ইস্পাত শিল্পে আধুনিক প্রযুক্তি
শূন্য থেকে শীর্ষে জিপিএইচ
ফাইল ছবি
সারোয়ার সুমন
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৪৭ | আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৬:৫৬
দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাংলাদেশের ইস্পাত যাচ্ছে এখন বিদেশেও। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, পরিবেশবান্ধব কারখানা ও দক্ষ জনবল ব্যবহার করে জিপিএইচ ইস্পাত এ শিল্পকে নিয়ে যাচ্ছে বিশ্বমানে। কোয়ান্টাম ইএএফ প্রযুক্তিসমৃদ্ধ কারখানা স্থাপন করে তারা পণ্য রপ্তানি করছে চীনেও। বিস্তারিত লিখেছেন সমকাল চট্টগ্রাম ব্যুরোর রিজিওনাল এডিটর সারোয়ার সুমন
রাজনৈতিক অস্থিরতা, কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, ব্যাংকে আমানতস্বল্পতা, ডলারের দামে ওঠানামা ও বৈশ্বিক যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল। এর মধ্যেও দেশে ইস্পাতের অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে বিশ্বমানের কারখানাও। জিপিএইচ গ্রুপ এমন এক প্রযুক্তির কারখানা গড়েছে, যেটি শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো এশিয়াতেই প্রথম। কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস অ্যান্ড উইনলিংক (ইএএফ) নামের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশে ইস্পাত উৎপাদন করছে শুধু তারা। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের দিক থেকে দেশে শীর্ষে আছে এখন জিপিএইচ ইস্পাত। অথচ শূন্য পুঁজি দিয়েই এ ব্যবসা শুরু করেছিল তারা চার দশক আগে। পুরোনো ইনডাকশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেই ব্যবসা শুরু হয় ২০০৮ সালে। যেটি লোহাজাত সামগ্রীকে গলাতে পারলেও বিশুদ্ধ করতে পারত না। নিশ্চিত করতে পারত না শতভাগ গুণগত মানও। এক যুগের ব্যবধানে সেই গ্রুপই এখন তৈরি করছে বিশ্বমানের ইস্পাত।
দেশে মাথাপিছু ইস্পাত খরচ ২০২০ সালে ছিল ৪৫ কেজি। ২০৩০ সালের আগেই এটি পৌঁছাতে পারে ১০০ কেজিতে। এ চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে জিপিএইচ। দেশে জিপিএইচ ইস্পাতই সর্বপ্রথম এনেছে অটোমেশন লেভেল ২.৫ ও ইন্ডাস্ট্রি লেভেল ৪.০ সমৃদ্ধ স্টেট অব আর্ট টেকনোলজি। সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড এবং ইন্টিগ্রেটেড এই ডিজিটাল শিল্প-প্রযুক্তি ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ নামেও পরিচিত। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী স্টিলের গুণগত মান নিশ্চিত করে কোয়ান্টাম প্রযুক্তির স্টিল প্রস্তুত করছে জিপিএইচ ইস্পাত। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরায় এশিয়ায় প্রথম কোয়ান্টাম ইএএফ প্রযুক্তিসমৃদ্ধ কারখানা স্থাপন করে তারা। আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত কোয়ান্টাম ইএএফ ইস্পাতশিল্পের সর্বাধুনিক ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। এটি ব্যবহারের লক্ষ্যে জিপিএইচ অস্ট্রিয়ার প্রাইমেটালস টেকনোলজিসের সঙ্গে ২০১৬ সালে চুক্তি করে। ২০১৮ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বসানো হয় নতুন প্রযুক্তির প্লান্ট। রডের পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু ২০২১ সালে। এ কোম্পানির বার্ষিক রড উৎপাদন সক্ষমতা এখন ১০ লাখ টন। জিপিএইচ কারখানায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুরোনো লোহা থেকে বিলেট তৈরি হয়ে সরাসরি রড ও রড জাতীয় পণ্য তৈরি হয়।
