সাক্ষাৎকার
আমাদের পণ্য সারাবিশ্বে যাবে
এম এ রাজ্জাক খান রাজ, চেয়ারম্যান, মিনিস্টার গ্রুপ
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০১ জুলাই ২০২২ | ১৪:৫৭
দেশের উদ্যোক্তারাই এখন ইলেকট্রনিকসের মতো উচ্চ প্রযুক্তির গুণগত পণ্য উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও করছেন। এরই মধ্যে ভোক্তার আস্থা তৈরি করে দেশের বাজারে বড় জায়গা দখল করতে পেরেছে মিনিস্টার-মাইওয়ান গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে রপ্তানির কথা ভাবছে। মিনিস্টার গ্রুপের অতীত ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআইর সহসভাপতি এম এ রাজ্জাক খান রাজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জসিম উদ্দিন বাদল
সমকাল: মিনিস্টার গ্রুপের যাত্রা শুরুর গল্পটা কেমন ছিল? বিনিয়োগ ছিল কেমন?
এম এ রাজ্জাক খান রাজ: উচ্চ মাধ্যমিক শেষে উচ্চতর শিক্ষার জন্য সিঙ্গাপুর চলে যাই। কিন্তু সব সময়ই ইচ্ছে ছিল দেশে কিছু করার। তাই ১৯৯৯ সালে পড়াশোনা শেষ হলে চলে আসি। সে সময় বিশ্বমানের একটি দেশীয় ইলেকট্রনিকস ব্র্যান্ডের অভাব বোধ করি। পাঁচজন উদ্যোক্তা মিলে 'মাইওয়ান'-এর যাত্রা শুরু করি। মূলধন ছিল মাত্র পাঁচ লাখ টাকা। তখন মূলত অ্যাসেমবল (সংযোজন) করতাম। এরপর ধীরে ধীরে নিজেরাই উৎপাদন শুরু করি। শুরুতে ইলেকট্রনিকসের বাজারে সাদাকালো টেলিভিশন নিয়ে আসি। কয়েক বছরের মধ্যে কালার টেলিভিশন ও ফ্রিজের যাত্রা শুরু করি। সেই ধারাবাহিকতায় সফলতার সঙ্গে ২০ বছর কেটে গেল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতায় দেশীয় সব ধরনের পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর অল্পদিনেই দেশের সুপরিচিত ব্র্যান্ড হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মিনিস্টার। দেড় যুগ পেরিয়েও সেই জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ রয়েছে। কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ভোক্তার ভালোবাসাই আমাদের সাফল্যের অন্যতম উপায়। কালের পরিক্রমায় এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ১০ হাজার সদস্যের একটি পরিবারে পরিণত হয়েছে।
সমকাল: কবে থেকে উৎপাদন ও বিক্রি শুরু করেছে মিনিস্টার?
এম এ রাজ্জাক খান রাজ: ২০০২ সালে টিভির উৎপাদন দিয়ে শুরু করি। প্রথমে সাদাকালো টিভি, এরপর রঙিন। এখন তো বেসিক এলইডি, স্মার্ট এবং ফোর-কে টিভি উৎপাদন করছি। ২০০৫ সালে ফ্রিজ অ্যাসেমব্লিং শুরু করি। এরপর ২০১৩ সাল থেকে নিজেরাই উৎপাদন করছি। এসি উৎপাদন করছি ২০১৭ সাল থেকে। এ ছাড়া উৎপাদন করছি বিভিন্ন ধরনের হালকা ও মাঝারি হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য। প্রতি মাসে এক লাখের বেশি ইউনিট ফ্রিজ, ৫০ হাজারের বেশি এসি আর টিভিসহ প্রায় দুই লাখের বেশি ইউনিট ইলেকট্রনিকস আইটেম উৎপাদন করছি। মিনিস্টারই প্রথম ফ্রিজ এবং এসিতে ১২ বছর এবং টিভিতে ৭ বছর (প্যানেলে ৪ বছর) ওয়ারেন্টি সেবার ঘোষণা দিয়েছে। দেশের সব জেলায় নিজস্ব শোরুম এবং ডিলার ফ্র্যাঞ্চাইজিং শোরুম রয়েছে ১ হাজারের বেশি। ইলেকট্রনিকস পণ্য বিক্রিতে বাজারে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এখন মিনিস্টার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।
