এক হাতের জীবন সংগ্রাম
![এক হাতের জীবন সংগ্রাম এক হাতের জীবন সংগ্রাম](https://samakal.com/media/imgAll/2025January/shefali-1736659861.jpg)
নিজের দোকানে শেফালী আক্তার শিলা
ইমতিয়াজ আহমেদ
প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ | ২২:০০ | আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২৫ | ১১:৩১
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলা, টাঙ্গাইলের ঘাটাইল এবং মধুপুর সীমানার মধ্যবর্তী গারো বাজার। কয়েকশ বছরের এ বাজারের আদি বাসিন্দা গারো সম্প্রদায়। সময়ের বিবর্তনে তাদের অনেকেই এই হাট থেকে বিদায় নিয়েছেন। এসেছেন নতুন নতুন ব্যবসায়ী। তৈরি হয়েছে রাস্তাঘাট। ব্যবসার ব্যাপ্তি বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি। গারো বাজার বাসস্ট্যান্ডের ঠিক পাশেই ভাঙাচোরা একটা ছাপড়ার নিচে শেফালির হোটেল।
পাশ থেকে একজন বললেন, ‘রতন, তাম্বুল হেনা পাতি, কালা বাবা দিয়া একটা পান দেন।’ সবই সুগন্ধি জর্দার নাম। একটি কচি সবুজ পানপাতা তাঁর বাম হাতের তালুতে মেলে রাখেন। প্রথমে অবশ্য টের পাওয়া যায়নি, পরে বোঝা গেল তাঁর ডান হাতের পাঁচটা আঙুল কাটা। এক হাতেই কোনো রকমে পানটা খিলি করে তুলে দিলেন লোকটির হাতে।
পুরো নাম শেফালী আক্তার শিলা। নিজের দোকানে এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘আমি গরিব ঘরের মেয়ে। ছোটবেলায় তিন বেলা তো দূরের কথা দুই বেলাও খাওন জুটত না ঘরে। কোনো কোনো দিন আব্বায় হাটে গেছে সদাই করতে, আমরা বইয়া আছি যে আব্বা কামের টাকা লইয়া চাইল-ডাইল, তরকারি কিনা আনব। তারপর আব্বা আইতো হেই মাঝরাইতে, হাট শেষে কম দামে আধা নষ্ট তরকারি কিনা নিয়া আইত। তারপর সদাই আনলে মায়ের রান্ধন শেষে আমগোরে ঘুম থেইকা ডাইকা তুইলা খাওয়াইত। মেলা দিন উপাস থাকছি খাওন না থাহায়। স্কুলে বেশি দিন যাইতে পারি নাই। বছরে ঈদের সময় একটা পিরান পাইতাম, তারপর যহন একটু বড় হইলাম, দেখলাম গ্রামের আমার বয়সী মেয়েরা ঢাকায় গার্মেন্টসে ভর্তি হওয়ন শুরু করল। সংসারের অভাব দেইখা আমিও গার্মেন্টসে চইলা গেলাম। প্রথম আমি শহর দেখলাম, এত এত মানুষ, এত যন্ত্রপাতি!’
