ঢাকা রবিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

ভৈরব পাদুকা ক্লাস্টারে বছরে দুই হাজার কোটি টাকার বেচাকেনা

ভৈরব পাদুকা ক্লাস্টারে বছরে দুই হাজার কোটি টাকার বেচাকেনা

.

জসিম উদ্দিন বাদল

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ | ০০:০৮

স্বাধীনতার কয়েক বছর পরই কিশোরগঞ্জের ভৈরবে যাত্রা শুরু করে পাদুকা শিল্প। এ শিল্প গতি পায় নব্বই দশকের শুরুতে। সে গতিধারা অব্যাহত থাকায় জুতার শহর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে ভৈরব। গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় জুতার ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে। তিন দশকের বেশি সময় ধরে চলতে থাকা এ শিল্প পাল্টে দিয়েছে ভৈরবের অর্থনীতি। বছরে সেখানে বেচাকেনার পরিমাণ দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার।
স্থানীয়রা বলছেন, রাজধানী ঢাকা, বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে সড়ক, নৌ ও রেলপথ যোগাযোগের সুব্যবস্থা রয়েছে। মূলত ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সস্তা শ্রমের কারণে এখানে পাদুকাশিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটেছে। একসময় শুধু স্যান্ডেল তৈরি হলেও এখন এর পাশাপাশি লোফার, কেডসসহ বিভিন্ন ধরনের জুতা তৈরি হয়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে তা সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানিও করা হয়। এ শিল্পকে ঘিরে সেখানে অন্যান্য ব্যবসাও চাঙা হচ্ছে।
সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশনের আধুনিক প্রশিক্ষণ ও আর্থিক ঋণ সহায়তায় ভৈরবে পাদুকাশিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটছে বলে মনে করেন সেখানকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, এখানকার উদ্যোক্তারা ছোট। তাদের পুঁজি কম। কাঁচামালের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। ঋণের সুদও নাগালের বাইরে– ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ। এত বেশি সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
তাদের ভাষ্য, প্রশিক্ষণের জন্য একটি কমন ফ্যাসিলিটি সেন্টার (সিএফসি) স্থাপন করা দরকার; যেখান থেকে শ্রমিকরা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে উন্নত মানের জুতা তৈরি করতে পারবেন। এ ছাড়া স্বল্প সুদে ঋণসুবিধা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে এ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটতে পারে। দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানো তথা অর্থনীতির চাকা শক্তিশালী করতে যা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
সম্প্রতি সরেজমিনে ভৈরবে গিয়ে দেখা গেছে, গাড়ি থেকে নেমে যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই শত শত ছোট জুতার কারখানা। প্রতিটি কারখানায় চলছে  কর্মযজ্ঞ। কেউ চামড়া কাটছেন, কেউ সেলাই করছেন, আবার কেউ পেস্ট লাগাচ্ছেন। এসব কাজ কেউ করছেন হাতে, কেউবা মেশিনে। সব প্রক্রিয়া শেষে প্যাকেজিং হয়ে তা চলে যাচ্ছে বিভিন্ন জেলার ক্রয়াদেশ প্রদানকারীর কাছে। আবার কোনো কোনো কারখানার জুতা মালিকের নিজের দোকানেই বিক্রি হচ্ছে। 
বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা পাদুকাশিল্পকে কেন্দ্র করে সেখানে গড়ে উঠেছে বহু পশ্চাৎ সংযোগ ব্যবসা। গড়ে উঠেছে বড় বড় বিপণিকেন্দ্র। ছোট ছোট কারখানায় উৎপাদিত জুতা সরবরাহ করা হয় সেখানে। বিক্রি হয় পাইকারি দরে। 
