ঢাকা শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

সুদিনের আশায় বছর পার বিনিয়ােগকারীদের

সুদিনের আশায় বছর পার বিনিয়ােগকারীদের

.

আনোয়ার ইব্রাহীম 

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০০:০১ | আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১৩:১৩

এক বছর আগে শেয়ারবাজারের অবস্থা যেমন ছিল, বিদায়ের ক্ষণে এসে সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। বিনিয়োগকারীরা সুদিনের আশায় বছর পার করে দিয়েছেন। এ বাজারের সঙ্গে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী যুক্ত। তাদের একটি বড় অংশ বিনিয়োগ করে আটকে গেছে। নিকট ভবিষ্যতে শেয়ারবাজারের উন্নতি হবে– এমন আশাও করছেন না অনেকে। 

ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের রক্ষার নামে করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর সময় ২০২০ সালের মার্চে প্রথম সব শেয়ারের দরে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। মাঝে তুলে নিলেও ২০২২ সালের জুলাই শেষে ফের তা ফিরিয়ে আনে। এ রক্ষাকবচই বিনিয়োগকারীদের ‘গলার কাঁটা’ হয়ে বিঁধে আছে। কারণ বেশির ভাগ শেয়ার ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন দরে আটকে রয়েছে। প্রয়োজনে লোকসান দিয়ে হলেও নতুন বছরে যে কোনো প্রক্রিয়ায় শেয়ার বিক্রি করে আটকে থাকা বিনিয়োগ ফিরে পাওয়ার আশা করছেন বিনিয়োগকারী অনেকে। কেন তা বুঝতে বিদায়ী বছরের শেয়ারবাজার লেনদেনের কিছু পরিসংখ্যানে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
২০২৩ সালে মোট ২৪৪ কার্যদিবসে শেয়ার লেনদেন হয়। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসইতে কেনাবেচা হওয়া শেয়ারের মূল্য ছিল ১ লাখ ৪১ হাজার ৬০ কোটি টাকা।  দৈনিক গড়ে কেনাবেচা হয়েছে ৫৭৮ কোটি টাকার শেয়ার। গড় লেনদেন ২০২২ সালের তুলনায় ৩৭৮ কোটি টাকা বা প্রায় ৪০ শতাংশ কম। ২০২২ সালে ২৪৪ কার্যদিবসে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা লেনদেন হয়। দৈনিক গড়ে ৯৫৭ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়েছিল ওই বছর।  ফ্লোর প্রাইসই ছিল শেয়ার লেনদেন কমার কারণ। এই ফাঁদে আটকে গেছে গ্রামীণফোন, স্কয়ার ফার্মা, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ব্র্যাক ব্যাংকসহ দেশের শেয়ারের প্রায় সব ভালো মৌল ভিত্তির শেয়ার। 

গত বৃহস্পতিবার বছরের শেষ দিনের লেনদেন শেষের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে,  তালিকাভুক্ত ৩৯২ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ২২৩টি ফ্লোর প্রাইসে আটকে ছিল, যা মোটের প্রায় ৫৭ শতাংশ। আরও ৪৫ কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসের তুলনায় সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ বেশি দরে কেনাবেচা হয়েছিল। এসব শেয়ার এক দিন ফ্লোর প্রাইস ছাড়ছে তো, পরের দিন আবার নামছে। শতাংশের বিচারে তালিকাভুক্ত ৫৭ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারের ক্রেতা নেই বা লেনদেন হচ্ছে না।  শুধু এ তথ্য দিয়ে বাজারের পুরো করুণ চিত্র বোঝা যাবে না। পরিস্থিতি বুঝতে চোখ বোলাতে হবে ফ্লোর প্রাইসে থাকা কোম্পানিগুলোর ফ্রি-ফ্লোট শেয়ারের দিকে। গত বৃহস্পতিবার তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে উদ্যোক্তা, পরিচালক এবং সরকারের শেয়ার বাদে অন্যদের মোট বিনিয়োগ মূল্য ছিল ১ লাখ ৭২ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফ্লোর প্রাইসে পড়ে থাকা ২২৩ কোম্পানির সব ফ্রি-ফ্লোট শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ১ লাখ ২২ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ, বিনিয়োগকারীদের প্রতি ১০০ টাকা বিনিয়োগ মূল্যের প্রায় ৭১ টাকার বিনিয়োগ ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এসব শেয়ারের ক্রেতা নেই। প্রয়োজনের সময় কিছুটা মুনাফাসহ বেশি মূল্যে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে যে বিনিয়োগ করেছেন লাখো মানুষ, তাদের বিনিয়োগ এখন কাগুজে হিসাব ছাড়া কিছু নয়।