সমকাল: মিনিস্টার ফ্রিজ নিয়ে কিছু বলুন।
এম এ রাজ্জাক খান রাজ: বিশ্বমানের প্রযুক্তি দিয়ে দেশেই তৈরি হয় ফ্রিজ। বিভিন্ন দামে বিভিন্ন ধরনের ফ্রিজ তৈরি করে থাকে মিনিস্টার। এর রয়েছে নিজস্ব স্পেসিফিকেশন, আকৃতি ও ডিজাইন। প্রতিটি পণ্যের বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে দামের ভিন্নতা। একইসঙ্গে প্রতিটি ফ্রিজে যুক্ত করা হয়েছে এমন সব প্রযুক্তি, যা সঠিক তাপমাত্রা, হিমায়িত খাবারের ভিটামিন এবং দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করার জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা বজায় রাখে। সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিটি ফ্রিজ। ফলে প্রতিটি ফ্রিজ হয় বিদ্যুৎসাশ্রয়ী। এ ছাড়া ন্যানো টেকনোলজি ও সিক্স-এ কুলিং সিস্টেম থাকায় খাবার দ্রুত ঠান্ডা হয়। ফ্রিজ সহজে পরিস্কার করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ডোর গ্যাসকেট, যাতে তা ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাসমুক্ত থাকে। একই সঙ্গে মিনিস্টার ফ্রিজ কম্প্রেশারে দিচ্ছে ১২ বছরের গ্যারান্টি।
দেশের রেফ্রিজারেটর বাজারের প্রায় ১৫ শতাংশ দখল করে রেখেছে মিনিস্টার-মাইওয়ান গ্রুপ। ভবিষ্যতে এই হার আরও বাড়বে। বিশ্ববাজারেও আমরা পণ্য রপ্তানির পরিকল্পনা করছি।
সমকাল: ফ্রিজ ছাড়া আর কী কী পণ্য উৎপাদন করছেন?
এম এ রাজ্জাক খান রাজ: ফ্রিজ ছাড়াও মিনিস্টারের প্রোডাকশন লাইনে রয়েছে এয়ার কন্ডিশনার, এলইডি টিভি, স্মার্ট এলইডি টিভি, ব্লেন্ডার, গ্রিন্ডার, রাইস কুকার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ওয়াশিং মেশিন, ইলেকট্রিক কেটলি, গ্যাস বার্নার, ইন্ডাকশন কুকার, ফ্রাইপেন, ফ্যান, আয়রন, স্ট্যাবিলাইজারসহ ২০টির বেশি পণ্য। এর প্রতিটিতে রয়েছে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী প্রযুক্তি এবং এগুলো টেকসই।
সমকাল: বছরের কোন সময়ে ফ্রিজ বেশি বিক্রি হয়? তখন কী ধরনের প্রতিযোগিতা করতে হয়?
এম এ রাজ্জাক খান রাজ: সাধারণত গ্রীষ্ফ্মকাল এলেই ফ্রিজের বিক্রি অনেকটাই বেড়ে যায়। তা ছাড়া বছরের বিভিন্ন উৎসবের দিনগুলোতে যেমন বৈশাখ ও ঈদের সময়ও ফ্রিজের বিক্রি অন্যান্য সময়ের তুলনায় ভালো হয়। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আমরা মুনাফা কমিয়ে দিয়েছি। তবে পণ্যের মানের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছাড় দিই না। গত দুই বছর আমাদের ফ্রিজের বিক্রি ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের কারণে জেলা শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফ্রিজের চাহিদা বাড়ছে। অন্যদিকে, রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরের ক্রেতাদের মধ্যে সর্বশেষ আধুনিক প্রযুক্তির প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রুচি ও চাহিদারও পরিবর্তন হয়। ফলে পুরোনো ফ্রিজ বদলে নতুন কেনার প্রবণতাও বেড়েছে।
সমকাল: দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে হোম অ্যাপ্লায়েন্স খাতের কতটা অগ্রগতি হচ্ছে?