প্রযুক্তিতে শীর্ষে জিপিএইচ, উৎপাদনে বিএসআরএম : দেশে ইস্পাতশিল্পের গোড়াপত্তন হয় ১৯৫২ সালে। আকবর আলী আফ্রিকাওয়ালা ও তাঁর চার ভাইয়ের হাত ধরে চট্টগ্রামে যাত্রা শুরু করে এ শিল্প। তাদের প্রতিষ্ঠানই বর্তমানে বাংলাদেশ স্টিল রি রোলিং মিলস বা বিএসআরএম নামে সবচেয়ে বেশি রড উৎপাদন করছে। ২০২১ সালে এ শিল্পে নতুন পালক যুক্ত করে জিপিএইচ ইস্পাত। দেশে কেবল তারাই রড উৎপাদনে ব্যবহার করতে থাকে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি।
চাহিদার ৫৩ শতাংশ পূরণ করছে চট্টগ্রাম: মার্কেট ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড কনসাল্টিংয়ের প্ল্যাটফর্ম বিগমিন্টের তথ্য অনুসারে, সারাদেশে শতাধিক ইস্পাত কারখানা থাকলেও বর্তমানে মোট চাহিদার ৫৩ শতাংশ পূরণ করছে চট্টগ্রামের চারটি কারখানা। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো– বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম), আবুল খায়ের স্টিল (একেএস), জিপিএইচ ইস্পাত ও কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম)। এর মধ্যে বিএসআরএম দেশের চাহিদার প্রায় ২৫ শতাংশ, একেএস ১৪ শতাংশ, জিপিএইচ ৮ শতাংশ এবং কেএসআরএম ৬ শতাংশ উৎপাদন করছে। বিএসআরএমের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৪ লাখ টন। একেএসের ১৫ লাখ টন। জিপিএইচ ও কেএসআরএম বছরে প্রায় ৮ লাখ টন করে মোট ১৬ লাখ টন ইস্পাত উৎপাদন করতে পারে। এ ছাড়া চট্টগ্রামে বড় কারখানা আছে এইচএম স্টিল, গোল্ডেন ইস্পাত, এসএআরএম ও বায়েজিদ স্টিলের।
ভূমিকম্প সহনীয় উচ্চশক্তির রড: উন্নত দেশের স্থাপনায় ৬০০, ৭০০ এমনকি ৮০০ গ্রেডের উচ্চশক্তির রড ব্যবহার করা হয়। ইস্পাত খাতে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে আসায় দেশে একমাত্র জিপিএইচ ইস্পাত ৬০০ গ্রেডের এমন উচ্চশক্তির রড তৈরিতে সক্ষম হয়। কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসে তৈরি এ রডের দুটি গ্রেড সর্বপ্রথম বাংলাদেশে উৎপাদন করেছে জিপিএইচ। এর নাম দেওয়া হয়েছে জিপিএইচ কোয়ান্টাম বি৬০০ ডি-আর ও জিপিএইচ কোয়ান্টাম বি৬০০ সি-আর। এর বিশেষত্ব হলো, এগুলো ব্যবহার করে নির্মাণে ৫০০ গ্রেডের তুলনায় সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ এবং ৪২০ গ্রেডের তুলনায় সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ রডের পরিমাণ কমানো সম্ভব।
জিপিএইচের স্ক্র্যাপ প্রি-হিটিং প্রযুক্তি: যে প্রযুক্তির মাধ্যমে অফ গ্যাসের তাপ আহরণ করে স্ক্র্যাপ মেটালকে মেল্টিং ফার্নেসে ঢালার আগেই ৬০০ ডিগ্রির ওপরে উত্তপ্ত করা হয়, তাকে স্ক্র্যাপ প্রি-হিটিং বলে। বিশুদ্ধ ও স্টিল তৈরির পথে এটি প্রথম ধাপ। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের পাশাপাশি দূষণ থেকে পরিবেশকে রক্ষা করা যায়।
অপদ্রব্যমুক্ত গলিত ইস্পাত উৎপাদন: ইস্পাত সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে সম্পাদনের জন্য তিনটি কারিগরি দিক নিশ্চিত করা হয়। এগুলো হচ্ছে– পর্যাপ্ত পরিমাণ হট হিল বা গলিত ইস্পাত ফার্নেসে রেখে দেওয়া, সাইফোনিক প্রক্রিয়ায় গলিত ইস্পাত ট্যাপিং করা ও যতটা সম্ভব কম কাত করে ফার্নেস থেকে গলিত ইস্পাত সংগ্রহ। কনভেনশনাল আর্ক ফার্নেসে মাত্র ১০-১৫ শতাংশ হট হিল রাখা সম্ভব। কিন্তু কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেসে ৮০ টন গলিত ইস্পাত সংগ্রহের ক্ষেত্রে ৭০ টন বা প্রায় ৪৬ শতাংশ হট হিল মেটাল সংরক্ষণ করা হয়।
