ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

বাংলাদেশের মুখ

বজ্রপাত থেকে উদ্ধার

বজ্রপাত থেকে উদ্ধার

মোহন আখন্দ

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২২ | ০০:২১

তাল পাকার মৌসুম এলেই গ্রামের তরুণরা দলবেঁধে পথে নেমে পড়েন। তালবীজ সংগ্রহ এবং রোপণই তাদের লক্ষ্য। এ জন্য প্রথমে তাঁরা গ্রামের এপাড়া-ওপাড়া ঘুরে বীজ সংগ্রহ করেন। তারপর সে বীজগুলো এঁকেবেঁকে চলা গ্রামীণ সড়ক, উপজেলা কিংবা জেলা সদরগামী মহাসড়কের ধারে রোপণ করেন। শরৎকালজুড়ে কাকডাকা ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ওই কর্মযজ্ঞে জড়িতরা সবাই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'এডুকেশন ফাউন্ডেশন'-এর সদস্য।

পাঁচ বছরে এক লাখ তালবীজ রোপণের লক্ষ্য নিয়ে ২০২০ সাল থেকে ওই সংগঠনের অর্ধশত সদস্য বগুড়ার দুই উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০২০ সালের অক্টোবরে তাঁরা জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলার ভাটগ্রাম-বিশা সড়কে ৩০০ বীজ রোপণ করেন। পরে ২০২১ এবং চলতি বছরে নন্দীগ্রাম উপজেলার একাধিক সড়কে তাঁরা আরও প্রায় ৬ হাজার বীজ রোপণ করেন।

চলতি বছর নন্দীগ্রামের পাশাপাশি তাঁরা বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার গ্রামীণ সড়ক এবং মহাসড়কের পাশে তালবীজ রোপণ শুরু করেছেন। এই মৌসুমে তাঁরা ২০ হাজার বীজ রোপণের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নেমেছেন। তবে চাহিদা অনুযায়ী বীজ না পাওয়ায় তাঁরা এখন জেলার বাইরে থেকে কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রোপণ করা গাছের মালিকানা সড়কসংলগ্ন জমি বা বসতবাড়ির মালিকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এতে স্থানীয় গ্রামবাসীও তালবীজ রোপণ কর্মসূচি নিয়ে বেশ উৎফুল্ল।

মূলত গ্রামের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ এবং তাদের উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার জিয়ানগরের একদল তরুণ 'এডুকেশন ফাউন্ডেশন' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলেন। নিজ এলাকার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যাতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারেন সে জন্য শুরুতে তাঁরা স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ ক্লাস নেন। তবে নিজেদের অবর্তমানে শিক্ষা বিস্তারের এই কাজ যাতে বন্ধ হয়ে না যায় সেই কারণে ওই তরুণরা তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সম্পৃক্ত করেন। ওই সংগঠনের পক্ষ থেকে দরিদ্র এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য পরবর্তী সময়ে শিক্ষাবৃত্তিও চালু করা হয়। তাঁদের ওই কার্যক্রম বগুড়ার অপর দুই উপজেলা শাজাহানপুর ও নন্দীগ্রাম এবং পাশের জেলা জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলা এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। চলমান ওই কার্যক্রমের পাশাপাশি সংগঠনের সদস্যরা এখন প্রকৃতি ও পরিবেশের উন্নয়নেও বেশ মনোযোগী হয়েছেন।

সম্প্রতি বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার জিয়ানগর হাট থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে সোনারপাড়ামুখী সড়কে পা ফেলতেই সবুজ রঙের একটি সাইন বোর্ড চোখে পড়ে। তাতে সবার ওপরে সাদা রঙে ছোট করে লেখা, 'ভালো মানুষ হও এবং ভালো মানুষ হতে সাহায্য করো'। এর পরের লাইনে লেখা হয়েছে, 'মানুষ, প্রকৃতি এবং পশুপাখির উপকারের জন্য ১ লাখ তালগাছ লাগানো প্রজেক্টের অংশ হিসেবে জিয়ানগর থেকে সোনারপাড়া রাস্তার দুই পাশে তালবীজ রোপণ করা হয়েছে।'
ওই সড়কের মতো জিয়ানগর ইউনিয়নের অধীনে আরও ৬টি গ্রামীণ সড়কেও 'এডুকেশন ফাউন্ডেশনের' টানানো সাইন বোর্ড ঝুলছে। সংগঠনটির সদস্য বগুড়া সরকারি শাহ্‌ সুলতান কলেজ থেকে সদ্য মাস্টার্স পাস করা রাসেল সোনার জানান, ২০২১ সালের অক্টোবরে ৭টি সড়কে মোট ৭ হাজার তালবীজ রোপণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এসব সড়কের পাশাপাশি দুপচাঁচিয়া থেকে আক্কেলপুরগামী আঞ্চলিক মহাসড়কের দুই পাশেও তালগাছের বীজ রোপণ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি ওই এলাকার গ্রামগুলোর মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি খালের দুই ধারেও তালবীজ রোপণ করা হয়েছে।

