প্রতি ছয় শিশুর মধ্যে একজনের বাস যুদ্ধাঞ্চলে
গাজার খান ইউনিসে সমুদ্রতীরে একটি শিবিরে আগুনের পাশে বসে আছে রেদা আবু জারাদার নাতি-নাতনিরা ছবি: আবদেল করিম হানা, এপি
শাহেরীন আরাফাত
প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ | ২১:৫৮ | আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ | ১২:৫০
সংঘাতের কারণে আগের চেয়েও বেশি শিশু জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হয়েছে। জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের মতে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪৭৩ মিলিয়ন অর্থাৎ প্রতি ছয় শিশুর মধ্যে একজন যুদ্ধের বীভৎসতার মুখোমুখি। গাজা, সুদান এবং ইউক্রেনের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে তাদের বাস। গত ২৮ ডিসেম্বর ইউনিসেফ এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানায়।
বিশেষ করে গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন ও হত্যাযজ্ঞে গত ১৫ মাসে অন্তত ১৭ হাজার ৪৯২ শিশু নিহত হয়েছে; গাজার বেশির ভাগ অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথেরিন রাসেল বলেন, ‘প্রায় প্রতিটি দিক বিবেচনায় ২০২৪ সাল ইউনিসেফের ইতিহাসে যুদ্ধ আক্রান্ত শিশুর জন্য রেকর্ডের বছর। ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা এবং তাদের জীবনের ওপর এর প্রভাবের মাত্রা– উভয় দিক থেকেই এটি সবচেয়ে খারাপ বছরগুলোর মধ্যে একটি।’ রাসেলের মতে, সংঘাতহীন জায়গায় বসবাসকারী শিশুর তুলনায় সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে বেড়ে ওঠা একটি শিশুর স্কুলের বাইরে থাকা, অপুষ্টিতে ভোগা বা বাস্তুচ্যুতির আশঙ্কা অনেক বেশি। ক্যাথেরিন রাসেল আরও বলেন, ‘এটি অবশ্যই নিউ নরমাল বা নতুন স্বাভাবিক ঘটনা নয়। আমরা শিশুদের একটি প্রজন্মকে বিশ্বের অনিয়ন্ত্রিত যুদ্ধের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে দিতে পারি না।’
যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় বসবাসকারী শিশুদের অনুপাত দ্বিগুণ হয়েছে ১৯৯০-এর দশকে, যেখানে ১০ শতাংশ শিশু যুদ্ধের ভয়াবহতার সম্মুখীন ছিল; আজ সেই সংখ্যা প্রায় ১৯ শতাংশে পৌঁছেছে। ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ সংঘাত ও সহিংসতার কারণে ৪৭ দশমিক ২ মিলিয়ন শিশু বাস্তুচ্যুত হয়। ২০২৪ সালে যুদ্ধের তীব্রতা আরও বেড়েছে, যা বাস্তুচ্যুতি আরও বাড়ার ইঙ্গিত দেয়। কারণ হাইতি, লেবানন, মিয়ানমার, ফিলিস্তিন, সুদানসহ ইউক্রেনে সংঘাত তীব্র হয়েছে।
সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল থেকে জাতিসংঘ ২২ হাজার ৫৫৭ শিশুর বিরুদ্ধে রেকর্ড ৩২ হাজার ৯৯০টি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যাচাই করেছে, যা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নির্দেশিত পর্যবেক্ষণ শুরু হওয়ার পর থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যা। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যা সামগ্রিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী। গত বছর গাজা এবং ইউক্রেনে হাজার হাজার শিশু নিহত এবং আহত হয়েছে। তাই এ সংখ্যা আরও বাড়বে। শিশুর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা বেড়েছে, তাদের শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, শিশুর অপুষ্টির হার বেড়েছে এবং সশস্ত্র সংঘাত শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ। ক্যাথেরিন রাসেল বলেন, ‘বিশ্ব এ শিশুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০২৫ সালে অবশ্যই পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে, শিশুর জীবন বাঁচাতে এবং উন্নত করতে আরও অনেক কিছু করার আছে আমাদের।’
গবেষণা সংস্থা অক্সফাম সেপ্টেম্বরে এক প্রতিবেদনে জানায়, গাজায় যেখানে ইসরায়েলি বাহিনী গত এক বছরে সাম্প্রতিক যে কোনো সংঘাতের তুলনায় বেশি নারী ও শিশুকে হত্যা করেছে, সেখানে চলমান যুদ্ধ শিশুদের জন্য একটি ‘দুঃস্বপ্ন’। ইউনিসেফের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ রোজালিয়া বোলেন বলেন, ‘গাজার শিশুরা শীত ও অসুস্থতায় আক্রান্ত এবং মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত। গাজার প্রায় ৯৬ শতাংশ নারী ও শিশু তাদের মৌলিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে পারে না।’ তিনি উপত্যকার শিশুদের কাছে সাহায্য পৌঁছাতে সক্ষম না হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
তিনি আরও বলেন, ‘মানবতাবাদীদের জন্য গাজা অবশ্যই পৃথিবীর সবচেয়ে হৃদয়বিদারক স্থানগুলোর মধ্যে একটি। এখানে একটি শিশুর জীবন বাঁচানোর প্রতিটি ছোট প্রচেষ্টা ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের দ্বারা ব্যর্থ হয়। ১৪ মাসেরও বেশি সময় ধরে শিশুরা এই দুঃস্বপ্নের প্রান্তে রয়েছে।’
বোলেনের মতে, ‘উপত্যকার বেশির ভাগ শিশুর শীতের পোশাক নেই। তাদের আবর্জনা থেকে খাবার খুঁজে খেতে হয়। যে কারণে অনেকেই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এই যুদ্ধ আমাদের সবাইকে তাড়া দিচ্ছে। গাজার শিশুদের সময় ফুরিয়ে আসছে।’ তিনি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে আহত শিশু এবং তাদের মা-বাবাকে গাজা ছেড়ে পূর্ব জেরুজালেম বা অন্য কোথাও চিকিৎসাসেবা নিতে উৎসাহিত করার আহ্বান জানান।
- বিষয় :
- শিশু
- গাজা
- ইসরায়েলি আগ্রাসন
- গণহত্যা