সুদিন ফিরছে জাহাজ রপ্তানিতে
ফাইল ছবি
সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ | ০০:০৯ | আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ | ০৮:০৯
জাহাজটির নাম ‘এমভি রায়ান’। ৬৯ মিটার দৈর্ঘ্য ও সাড়ে চার মিটার গভীরতার এ জাহাজটি আয়তনের দিক থেকে খুব বড় নয়। তবু এ জাহাজ ঘিরেই নতুন স্বপ্নের জাল বুনছেন নির্মাতারা। অতিমারি করোনার কারণে বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছিলেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। সেটি কাটিয়ে এখন আবার জাহাজ নির্মাণে মনোনিবেশ করছেন তারা। ঢাকার আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ বাংলাদেশ থেকে সর্বশেষ জাহাজ রপ্তানি করে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। দুই বছর পর আবার জাহাজ রপ্তানি শুরু হচ্ছে নতুন এই বছরে। চট্টগ্রামভিত্তিক জাহাজ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড এ মাসের প্রথম সপ্তাহে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘রায়ান’ নামের এ জাহাজ রপ্তানি করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। রপ্তানির সব প্রস্তুতিও এরই মধ্যে সম্পন্ন করেছে তারা।
ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন সোহেল হাসান বলেন, জাহাজ রপ্তানিতে অমিত এক সম্ভাবনা ছিল বাংলাদেশের। পরপর বেশ কয়েকটি জাহাজ রপ্তানিও হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। নানা কারণে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে যাওয়ায় হোঁচট খেয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। এখন আবার নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা জাহাজ আবার যাচ্ছে বিদেশে। জাহাজ নির্মাণ খাতে এখন আবার প্রবৃদ্ধি বাড়বে। এতে করে নতুন কার্যাদেশ আসার সম্ভাবনাও তৈরি হবে।
তিনি জানান, রপ্তানি হতে যাওয়া নতুন জাহাজটি ল্যান্ডিং ক্রাফট ধরনের। তারা একই ক্রেতার কাছে পর্যায়ক্রমে আরও সাতটি জাহাজ রপ্তানি করবে। এই শিপইয়ার্ড এ পর্যন্ত বিশ্বের ১১টি দেশে ৩৩টি জাহাজ রপ্তানি করেছে। যেগুলোর দাম সব মিলিয়ে ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।
বিদেশে জাহাজ রপ্তানিকারক দুটি প্রতিষ্ঠান আছে বাংলাদেশে। এর একটির নাম আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ। এটি ঢাকার প্রতিষ্ঠান। আরেকটি চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। বাংলাদেশ থেকে প্রথম জাহাজ রপ্তানি করে ঢাকার আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ। ২০০৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ডেনমার্কে জাহাজ রপ্তানির মাধ্যমে নতুন এই দিনের সূচনা করে বাংলাদেশ। ২০১০ সালে জাহাজ রপ্তানিতে যুক্ত হয় ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। ২০১০ সালের ৩০ নভেম্বর তারা জার্মানিতে একটি সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানি করে।
এই খাতের উদ্যোক্তারা জানান, ২০০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট জাহাজ ও জলযান রপ্তানি হয়েছে ৪৫টি। এর মধ্যে সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা ১৯। বাকিগুলো ফেরি ও বিভিন্ন ধরনের সমুদ্রগামী জলযান। এসব জাহাজ ও জলযান রপ্তানির মাধ্যমে আয় হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা। আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি ১ কোটি ১০ লাখ ডলার মূল্যের দুটি জাহাজ ভারতে রপ্তানি করে। এর পর বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়নি আর কোনো জাহাজ। তবে এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাচ্ছে ওয়েস্টার্ন মেরিনের তৈরি ‘এমভি রায়ান’ নামের জাহাজটি। এটির ক্রেতা আরব আমিরাতের মারওয়ান শিপিং লিমিটেড।
ওয়েস্টার্ন মেরিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ২০১৭ সালেও একই ক্রেতার কাছে তারা একটি ল্যান্ডিং ক্রাফট রপ্তানি করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন অর্ডার পেয়েছেন তারা। মারওয়ান শিপিংয়ের কাছে চারটি ল্যান্ডিং ক্রাফট ভ্যাসেল, দুটি টাগবোট এবং দুটি অয়েল ট্যাঙ্কারসহ আটটি জাহাজ বিক্রির জন্য ২০২৩ সালে চুক্তি করে ওয়েস্টার্ন মেরিন। এর অংশ হিসেবে ‘রাইয়ান’ জাহাজটি হস্তান্তর করতে যাচ্ছেন তারা। ‘খালিদ’ ও ‘ঘায়া’ নামে দুটি উচ্চ ক্ষমতার টাগবোট চলতি বছর এপ্রিলের মধ্যে রপ্তানি করা হবে। বাকি পাঁচটি জাহাজ চলতি বছরের বিভিন্ন সময়ের মধ্যে হস্তান্তর করা হবে। ওয়েস্টার্ন মেরিন সর্বশেষ জাহাজ রপ্তানি করেছিল পাঁচ বছর আগে, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে।
জানতে চাইলে আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজের নির্বাহী পরিচালক তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘আশা করছি জাহাজ নির্মাণশিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াবে। তিন সপ্তাহ আগে তুরস্কের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আমাদের ইয়ার্ড পরিদর্শন করেছে। সবকিছু ঠিক হলে তিনটি জাহাজ শিগগির রপ্তানি করতে পারব আমরাও।’
তিনি বলেন, মন্দার সময় আনন্দ শিপইয়ার্ডের ১০টি জাহাজের নির্মাণকাজের আদেশ বাতিল হয়েছিল। এমন সময় এগুলো বাতিল হয়, যখন পাঁচটি জাহাজের নির্মাণকাজ অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিল। দুই বছর আগে দুটি জাহাজ তারা অন্য ক্রেতার কাছে রপ্তানি করেন। এখন নির্মাণাধীন বাকি তিনটি জাহাজ রপ্তানি করবেন তারা তুরস্কের প্রতিষ্ঠানের কাছে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন মো. আনাম চৌধুরী বলেন, দেড় যুগ আগে জাহাজ রপ্তানিতে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা সম্ভাবনা দেখালেও তা স্থায়ী হয়নি বেশি দিন। কারণ ২০১১ সাল থেকে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব পড়তে থাকে জাহাজ নির্মাণশিল্পে। তখন অনেক রপ্তানি আদেশ বাতিল করেন বিদেশি ক্রেতারা। এতে উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যাপকভাবে। জাহাজ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান দুটির ঋণও অনিয়মিত হয়ে পড়ে। তবে সরকারের বিশেষ নীতিসহায়তা কাজে লাগিয়ে এখন আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে তারা।
বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ খাতকে সম্ভাবনাময় মনে করায় ২০০০ সালে এ শিল্পে প্রবেশ করে চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। গত দুই দশকে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ধরনের ১৫০টিরও বেশি জাহাজ তৈরি করেছে। এর মধ্যে আছে কার্গো জাহাজ, যাত্রীবাহী জাহাজ, মাল্টিপারপাস আইস-ক্লাস ভেসেল, ল্যান্ডিং ক্রাফ্ট, অফশোর প্যাট্রল ভেসেল, টাগবোট, মাছ ধরার জাহাজ, বাল্ক ক্যারিয়ার ও কনটেইনার ক্যারিয়ার।
- বিষয় :
- জাহাজ