সড়কগুলো ঘুরে দেখা গেছে, এক বছর আগে রোপণ করা তালবীজ থেকে দেড়-দুই ফুট লম্বা পাতা বের হয়েছে। আব্দুল হান্নান নামে সোনারপাড়া গ্রামের এক বাসিন্দা জানান, একসময় তাঁদের এলাকায় অনেক তালগাছ ছিল। কিন্তু নানা কারণে অধিকাংশ গাছই কাটা পড়েছে। তিনি বলেন, 'আমাদের গ্রামের ছেলেদের লাগানো তালগাছগুলো যেন গবাদি পশু খেয়ে ফেলতে না পারে সেজন্য আমরা সবসময় সতর্ক থাকি।'

এডুকেশন ফাউন্ডেশনের অপর সদস্য সাদেকুল ইসলাম জানান, এবার তাঁরা দুপচাঁচিয়ার জিয়ানগর এবং নন্দীগ্রামের অর্ধশতাধিক সড়কে তালবীজ রোপণ শুরু করেছেন। পাঁচ বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের মধ্যে ১ লাখ তালবীজ রোপণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য চলতি বছর অক্টোবরের মধ্যেই তাঁরা ২০ হাজার তালবীজ রোপণ করতে চান।

এরই মধ্যে গত ৯ সেপ্টেম্বর নন্দীগ্রাম উপজেলার নামুট তিনমাথা থেকে পাকুরিয়াপাড়া সড়কে ৭০০ তালবীজ রোপণ করা হয়েছে। সেখানে অন্য সড়কগুলোতেও তালবীজ রোপণের জন্য বীজ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এর পাশাপাশি দুপচাঁচিয়ার জিয়ানগর থেকে খিদিরপাড়াসহ এ অঞ্চলে যেসব সড়ক এখনও বাকি আছে, সেগুলোতে পর্যায়ক্রমে তালবীজ রোপণ করা হবে। তবে একসঙ্গে রোপণের জন্য এত বিপুল বীজ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, আমরা সাধারণত পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে তালগাছের মালিকদের কাছ থেকে বিনামূল্যে বীজ সংগ্রহ করে থাকি। গাছ মালিকরা খুশি হয়েই আমাদের বীজ দেন। কিন্তু গ্রামে তালগাছের সংখ্যা আগের চেয়ে কমে যাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী বীজ সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না।

সে কারণে আমরা আশপাশের জেলা থেকে বীজ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
এত গাছ থাকতে তালবীজ রোপণ কেন- এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল এডুকেশন ফাউন্ডেশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মো. লুৎফর রহমান লিটনের কাছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হওয়া তরুণ এই প্রকৌশলী বলেন, তালগাছ আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য অনেক উপকারী। তালগাছের পাতা দিয়ে হাতপাখা, টুপি, ঝুড়ি ও ব্যাগসহ নানা ধরনের ব্যবহার্য পণ্য তৈরি হয়; এমনকি এসব সামগ্রী বিদেশেও রপ্তানি করা যায়। এ ক্ষেত্রে গ্রামের মানুষ বিশেষত নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এ ছাড়া তালগাছের রস দিয়ে গুড় এবং পাকা তালের রস দিয়ে সুস্বাদু অনেক খাবার তৈরি হয়। তালগাছের কা খুব শক্ত হওয়ায় গ্রামীণ জনপদে বসতবাড়ি নির্মাণে কাজে লাগে।


আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি সান মার্কোসে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত লুৎফর রহমান লিটন বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তালগাছ বজ্রপাত থেকে আমাদের রক্ষা করে। আমরা সবাই জানি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সাম্প্রতিককালে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বেড়েছে। যার প্রভাবে বজ্রপাতও বেড়েছে। আকস্মিক সেই বজ্রপাতে গ্রামাঞ্চলে যারা ক্ষেতখামারে কাজ করতে কিংবা খাল-বিলে মাছ ধরতে যান তাঁদের মৃত্যুও বেড়েছে। গবেষণা বলছে, বজ্রপাত হওয়ার আগে মেঘের ওপরের দিকে নেগেটিভ চার্জ এবং নিচের দিকে পজিটিভ চার্জ জমা হয়।