শেয়ারের বিনিয়োগকারীদের একটা অংশ অতি প্রয়োজনে শেয়ার বিক্রির আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তাদের মুক্তি দিতে নয়, লেনদেন বাড়িয়ে দেখাতে ফ্লোর প্রাইসের তুলনায় ১০ শতাংশ কমে ব্লক মার্কেটে শেয়ার কেনাবেচার সুযোগ করেছিল বিএসইসি। পরিস্থিতি এমনই, ওই দরেও ক্রেতা মিলছে না। এ অবস্থায় ফ্লোর প্রাইসের তুলনায় ১০ শতাংশ কমে শেয়ার বিক্রির পর পকেট থেকে আরও কিছু টাকা নগদে দিয়ে শেয়ার বিক্রির ঘটনা ঘটছে শেয়ারবাজারে। বৃহস্পতিবার ফ্লোর প্রাইসে পড়ে থাকা ২২৩ কোম্পানির মাত্র ৫৬ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে, যা ছিল মোট লেনদেনের মাত্র সাড়ে ৮ শতাংশ। আবার এ লেনদেনের ৭০ শতাংশই ছিল ব্লক মার্কেটে। 

সূচকের নড়াচড়া থমকে গেছে

বিদায়ী বছরে ফ্লোর প্রাইসে আটকে থেকে প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স সর্বনিম্ন ৬১৭৮ পয়েন্ট থেকে সর্বোচ্চ ৬৩৬৭ পয়েন্টের মধ্যে ওঠানামা করেছে। বাজার মূলধনের ৭৬ শতাংশের বেশি শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকার কারণে এত কম সীমার মধ্যে সূচক আটকে গেছে। এ অবস্থা বাংলাদেশে আগে কখনোই হয়নি। বিশ্বের শেয়ারবাজারের এমন নজির নেই। 

প্রতিবেশী ভারতসহ অন্য দেশের কথা বাদ দিলেও অর্থনৈতিক সংকটে থাকা পাকিস্তানের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বছরের শুরুতে পাকিস্তানের শেয়ারবাজারের বেঞ্চমার্ক সূচকের যাত্রা শুরু করেছিল ৩৯ হাজার পয়েন্ট থেকে। বছরের শেষে এসে ইতিহাসের সর্বোচ্চ অবস্থান প্রায় ৬২ হাজার পয়েন্টে উঠেছে। 

আইপিও বাজারে খরা

শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মূলত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। বর্তমান কমিশনের (বিএসইসি) বিরুদ্ধে শেয়ার কারসাজি চক্র এবং স্বার্থান্বেষী মহলকে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। কারসাজি প্রমাণ হওয়ার পরও দোষীদের বিরুদ্ধে মুনাফার তুলনায় নামমাত্র আর্থিক জরিমানা করে দায়মুক্তির ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে এশিয়াটিক ফার্মা এবং বেস্ট হোল্ডিংস কোম্পানির আইপিও অনুমোদন। এশিয়াটিক ফার্মার আইপিও অনুমোদনের পর অভিযোগ ওঠে, আগেই কেনা জমিকে ভুয়া দলিলের মাধ্যমে নতুন করে কেনাবেচার মাধ্যমে বেশি দরে ক্রয় দেখিয়েছে কোম্পানিটি। এমন প্রতারণার কারণ ছিল আইপিওর আগে মালিকপক্ষের টাকা ছাড়াই কোটি কোটি শেয়ার নিজেদের নামে নেওয়া এবং প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির টাকা আত্মসাৎ করতে। এ ঘটনায় আইপিও স্থগিত করে তদন্ত করার বিষয়ে বিএসইসির সিদ্ধান্ত আশা জাগিয়েছিল। তবে অপরাধ প্রমাণ হওয়ার পরও পুরোনো ধারায় সামান্য কয়েক কোটি টাকা জরিমানা এবং প্রকাশিত প্রসপেক্টাসের এ সম্পর্কিত তথ্য সংশোধনের নির্দেশ দিয়ে ফের আইপিও অনুমোদন করে। এর পর বিতর্কিত বেস্ট হোল্ডিংস কোম্পানির আইপিও অনুমোদনের বিষয়টিও আলোচনায় ছিল শেয়ারবাজারে।

এশিয়াটিক ফার্মাসহ পুরো বছরে মাত্র পাঁচটি কোম্পানি আইপিও প্রক্রিয়ায় ২৫৭ কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহ করেছে, যা গত ১৫ বছরের সর্বনিম্ন। ২০২২ সালে আইপিও প্রক্রিয়ায় সাত কোম্পানি ১ হাজার ২১ কোটি টাকার মূলধন উত্তোলন করে। ২০২১ সালে ১০ কোম্পানি ১ হাজার ১৫১ কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহ করেছিল।

অনিশ্চয়তা কি কাটবে

শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ২০২১ সালের অক্টোবরে দরপতনের শুরু থেকে যে অনিশ্চতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা আরও দীর্ঘতর হতে পারে। রাজনৈতিক সংঘাত হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। ২০২৪ সালে সার্বিক অর্থনীতির অবস্থা কী দাঁড়ায় তার ওপরও অনেকটা নির্ভর করছে শেয়ারবাজার। অবশ্য নির্বাচনের পর অর্থনীতিতে নানা সংস্কার পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়েও কাজ করছে। শঙ্কা সত্ত্বেও সবার আশা থাকবে সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবে। সুদিন ফিরবে শেয়ারবাজারে।

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×