এম এ রাজ্জাক খান রাজ: বাংলাদেশের ইলেকট্রনিকস শিল্প বর্তমানে দ্রুত বর্ধনশীল এবং সম্ভাবনাময় শিল্প খাত। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআরইউ) ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি থাকবে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখবে বেসরকারি খাত। তার মধ্যে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করবে ইলেকট্রনিকস শিল্প। আমি মনে করি, দেশীয় ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তিপণ্য খাতের বিকাশের ফলে বিপুল পরিমাণ পণ্যের আমদানি ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে। এ শিল্প হয়ে উঠেছে সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত। এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানি হচ্ছে। আগামী কয়েক বছরে পুরো বিশ্বে আমাদের ইলেকট্রনিকস পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করছি।
সমকাল: এই খাতের উন্নয়নে কী কী সমস্যা রয়েছে? সরকারের কী ধরনের নীতিসহায়তা দরকার?
এম এ রাজ্জাক খান রাজ: ইলেকট্রনিকস শিল্পকে বর্তমান অবস্থানে নিয়ে আসতে নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- বিগত সরকারের নানা ধরনের নিয়মনীতি, প্রতিযোগীদের আগ্রাসী মার্কেটিং, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ইত্যাদি। এরপরও বর্তমান সরকারের সহযোগিতায় ইলেকট্রনিকস শিল্প অনেকটা এগিয়ে গেছে। এ শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে হলে দক্ষ জনবলের দরকার। সরকার শতভাগ বিদ্যুৎ নিশ্চিত করায় দেশের সর্বত্র ইলেকট্রনিকস পণ্য ব্যবহার করতে পারছেন ভোক্তা। এতে আমাদের চ্যালেঞ্জ অনেকটাই কমে গেছে। ফ্রিজ এখন নিত্যব্যবহার্য পণ্যে পরিণত হয়েছে। তাই এই খাতে শিল্পবান্ধব নীতিসহায়তা ও কাঁচামাল আমদানি সহজ করা দরকার। এতে এ খাত আরও এগিয়ে যাবে। দেশের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বাড়বে।
সমকাল: ক্রেতার রুচি-পছন্দের সঙ্গে ফ্রিজ উৎপাদনকারীদের কীভাবে তাল মেলানো দরকার?
এম এ রাজ্জাক খান রাজ: আন্তর্জাতিক মানের ফ্রিজ, টেলিভিশন ও এসি। ফ্রিজ, টেলিভিশন, এসি, গৃহস্থালি বিভিন্ন সরঞ্জাম, ইলেকট্রিক পণ্যসহ মিনিস্টারের সব পণ্যই বাংলাদেশে তৈরি হয়। নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। মিনিস্টার নিজের পণ্যের নকশা ও উন্নয়ন নিজেই করে থাকে। এছাড়াও মিনিস্টার ফ্রিজ সবচেয়ে কম ভোল্টেজে চলে। অন্য কোনো ফ্রিজে এই সুবিধা নেই। আমাদের ফ্রিজে ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার প্রয়োজন হয় না। বিভিন্ন দামে বিভিন্ন ধরনের ফ্রিজ তৈরি করে থাকে মিনিস্টার।
সমকাল: মিনিস্টার গ্রুপের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
এম এ রাজ্জাক খান রাজ: বাংলাদেশে ইলেকট্রনিকস শিল্পের ভবিষ্যৎ অনেকটাই ভালো। প্রতিটি ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার ও সারাদেশে বিদ্যুতায়ন ব্যবস্থা থাকায় আরও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে সাধারণ মানুষ ইলেকট্রনিকস পণ্যের ব্যবহার অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের দেশীয় ইলেকট্রনিকস কোম্পানিগুলো কম দামে মানুষের কাছে পণ্য পৌঁছে দিচ্ছে। আশা করছি কয়েক বছরের মধ্যে পুরো বিশ্বেই মিনিস্টারসহ বাংলাদেশের ইলেকট্রনিকস পণ্য পৌঁছে যাবে।
- বিষয় :
- সাক্ষাৎকার
- মিনিস্টার গ্রুপ