পজিটিভ চার্জের পরিমাণ অনেক বেশি হলে তা ডিসচার্জ হওয়ার জন্য মাটির দিকে আসে। কারণ মাটি নেগেটিভ চার্জের আধার। অন্যদিকে ভেজা গাছ বিদ্যুৎ সুপরিবাহী হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া গাছের মূল গভীরে ভেজা মাটিতে স্পর্শ করে। অন্যভাবে বললে বায়ুম ল অপেক্ষা ভেজা গাছ দিয়ে কম বাধায় সহজে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। তাই আকাশ থেকে পজিটিভ চার্জ ডিসচার্জ হওয়ার সময় যদি উঁচু কোনো কিছু থাকে তাহলে সেই পথে পজিটিভ চার্জ মাটিতে আসে। তালগাছ যেহেতু অনেক উঁচু হয় তাহলে উত্তম পরিবাহী হিসেবে সেটির ওপরই বেশি বজ্রপাত হয়। এতে আশপাশের এলাকা নিরাপদ থাকে। তালগাছ এমন এক গাছ যেটি দুর্যোগে মানুষের জীবন বাঁচায়, আবার জীবিকা নির্বাহ এবং উৎকৃষ্ট খাদ্যও জোগান দিয়ে থাকে। এসব কারণে আমরা অনেক চিন্তাভাবনা করে গ্রামে গ্রামে তালগাছের সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

এডুকেশন ফাউন্ডেশনের সদস্য রাসেল সোনার জানান, রোপণের তিন বছর পর তালগাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করা সম্ভব। সেই তাল পাতা দিয়ে মা-বোনরা যাতে টুপি, ঝুড়ি এবং ব্যাগসহ ব্যবহার্য সব পণ্য তৈরি করে বাড়তি পয়সা রোজগার করতে পারেন সেজন্য তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও আমরা করতে চাই। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে যেসব এলাকায় ওইসব পণ্য তৈরি করা হয়, সেসব এলাকায় গিয়ে আমরা তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে কথাও বলেছি।
দুপচাঁচিয়া উপজেলার খিদিরপাড়া গ্রামের কৃষক আক্তার হোসেন জানান, আগে বজ্রপাত হলেও এত মানুষ মারা যায়নি। যে কারণে এখন আকাশে মেঘ দেখলেই ঘর থেকে বের হতে ভয় হয়। বজ্রপাতের হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে গ্রামের লোকজন তালবীজ রোপণ করবেন বলে জানিয়েছেন। আমরা তাঁদের অপেক্ষায় আছি।

এডুকেশন ফাউন্ডেশনের সভাপতি দুপচাঁচিয়া বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুল ও কলেজের শিক্ষক তোতা মিয়া জানান, গ্রামগুলোতে এমনিতেই কৃষি শ্রমিকের সংকট রয়েছে। সাম্প্রতিককালে বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় কৃষিকাজে নিয়োজিতদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে রক্ষা করতে হলে কৃষিকাজে নিয়োজিতদের সুরক্ষা দিতে হবে। সেই পরিকল্পনা থেকেই আমরা গ্রামে গ্রামে তালগাছের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা বীজ রোপণ করলেও গাছের মালিকানা সম্পূর্ণ স্থানীয় বাসিন্দাদের। অন্য গাছের মতো তালগাছের জন্য বাড়তি কোনো যত্ন নিতে হয় না, এমনকি কোনো সারও দিতে হয় না। এসব কারণে এই কর্মসূচিতে গ্রামবাসীর সাড়াও পাচ্ছি।

দুপচাঁচিয়া উপজেলার মর্তুজাপুর গ্রামের বাসিন্দা বগুড়া জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সাবেক উপপরিচালক শহিদুল ইসলাম খান বলেন, এডুকেশন ফাউন্ডেশনের সদস্যরা অনেক আগে থেকেই গ্রামের ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী করে তুলতে কাজ কর যাচ্ছেন। এতে সফলতাও এসেছে। গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন। এর পাশাপাশি ২০২০ সাল থেকে তাঁরা গ্রামে গ্রামে তালবীজ রোপণ শুরু করেছেন। শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি তালগাছের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে বজ্রপাত থেকে গ্রামবাসীর জীবন রক্ষা এবং তাঁদের জীবিকার উন্নয়নের যে উদ্যোগ তাঁরা গ্রহণ করেছেন, এটাকে কেবল টেকসই উন্নয়নের সঙ্গেই তুলনা করা চলে। যার সুফল ১০-১২ বছর পর দৃশ্যমান হবে। আমাদের এই অঞ্চলের তরুণদের নেওয়া বহুমাত্রিক এমন উদ্যোগ দেশের সব তরুণের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে বলেই আমি বিশ্বাস করি।

লেখক
ব্যুরোপ্রধান
বগুড়া

আরও পড়ুন

×