রাসায়নিকের সঠিক ব্যবহার: স্টিলের গুণগত মান সঠিকভাবে সমন্বয় করতে ফসফরাস ও সালফার যত কম লেভেলে রাখা যায়, ততই স্টিলের গুণাগুণ ভালো হয়। স্টিল তৈরির প্রকৌশলবিদ্যা অনুসারে ফসফরাসকে দূর করার জন্য ফার্নেসের ভেতরে পরিমিত মাত্রার ক্ষারীয়-অক্সিডাইজিং এনভায়রনমেন্ট নিশ্চিত করতে হয়। এই ক্ষারীয় পরিবেশ নিশ্চিত করতে টনপ্রতি ২০-২৫ কেজি লাইম ও ৩৫-৩৮ কেজি ডলোলাইম ব্যবহার করতে হয়। অক্সিডাইজিং পরিবেশ নিশ্চিত করতে টনপ্রতি ৩০-৩৫ কিউবিক মিটার অক্সিজেন ল্যান্সিং করতে হয়। আবার এই অক্সিডাইজিং পরিবেশ যাতে কম বা বেশি না হয়, তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য টনপ্রতি প্রায় ২০-২৫ কেজি কার্বন ইনজেক্ট করতে হয়। এসব প্রক্রিয়া সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যায় ইএএফ প্রযুক্তিতে।
বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারে দক্ষতা: সীতাকুণ্ডে মাটির নিচে অনেক গভীরে গিয়েও পানি পাচ্ছেন না শিল্প উদ্যোক্তারা। তাই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে জিপিএইচ। সীতাকুণ্ডে জিপিএইচ কারখানায় তৈরি হয়েছে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ও মাল্টিপারপাস ইউসেজ রিসার্চ প্রজেক্ট। প্রতিষ্ঠানটি পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা বৃষ্টির পানি বাঁধ দিয়ে সংরক্ষণ করে রড উৎপাদনে ব্যবহার করছে। ইস্পাত উৎপাদনে ব্যবহৃত পানি অপচয় না করে তা ফের ব্যবহারের উপযোগী করা হচ্ছে।
কোয়ালিটি কন্ট্রোল ও অ্যাসিওরেন্স সিস্টেম: জিপিএইচ ইস্পাত স্ক্র্যাপ, অ্যালয় ও এডিটিভস থেকে শুরু করে উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে দক্ষ জনবল এবং মেশিনারি দ্বারা মান নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। যেমন– অপটিক্যাল এমিশন স্পেক্টোমিটার দিয়ে উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে কেমিক্যাল কম্পোজিশন চেক করা হয়, ইউটিএম ও বেন্ড রিবেন্ড মেশিন দিয়ে মেকানিক্যাল প্রপার্টি চেক করা হয়। এক্স আর এফ মেশিন দিয়ে বিভিন্ন কনজুমেবলস, অ্যালয় ও এডিটিভসের গুণাগুণ পরীক্ষা করা হয়।
বাড়ছে রাজস্ব, বাড়ছে কর্মসংস্থানও: আধুনিক প্রযুক্তির কারখানা স্থাপন করে কর্মসংস্থান ও রাজস্ব দুটোই বাড়িয়েছে জিপিএইচ ইস্পাত। ২০০৮ সালে সনাতনী কারখানা স্থাপনের সময় তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেড় হাজার কর্মসংস্থান থাকলেও এখন সেটি হয়েছে ১০ হাজার। আগের তুলনায় এখন প্রায় ১৫ গুণ বেশি রাজস্ব দিচ্ছে তারা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিপিএইচ কর, ভ্যাট ও ফি হিসেবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ৫২০ কোটি টাকার বেশি জমা করেছে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিপিএইচ ইস্পাত সরকারকে রাজস্ব দিয়েছে ৬২২ কোটি টাকার বেশি। নীতিসহায়তা পেলে রাজস্ব ও কর্মসংস্থান ভবিষ্যতে দ্বিগুণ হবে বলে মনে করেন জিপিএইচ ইস্পাতের উদ্যোক্তারা।
- বিষয় :
- সমৃদ্ধি