ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

অভিমত

শিল্পে ন্যায্য জ্বালানির জন্য চাই সমন্বিত পথনকশা

শিল্পে ন্যায্য জ্বালানির জন্য  চাই সমন্বিত পথনকশা

মো. মহিউদ্দিন রুবেল

মো. মহিউদ্দিন রুবেল

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫ | ০০:৪০ | আপডেট: ১৭ মে ২০২৫ | ১১:৪৯

বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের শিল্প-কারখানা বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত ক্রমবর্ধমানভাবে জ্বালানি সংকট মোকাবিলা করে আসছে। বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান দাম, অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অনিশ্চিত গ্যাস সরবরাহ এবং পুরোনো অবকাঠামোর কারণে উৎপাদন সচল রাখতে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হচ্ছে। যদিও শিল্প উদ্যোক্তারা ব্যবসায় প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নিজস্ব উদ্যোগে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া এটা বালির বাঁধ নির্মাণের মতোই। 
জ্বালানির অন্যতম চ্যালেঞ্জ গ্যাসের শুল্ক নিয়ে দ্বৈত নীতি। পুরোনো কারখানা প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের মূল্য বাবদ প্রায় ১৬ টাকা পরিশোধ করে। নতুন কারখানার জন্য যা ৩০ টাকা অথবা তার বেশি টাকা। দ্বৈত নীতি মিরসরাইয়ের মতো নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলে নতুন বিনিয়োগকারীর টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন করে তুলেছে। আবার বাংলাদেশে এলএনজি সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও বিতরণের অবকাঠামোর অভাবও রয়েছে। এলএনজির জন্য আমরা মহেশখালীর কাছে দুটি ভাসমান টার্মিনালের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করি, যেখানে কোনো জমিভিত্তিক স্টোরেজ বা রিজার্ভার নেই। যখন বিশ্বব্যাপী এলএনজির দাম বেড়ে যায় অথবা যখন জাহাজ আসতে দেরি হয়। আমাদের কোনো বাফার থাকে না। নতুন শিল্প এলাকায় প্রায়ই প্রয়োজন অনুযায়ী গ্যাসের চাপ পাওয়া যায় না। অনেক এসএমই প্রতিষ্ঠানের জন্য এলএনজি ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। স্যাটেলাইট রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট বা মডুলার স্টোরেজ সমাধান না থাকায় তারা প্রায়ই ডিজেলের মতো ব্যয়বহুল এবং দূষণকারী বিকল্পের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে আমাদের অগ্রগতি মন্থর। শিল্প যে জ্বালানি ব্যবহার করে, সেখানে সৌরবিদ্যুৎ এবং অন্যান্য পরিচ্ছন্ন বিদ্যুতের অংশ এখনও নগণ্য। বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে অনেক কারখানা ছাদে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন বা অন-সাইট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, নেট মিটারিং ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার অভাব– প্রভৃতি কারণে তারা এগোতে পারছে না।
লক্ষ্যণীয় বিষয়, বর্তমান সময়ে শিল্পে জ্বালানি-দক্ষ প্রযুক্তি যেমন ভ্যারিয়েবল স্পিড ড্রাইভস, উচ্চ দক্ষসম্পন্ন মোটর এবং আধুনিক বয়লারের ব্যবহার আর ঐচ্ছিক নয়। এগুলো ব্যবসার নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনীয়তা। যেহেতু বিদ্যুতের দাম ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে, তাই কারখানাগুলো দূরদর্শিতা সহকারে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কল্পনা করা যাক, একটি কারখানা মাসে এক লাখ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। প্রতি কিলোওয়াট ১০ টাকা করে কারখানাটির মাসিক বিদ্যুৎ বিল হয় ১০ লাখ টাকা। জ্বালানি-দক্ষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কারখানাটি ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে পারে। এভাবে প্রতি মাসে ১৫ হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ বা দেড় লাখ টাকা সাশ্রয় করতে পারে, যা বছরে ১৮ লাখ টাকা। সাশ্রয় করা অর্থ দিয়ে প্রযুক্তি মানোন্নয়ন, মজুরি বা সাসটেইনেবিলিটি ক্ষেত্রে পুনর্বিনিয়োগ করা যেতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে সহায়তা করবে। যেহেতু ক্রেতারা ক্রমবর্ধমানভাবে সাপ্লাই চেইন-জুড়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর দাবি করছে, তাই জ্বালানি দক্ষতা শুধু অর্থ সাশ্রয় নয়, বরং শিল্পের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়।
গ্যাসের শুল্কনীতি এমন করে প্রণয়ন করতে হবে, যাতে করে শিল্পে নতুন উদ্যোক্তারা বৈষম্য বা হয়রানির সম্মুখীন না হন। আরও কিছু করণীয় রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ল্যান্ড টার্মিনাল, স্টোরেজ ট্যাঙ্ক এবং মডুলার ডিস্ট্রিবিউশন ইউনিটসহ এলএনজি অবকাঠামো তৈরি করা। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে স্থানান্তর ত্বরান্বিত করা, বিশেষ করে কারখানা ভবনের ছাদে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং অন্যান্য পরিচ্ছন্ন নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। জ্বালানি দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কারখানাগুলোকে প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তরে কেউ যেন পিছিয়ে না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। 
বাস্তবসম্মত; কিন্তু উচ্চাভিলাষী জ্বালানি লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য সরকারের উচিত হবে শিল্প, উন্নয়ন অংশীদার এবং সুশীল সমাজকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা। ২০৩০ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণ এবং এলডিসি থেকে উত্তরণ মসৃণ রাখার জন্য সুস্পষ্ট বাস্তবায়ন পরিকল্পনা দরকার। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক চাপের সময়টিতে যদি আমাদের জ্বালানি ব্যবস্থা শিল্পের একটি বড় অংশকে দুর্বল করে রাখে, তাহলে আমরা সবুজ প্রবৃদ্ধিতে যেতে পারব না।
পরিশেষে, আমাদের জ্বালানি নীতিকে শিল্প কৌশল থেকে আলাদা করে ভাবা বন্ধ করতে হবে। যদি জ্বালানি খুব ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে বা অনিশ্চিত হয়, তাহলে ব্যবসা টিকে থাকবে না। শ্রমিকরা চাকরি হারাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে একটি সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়া আমাদের নাগালের বাইরে থেকে যাবে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেছে। এ মুহূর্তে দরকার একটি সাহসী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সুদূরপ্রসারী জ্বালানি পরিকল্পনা। ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তর মানে শুধু পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠা বোঝায় না। আমরা যে ভবিষ্যৎ তৈরি করার চেষ্টা করছি, প্রত্যেকেই যেন সেই ভবিষ্যতের অংশ হতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্যও এটি দরকার।

লেখক : বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক 
 

আরও পড়ুন

×