পদ্মার স্রোতও যেন মলিন। চোখের নোঙর যেখানে সেখানেই জনস্রোত। কাঁঠালবাড়ী যেন হয়ে ওঠে সেতুজয়ের উচ্ছ্বাস মঞ্চ। পদ্মার দক্ষিণপাড়ের জনসভার মূল আঙিনা ছাপিয়ে মহাসড়ক থেকে গ্রামীণ মেঠোপথেও আনন্দের রোশনি। সবার চোখে-মুখে খুশির আলোকধারা। নদীতে সুসজ্জিত পালতোলা নৌকা, ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচের মধুর ধ্বনি, দক্ষিণাঞ্চলের জেলা থেকে লঞ্চে করে জনসভায় যোগ দিতে আসা হাজার হাজার মানুষের উন্মাদনা- গেঁথে যায় এক সুতায়। অদূরেই প্রমত্তা পদ্মায় বাঙালির গৌরব, বীরত্ব আর অহংকারের বার্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আত্মপ্রত্যয়ী সেতু।

মধ্যদুপুরের ঝলমলে রোদ্দুর। ঘড়ির কাঁটায় যখন ১২টা বেজে ৫০, তখন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পা রাখলেন পদ্মা সেতুর আদলে গড়া মঞ্চে, তখন লাখো জনতার আনন্দ-উল্লাসের ঢেউ আছড়ে পড়ছিল পদ্মার পাড়ে। সবার অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর সেই অমর বাণী- '...কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না।' বাঙালিকে দাবিয়ে যে রাখা যায়নি, তা দেশের দুই প্রান্তকে জোড়া লাগানো পদ্মা সেতুই সাক্ষ্য দিচ্ছে। সেই ইতিহাসের একজন হতে পদ্মার দক্ষিণপাড়ে ছুটে আসেন দেশের নানা প্রান্তের কয়েক লাখ মানুষ। তাঁরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছেন জনসমুদ্রের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা, অসীম দৃঢ় নেতৃত্ব পদ্মা সেতু তৈরি করে তিনি বাংলাদেশের সক্ষমতার গভীরতা বিশ্বকে নতুন করে জানিয়ে দিলেন।

প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও জাজিরার নাওডোবা প্রান্তের উদ্বোধন কার্যক্রম শেষে কাঁঠালবাড়ীর জনসভাস্থলে পৌঁছালে মঞ্চে বাজানো হয় লোকগানের শিল্পী আবদুল আলীমের 'সর্বনাশা পদ্মা নদীরে' এবং 'ও নদীরে একটি কথা সুধাই শুধু তোমারে' গান দুটি। পরে 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা' স্লোগানে পুরো এলাকা হয়ে ওঠে আনন্দমুখর।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন পদ্মা সেতু পার হন, তখন বিমানবাহিনীর ছয়টি হেলিকপ্টার তাঁকে অভিবাদন জানায়। এর পর হেলিকপ্টারগুলো কাঁঠালবাড়ী ঘাটে জনসভা মঞ্চের ওপর দিয়ে চক্কর দেয়। এর একটিতে জাতীয় পতাকা, একটিতে বঙ্গবন্ধু, একটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পদ্মা সেতুর ছবিসংবলিত পতাকা বহন করছিল। আরেকটি হেলিকপ্টার থেকে ফুল ছিটিয়ে, নানা রঙের কাগজের টুকরো ছিটিয়ে জনসভায় আসা মানুষকে অভিবাদন জানাচ্ছিল। তখন পুরো সমাবেশস্থল রূপ নেয় এক বর্ণিল সাজে।

এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়া টোল প্লাজা পার হয়ে যখন পদ্মা সেতুতে ওঠেন, তখন পদ্মার আকাশে দেখা যায় অভূতপূর্ব এক ছবি। আকাশে লাল-সবুজের রং ছিটিয়ে বিশেষ কসরত করে বিমানবাহিনীর কয়েকটি উড়োজাহাজ।

পুরো সমাবেশস্থল ও আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নানা রঙে, নানা ঢঙে মানুষ এসেছেন উৎসব করতে। বিভিন্ন জেলার নেতারা আসেন খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে, ঢোলবাদ্যের সুরে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায়। পুরো এলাকা ছিল নিরাপত্তা চাদরে মোড়া।

পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ থেকে পদ্মাপাড়ে এসেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক কবির উদ্দিন হাওলাদার। নদীতীরে তেজি রোদের মধ্যেও ক্লান্তি নেই তাঁর চোখে-মুখে। তিনি বলেন, 'সেতু তৈরি থেকে বিশ্বব্যাংকের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর হতাশ হয়েছিলাম। এরপর বঙ্গবন্ধুকন্যা নিজেদের টাকায় সেতু তৈরির উদ্যোগ নিলে নানা বিপত্তি আসে। নদীর তলদেশে পাইলিং সমস্যা, সমুদ্রে সেতুর মালবাহী জাহাজডুবি থেকে শুরু করে করোনার ধাক্কা, তবু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে সাফল্যের স্মারক পদ্মা সেতু।'

শরীয়তপুরের ভোজেশ্বর-উপাসী মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ শেখ শহীদুল ইসলাম সভাস্থলে এসেছিলেন সকাল ৮টার দিকে। তিনি বলেন, 'আজকের সকালটির (শনিবার) অপেক্ষায় থাকতে থাকতে রাতে ঘুমাতে পারেননি। এই সেতুটা হয়তো অনেকের চোখে বড় স্থাপনা। শরীয়তপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে সেতুটি আবেগ।'

বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ থেকে এসেছেন সিদ্দিকুর রহমান। তাঁদের বহন করা বাসটি সকাল ৮টার দিকেই আটকে যায় শিবচরের পাচ্চর বাজার এলাকায়। মূল জনসভাস্থল থেকে সেই বাজারের দূরত্ব তাও ৮ কিলোমিটার। সেখান থেকেই হাঁটছিলেন সিদ্দিকুরসহ হাজারো মানুষ। সিদ্দিকুর রহমান বলেন, 'আজকে কোনো কষ্ট বা ভোগান্তি নেই। সবকিছু ছাপিয়ে আনন্দের দিন আজ।'

রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ ও খুলনা থেকেও ওই পথে এসে আটকেছে অসংখ্য পরিবহন। তাঁরা বাস থেকে নেমে হাঁটছিলেন। এই জনস্রোতের সবার পথ পদ্মার পাড়ের সেই উৎসব মঞ্চে। জনসভাস্থলে আসা লোকজন বলছিলেন, বাসের সারি ফরিদপুরের ভাঙ্গা মোড় পর্যন্ত ঠেকেছে। সেখান থেকেই তাঁরা হেঁটে মিছিল নিয়ে আসেন জনসভাস্থলে।

এদিকে জনস্রোত শরীয়তপুরের নাওডোবা মোড় থেকে শুরু করে আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। জাজিরার কাজীরহাট পর্যন্ত লেগে যায় গাড়িজট। সেখান থেকেই কয়েক কিলোমিটার হেঁটে লোকজন সমাবেশস্থলে আসেন। শিবচরের কেওড়াকান্দি এলাকার পুরোনো ফেরিঘাট থেকে সমাবেশস্থল পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে মানুষ আর মানুষ।

খুলনা থেকে বড় ভাই সাইদুর রহমান গাজীর সঙ্গে জনসভায় এসেছেন পলি বেগম। তিনি জানান, ইতিহাসের সাক্ষী হতে এসেছেন পদ্মাপাড়ে।