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, ভৈরবে পাদুকাশিল্প ক্লাস্টারের কাজ শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। সর্বপ্রথম পাদুকা কারখানা স্থাপন করা হয় ভৈরব উপজেলা পরিষদ এলাকায়। কারখানার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন আশপাশের ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়েছে। এটি এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পাদুকা ক্লাস্টার। এখানে আনুমানিক সাড়ে তিন হাজার থেকে ৪ হাজার কারখানা রয়েছে। কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার মানুষের। দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এখানকার উৎপাদিত পণ্য এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। যদিও রপ্তানির পরিমাণ জানা যায়নি। 
এখানে বিভিন্ন ধরনের স্যান্ডেল, কেডস, ফরমাল জুতা, বেল্ট, মানিব্যাগ ইত্যাদি তৈরি হয়। পণ্য উৎপাদনে চামড়া, পেস্ট, সলিউশন, রেক্সিন, ফোম, রাবার, সুতা, রং ইত্যাদি প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে পণ্য উৎপাদনের জন্য সেলাই মেশিন, বব মেশিন, কালার মেশিন, কাটিং মেশিন ইত্যাদি মৌলিক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।
ক্লাস্টারের অধিকাংশ কারখানা মালিক পাইকার বা আড়তদারদের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করে থাকেন। কিছু কারখানার মালিক সরাসরি বড় ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলোকে পণ্য সরবরাহের পাশাপাশি সারাদেশ থেকে অর্ডার সংগ্রহ করে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন ও সরবরাহ করেন।
ভৈরব পাদুকা মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি আল আমিন মিয়া সমকালকে বলেন, ঋণ নিতে গেলে ব্যাংককে অনেক কাগজপত্র দেখাতে হয়। মর্টগেজ দিতে হয়। কিন্তু ছোট উদ্যোক্তার বেশির ভাগই অল্প শিক্ষিত। বন্ধক দেওয়ার মতো সম্পদও নেই অনেকের। ফলে তারা ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন না। এসএমই ফাউন্ডেশন সহজ শর্তে ও কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করলে এ শিল্পের ব্যাপক প্রসারের সম্ভাবনা রয়েছে।
এসএমই ফাউন্ডেশন ২০১৫ সাল থেকে ক্লাস্টারটির উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়ন ও পণ্যের গুণগত মানোন্নয়নে কাজ করছে। সেই ধারাবাহিকতায় ভৈরবের পাদুকা ক্লাস্টারে ব্যবসা ব্যবস্থাপনা, নেতৃত্ব, পণ্য বহুমুখীকরণ, অগ্নিনিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, কাটিং ও সুইং অপারেশন, পণ্যের গুণগত মানোন্নয়ন, কমপ্লায়েন্স ও সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। চামড়া, রেক্সিনের স্যান্ডেল ও জুতার পাশাপাশি উদ্যোক্তারা বর্তমানে মানিব্যাগ, বেল্ট, চাবির রিং ইত্যাদি উৎপাদন করছেন। ভৈরব ক্লাস্টারে এসএমই ফাউন্ডেশনের ক্রেডিট হোলসেলিং প্রোগ্রামের আওতায় ৪০ জন উদ্যোক্তার মাঝে প্রায় তিন কোটি টাকা অর্থায়ন করা হয়েছে।
ফাউন্ডেশনের দেওয়া এসব সেবা পাচ্ছেন উল্লেখ করে আল আমিন বলেন, এ সুবিধা অব্যাহত রাখতে হবে। ঋণ দিতে হবে সরাসরি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে। তাহলে ছোটরা সহজে ঋণ সহায়তা পাবেন।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী সমকালকে বলেন, সেখানকার উদ্যোক্তাদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ, কারিগরি জ্ঞান, ঋণ সুবিধা দেওয়া এসএমই ফাউন্ডেশনের কাজ। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। সেখানে প্রায় চার হাজার উদ্যোক্তা রয়েছেন। তাদের পণ্যে বৈচিত্র্য আনার জন্যও কাজ করছে ফাউন্ডেশন। 
তিনি বলেন, এ অর্থবছর ২৩টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসএমই উদ্যোক্তাদের ৪৫০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। জুলাই থেকে ঋণ বিতরণ হচ্ছে। পাশাপাশি চাহিদা অনুযায়ী সেখানে একটি সিএফসি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

×