যবসায়। ২০১৬ সালে তাঁর ‘লেদারিনা’ কোম্পানির যাত্রা শুরু। চামড়াশিল্প একটি অপ্রচলিত খাত। এ খাতে নারী ব্যবসায়ীদের পদচারণা নিতান্তই নগণ্য। এর কারণ হিসেবে মিজি জানান, ট্যানারি থেকে চামড়া সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করার পুরো বিষয়টি এত বেশি ঝক্কির যে, নারীকে সেই খাতে কাজ করাটা বেশ কষ্টকর। তবে তাসলিমা মিজি জানান, সবাই যে পথে হাঁটেন তিনি সে পথে হাঁটতে পছন্দ করেন না। তাই এই ভিন্ন খাত বেছে নিয়েছেন।

তাসলিমা মিজি বলেন, ‘সাহস ও ধৈর্য– এই দুটো বিষয় একজন উদ্যোক্তা হতে গেলে সবচেয়ে জরুরি।’ তাসলিমা মিজি আজ এক সাহসের নাম, এক অনুপ্রেরণার নাম। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডের সপ্তক স্কয়ারে রয়েছে ‘গুটিপা’র ঝাঁ চকচকে শোরুম। সেখানে চোখ ধাঁধানো ডিজাইনের সব ব্যাগ আর জুতা চামড়াশিল্পে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার জানান দেয়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তাসলিমা মিজির পণ্য এখন রপ্তানি হচ্ছে কানাডা, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্রে। 

খুব অল্প পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তাসলিমা মিজি। ফেসবুক পেজে নিজের ডিজাইনের পণ্য পোস্ট করতে থাকেন। পণ্যের মান ও বৈচিত্র্যময় ডিজাইনের কারণে খুব কম সময়ে গুটিপা ক্রেতার কাছে একটি আস্থার জায়গা তৈরি করে নেয়। সমাজের বাধা, পারিবারিক প্রতিকূলতা অথবা সমাজের চোখ রাঙানি কিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি তাঁকে। তাসলিমা মিজি বলেন, ‘যখন আপনি স্বপ্নপূরণের পথে হাঁটবেন, তখন আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি আপনি নিজে, আপনি নিজে যখন আপনার হাতটা ধরবেন তখন যত বাধা আসুক, আপনি সেই বাধা পার করতে পারবেন।’ 

তাসলিমা মিজি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন।  কর্মজীবন শুরু হয় সাংবাদিকতা দিয়ে। সেই পেশা থেকে পরবর্তী সময়ে একজন ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। করোনাকালে স্বাস্থ্যসেবার অতিপ্রয়োজনীয় ফেসমাস্ক, পিপিই ও হেডকভার তৈরির মাধ্যমে ব্যবসা টিকিয়ে রাখেন।

আন্তর্জাতিক বাজারে নতুন কী কী চামড়া পণ্য আসছে, সেগুলোয় কী প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে– এসব নিয়ে গবেষণার জন্য গুটিপার রয়েছে নিজস্ব টিম। তাসলিমা মিজি সরকারি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সাভারে তাঁর কারখানার ৫০ জন কর্মীর মধ্যে ৬০ শতাংশই নারী। তাসলিমা মিজি চামড়াশিল্প নিয়ে কাজ করলেও ব্যক্তিগতভাবে তিনি একজন পরিবেশবাদী। যিনি মনে করেন চামড়াশিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি রক্ষা করতে হবে আমাদের নদী ও পরিবেশকে। এটি তাঁর একার পক্ষে সম্ভব নয়। বরং এ কাজটিতে এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকে।

এ প্রসঙ্গে তাসলিমা মিজি বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেক ট্যানারি আছে, যেগুলো পরিবেশবান্ধব নয়। অনেক ট্যানারিতেই বর্জ্য পরিশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিশোধনাগার বা ইটিপি নেই।  ইটিপি থাকলেও তা ব্যবহার করা হচ্ছে না। হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো আগে বুড়িগঙ্গা দূষণ করত, এখন সাভারের ট্যানারি থেকে আসা পানিতে দূষিত হচ্ছে শীতলক্ষ্যা। ফলে নদীদূষণের যে চক্র শুরু হয়েছিল, এ ট্যানারি শিল্প থেকে সেটি এখনও চলমান। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে বিদেশি ক্রেতার কাছে সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে এ পরিবেশ দূষণের বিষয়টি; যা আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়াশিল্পজাত পণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করছে। ডিজাইন, দাম, মান– সবকিছুতে বাংলাদেশি পণ্য এগিয়ে থাকলেও, শুধু পরিবেশগত কারণে বিদেশি ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চামড়াশিল্পের রয়েছে উজ্জ্বল সম্ভাবনা। গার্মেন্টসের মতোই বাংলাদেশের আরেক সম্ভাবনাময় খাত চামড়া খাত।’ অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব চামড়াশিল্প গড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখেন তাসলিমা মিজি।

আরও পড়ুন

×