সংগ্রামী এ নারী আরও বলেন, ‘মাস শেষে যা বেতন পাই, তার অর্ধেক টাকা বাড়িতে পাঠায়া দিতাম। ভালোই চলতেছিল দিনকাল; হঠাৎ একদিন কাটিংয়ের কাজ করতে যাইয়া আচমকাই আমার ডান হাতের সবগুলা আঙুল ফালা হয়া গেল। কাটা আঙুলগুলা অহনো চোখে ভাসে। এহনও বিশ্বাস হয় না আমার হাতের পাঁচটা আঙুল নাই।’
গার্মেন্টস জীবন শেষে শেফালী ফিরে আসেন বাড়িতে। বয়স্ক বাবা-মায়ের তখন চিন্তার শেষ নেই। আঙুল কাটা পড়া এই মেয়ের বিয়ে কীভাবে হবে; এজন্য উঠেপড়ে লাগেন বাবা-মা। শেষে এক রিকশাচালকের সঙ্গে বিয়ে হয় শেফালীর। স্বামীর ঘরে অভাব; ঘর নেই, চাল-চুলা নেই। দুই সন্তানের মা হওয়ার পর দেখেন, সারাদিন কাজ করেও সংসার চলে না। রিকশা চালানো কষ্টের কাজ, স্বামী এক দিন ভালো তো আরেক দিন অসুস্থ। পরে তিনি বাবার বাড়ি চলে আসেন। গারোর বাজারে বাসস্ট্যান্ডেসংলগ্ন একটা খালি জায়গায় এলাকার গণ্যমান্য লোকজনকে বলে একটা ছাপরা তোলেন। সেখানে স্বামী-স্ত্রী মিলে দেন ভাতের হোটেল।
তাতেও কী আর শান্তি মিলে? বাম হাত দিয়ে খাবার বানানো, রান্না করা অনেকে পছন্দ করেন না। শেফালী বলেন, ‘লোকজন আমার দোকানে আসা ছাইড়া দিল, ভাবছিলাম হোটেলটা ছাইড়া দিব। তারপর বাসস্ট্যান্ডের সব ড্রাইভার ভাইয়েরা মিলে আমার হোটেলে খাওন শুরু করল। ভাত খায়, চা-পান খায়, কোনোভাবে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াইলাম। এখনও দূরের যাত্রীরা বাম হাতের চা-পান বানানো দেখে চলে যায়। কী আর করব? কপালে যা আছে, তাই তো পামু। তবে কিছু মানুষ অহনো আছে, যারা আমার এইখানে নিয়মিত খাইতে আসে। সংসারের খরচ বাড়ছে। জামাই-বউ মিলা যা পাই, কোনোমতে কষ্ট করে চলে সংসার। তয় ব্যবসাটা বড় করতে পারলে আরেকটু ভালোভাবে চলতে পারতাম। জীবনের কোনো স্বপ্নইতো পূরণ হলো না; ব্যবসা কইরা পোলাপানগুলারে মানুষ করার আশা করি।’
হোটেলের নিয়মিত ক্রেতা বাসচালক হামিদ মিয়া বলেন, ‘এই দোকানের সবচেয়ে মজার খাবার গরুর মাংস আর ভর্তা। আমরা প্রতিদিন দুইবার এই হোটেলে খাবার খাই। রান্না খুব সুস্বাদু।’
হোটেল চালাতে শেফালীকে সহযোগিতা করেন স্বামী সুমন মিয়া। বেশির ভাগ সময় খাবার পরিবেশন করে দেন তিনি নিজেই। বিয়ের পর প্রায় ১৫ বছরে টানাপোড়েনের এ সংসারে বাদানুবাদ হয়েছে অনেকবার; কিন্তু শেফালীর পাশেই থেকেছেন সুমন মিয়া। অনেকটা আবেগতাড়িত হয়ে তিনি বলেন, ‘বাবা বিয়া করানোর সময় আমারে কইছিল গরিব মানুষ, কোনো দিন কষ্ট দিস না, খেদাই দিস না। আমি রিকশা চালাই সব সাধ আহ্লাদ পূরণ করতে পারি না। পোলাপানগুলা মাদ্রাসায় পড়ে। ভালো খাওন-পিন্দন দিতে পারি না। হোটেলটা একটু বড় করতে পারলে আরেকটু ভালো থাকতাম।’
সকালের সূর্যটা এখন মাথার ওপর। হোটেল থেকে ডাক শোনা যাচ্ছে শেফালীর। মামা আসেন খেয়ে যান। কেউ যায়, আবার কেউ ফিরেও তাকায় না। এরই মধ্যে শেফালী তাঁর স্বপ্ন বুনে যান একটু একটু করে। একদিন এই হোটেলটা বড় হবে। ভরা থাকবে কাস্টমারে। হরেক রকমের মাছ, মাংস, ভর্তা, ভাজি থাকবে। সবাই এক নামে চিনবে ‘শেফালীর হোটেল’। এটাই শেফালীদের স্বপ্ন।