ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫

পোশাকের রপ্তানি আদেশ হারানোর শঙ্কা কতটা

পোশাকের রপ্তানি আদেশ  হারানোর শঙ্কা কতটা

আশিকুর রহমান তুহিন

আশিকুর রহমান তুহিন

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৪৯

চার দশকেরও বেশি সময়ের পরিক্রমায় তৈরি পোশাক শিল্প দেশের অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ হয়ে উঠেছে। ক্ষুদ্র মুদি দোকান থেকে আকাশপথের যোগাযোগসহ অর্থনীতির সব কর্মকাণ্ডেই গতি দিয়েছে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাতটি। জাতীয় রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশই এখন পোশাকের দখলে। ৪০  লাখ শ্রমিক এবং তাদের পরিবারসহ প্রায় দুই কোটি মানুষের রুটি-রুজি আসছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তবে এই চিত্র কিছুটা মলিন হতে বসেছে। নিয়মিত রপ্তানি আদেশের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ চলে যাচ্ছে প্রতিযোগী দেশের দখলে। 
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আমাদের পোশাক রপ্তানির চিত্র প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় আশাব্যঞ্জক নয়। গত অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ২২ দশমিক ৮০ শতাংশ। অন্যদিকে কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির (সিআইটিআই) তথ্য বলছে, মাসটিতে ভারতের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৩৫ শতাংশেরও বেশি। এই প্রবণতা গত কয়েক মাস ধরেই চলছে। 
গত জুলাই মাসে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বাড়ে ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। একই মাসে  পোশাক রপ্তানি ভারতের বাড়ে ১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং ভিয়েতনামের ১২ দশমিক ৪ শতাংশ। পরের মাসেও একই চিত্র। গত আগস্ট মাসে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ। অন্যদিকে একই মাসে ভিয়েতনাম ও ভারতের পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ ও ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। টানা চার মাসের এ প্রবণতায় একটি প্রশ্ন সামনে আসতেই পারে। তা হলো তৈরি পোশাকের রপ্তানি আদেশ কি প্রতিযোগী দেশে চলে যাচ্ছে?  
আমাদের প্রধান রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তৈরি পোশাক পণ্যের প্রায় ১৭-১৮ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে এবং প্রায় ৫০ শতাংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নে রপ্তানি হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই বাজারে আমাদের রপ্তানি কমেছে, যা উদ্বেগজনক।
যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে গত জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ১০ দশমিক ২৮ শতাংশ কমেছে। প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের রপ্তানি মাত্র ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ কমেছে। ভারতের রপ্তানি কমেছে ২ দশমিক ২৪ শতাংশ। এমন প্রবণতা বাংলাদেশের জন্য একটি অশনি সংকেত। বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিকারক শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে চীনের রপ্তানি কমেছে ৪ শতাংশ, পাকিস্তানের রপ্তানি কমেছে মাত্র দেড় শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং কম্বোডিয়ার ৬ শতাংশ। একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে গত জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমেছে সাড়ে ৩ শতাংশ। বিপরীতে কম্বোডিয়ার রপ্তানি বেড়েছে ১২ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং পাকিস্তানের ৭ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে।  
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে তাহলে কি আমাদের পোশাক খাতের ক্রয়াদেশ প্রতিযোগী দেশে চলে যাচ্ছে? সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রম অসন্তোষ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি এই খাতের উৎপাদন ও রপ্তানিতে বাধা সৃষ্টি করেছে। ফলে বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। যদিও বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবে অচিরেই আবার সে অরাজক পরিস্থিতি ফিরবে না সেই নিশ্চয়তা তো মিলছে না। ক্রেতাদের আস্থা ধরে রাখতে পোশাক খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।  সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শ্রমিক ও উদ্যোক্তাদের এ জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। ক্রেতাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, সামনের দিনগুলোতে আমাদের পোশাক শিল্পে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এই সময় আমাদের পোশাক শিল্পের জন্য সরকারি নীতি সহায়তা হ্রাস পাচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। অন্যদিকে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের শিল্পের জন্য নীতি সহায়তা বাড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত সরকার বস্ত্র ও পোশাক রপ্তানি দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রণোদনা দিচ্ছে। এতে তারা প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখা অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে আমাদের ব্যবসায়িক প্রক্রিয়াগুলো সহজতর করতে হবে। কাস্টমস, বন্দরে পণ্য জাহাজীকরণ, খালাসসহ আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা দূর করতে হবে। আমরা জানি, প্রক্রিয়ায় জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। পাশাপাশি রপ্তানিকারকরা সময়মতো পণ্য জাহাজীকরণ করতে না পারলে জরিমানা অথবা শিপমেন্ট বাতিল হওয়ার মতো শঙ্কা থাকে। তাছাড়া লিড টাইমের মধ্যে পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে অনেক সময় রপ্তানিকারকদের বিমানে পণ্য পরিবহন করতে হয়। এতে ব্যয় অনেকাংশে বেড়ে যায়। এটি আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুত  হলে লিড টাইম কমে যাবে। আমরা বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করছি। এ সময় বিশ্বে ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ নীতি বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য অনেক সুযোগ বয়ে আনতে পারে। 
লেখক: টেড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক 

আরও পড়ুন

×