বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট
ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতার জন্য যেসব পরামর্শ বিশ্বব্যাংকের

.
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৫ | ০০:৫১
বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট (এপ্রিল, ২০২৫) নামের প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার ওপর বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছে। প্রতিবেদনে এ বিষয়ের ওপর আলাদা বিস্তারিত বিশ্লেষণ রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত দীর্ঘদিনের কাঠামোগত দুর্বলতা এবং গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এ খাত উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণ ও নিম্ন মূলধন পর্যাপ্ততার মতো সমস্যায় ভুগছে। শাসন ব্যবস্থায় দুর্বলতা, নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রভাব কম থাকা এবং ঋণ প্রদানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ঋণ দেওয়ার প্রবণতা ব্যাংকিং খাতের পারফরম্যান্স ও স্থিতিশীলতা আরও অবনতির দিকে নিয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, ব্যাংকিং সংকট অর্থনীতিতে ব্যাপক ব্যয় সৃষ্টি করে। ব্যাংকিং খাতের সংকট দ্রুত শনাক্ত ও সমাধান করা হলে এ ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। ব্যাংকিং খাত আরও শক্তিশালী করা এবং এর সহনশীলতা বাড়ানোর জন্য বিশ্বব্যাংক বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, সংস্কার প্রক্রিয়া বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে এগিয়ে চলছে। তবে এটি সম্পূর্ণ করতে আরও কাজ প্রয়োজন। তদারকির কার্যকারিতা বাড়ানো, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং সমাধান কাঠামোকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ফেরাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নিরাপত্তা জাল শক্তিশালী করা
বাংলাদেশের জন্য আর্থিক খাতের নিরাপত্তা জাল আরও শক্তিশালী করা অত্যাবশ্যক। এ নিরাপত্তা ব্যবস্থার অন্যতম মূল স্তম্ভ হলো ডিপোজিট প্রোটেকশন সিস্টেম, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তবে এটি কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে হলে একটি শক্তিশালী আইনগত কাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গড়ে তোলা প্রয়োজন। আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশের ভিত্তিতে শক্তিশালী ডেটা ব্যবস্থাপনা এবং দ্রুত ও কার্যকর অর্থ প্রদান প্রক্রিয়া গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। একটি কার্যকর ও স্বচ্ছ জরুরি তারল্য সহায়তা কাঠামো প্রতিষ্ঠা করলে শর্তবিহীন ও খাপছাড়া তারল্য সহায়তা প্রদান বন্ধ হবে এবং সুশাসন নিশ্চিত হবে। একই সঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ রেজুলেশন ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির চলমান প্রচেষ্টা অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে করতে হবে, যাতে তার বাস্তবায়ন কার্যকরভাবে করা যায়। এতে বাংলাদেশে একটি নিরাপদ, স্থিতিশীল এবং সহনশীল আর্থিক খাত গড়ে তোলা সহায়ক হবে।
খেলাপি ঋণের সমাধান যেভাবে
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণের একটি কার্যকর সমাধান ও পুনরুদ্ধার ব্যবস্থা অপরিহার্য। কিন্তু বর্তমানে বিদ্যমান আইনগত কাঠামো দ্রুত ঋণ পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আদালতগুলো অতিরিক্ত মামলা জটে ভুগছে এবং ঋণগ্রহীতারা অর্থঋণ আদালতে রিট আবেদন করার সুযোগ নেয়, ফলে পুরো প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়। জামানত বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও সময়সাপেক্ষ, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর বিরুদ্ধে অনেক রিট মামলা দায়ের করা হয়, যাতে কিছু ঋণগ্রহীতাকে খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকরণ করা ঠেকানো যায়, ফলে সঠিক ঋণ রিপোর্টিং বাধাগ্রস্ত হয়। এর সঙ্গে দেশে সেকেন্ডারি খেলাপি ঋণ ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম এবং অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি না থাকায় খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা আরও জটিল হয়ে পড়েছে। এসব বাধা কাটিয়ে উঠতে হলে বাংলাদেশের জন্য আইনি সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং একটি সক্রিয় খেলাপি ঋণ আদায়ের মার্কেট ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কাঠামো গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
ব্যাংক রেজুলেশন কাঠামো শক্তিশালী করা
বিশ্বব্যাংক বলেছে, বর্তমানে পর্যালোচনাধীন থাকা ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশের ভিত্তিতে, কর্তৃপক্ষের উচিত একটি শক্তিশালী ও কার্যকর কাঠামো গড়ে তোলা, যা দ্রুত হস্তক্ষেপ ও সুশৃঙ্খল পুনর্গঠন নিশ্চিত
করতে সক্ষম। এ কাঠামোর আওতায় ব্যাংকের সক্ষমতা ও পদ্ধতিগত গুরুত্ব অনুযায়ী সুস্পষ্ট শ্রেণীবিন্যাস ব্যবস্থা প্রয়োগ করা দরকার।
করপোরেট সুশাসন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা
প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে করপোরেট গভর্ন্যান্স এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রয়োজন। এ জন্য ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে যোগ্য ও পেশাদার ব্যক্তিদের নিয়োগ নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক নিয়োগ পরিহার করা এবং ম্যানেজমেন্টকে পূর্ণাঙ্গ অপারেশনাল স্বাধীনতা দিতে হবে, যাতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে পরিচালকদের নিয়োগে যোগ্যতার মানদণ্ড কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। কোনো পরিচালকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে তিনি সরকারি মনোনীত হলেও বিচারবহির্ভূত সুবিধা না দিয়ে বিধিসম্মত ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা শক্তিশালী করা
বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংককে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনে পরিচালিত করতে হবে, যাতে তার নিয়ন্ত্রক, তত্ত্বাবধানে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া স্বাধীন থাকে। এটি বাস্তবায়নের জন্য গভর্নর এবং গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের নিয়োগ শুধু মেধা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে হওয়া উচিত। নিয়োগ প্রক্রিয়া হওয়া উচিত স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক, যাতে কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংককে পূর্ণ স্বাধীনতা ও ক্ষমতা দেওয়া উচিত, যাতে তারা অযোগ্য ব্যাংক, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নিতে পারে এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই পদক্ষেপগুলো নিতে পারে।
- বিষয় :
- ব্যাংক