ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

বাংলাদেশের মুখ

শূন্য থেকে শুরু

শূন্য থেকে শুরু

ইজাজ আহ্‌মেদ মিলন

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২২ | ০০:২০

'স্বপ্ন সেটা নয় যেটা মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে; স্বপ্ন সেটাই যেটা পূরণের প্রত্যাশা, মানুষকে ঘুমাতে দেয় না'। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের এই অমর উক্তি রাশেদ ইবনে রেজার বাস্তব জীবনে ঘটে চলছে। স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশা ঘুম কেড়ে নিয়েছে ২৭ বছরের তরুণ রাশেদ ইবনে রেজার। এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসক রাশেদ ছোট্ট একটি টিস্যু কারখানা গড়ে তুলেছিলেন বছর পাঁচেক আগে। সেই ছোট্ট কারখানা এখন প্রসারিত হয়েছে কয়েকগুণ।

মেরিন ইঞ্জিনিয়ার বা সামুদ্রিক প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকতেন শৈশবে। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে বড় হতে থাকলেও শেষ পর্যন্ত আর ওদিকে পা বাড়ানো হয়নি। ছেলেকে নিয়ে বাবা-মায়ের স্বপ্নও তো কম ছিল না। স্কুলশিক্ষক বাবা চাইতেন একমাত্র ছেলে রাশেদ বড় হয়ে ডাক্তার হবে, সেবা করবে মানুষের। স্কুলশিক্ষিকা মায়েরও পক্ষপাতিত্ব ছিল রাশেদের বাবার স্বপ্নের প্রতি।

অবশ্য পিতা-পুত্রের এই স্বপ্নের দ্বন্দ্ব বেশি দিন টেকেনি। বাবা-মায়ের প্রতি সম্মান জানিয়ে নিজেই সরে আসেন সামুদ্রিক প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন থেকে। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের চকপাড়া গ্রামের রেজাউল হকের ছেলে রাশেদ ইবনে রেজা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে বাবা-মায়ের ইচ্ছাকে পূরণ করতে ভর্তি হন এমবিবিএস-এ। চীনের হেনান প্রদেশের জিয়াংজু সিটির বিখ্যাত জিয়াংজু মেডিকেল কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এমবিবিএস পাস করে দেশে ফিরে আসেন রাশেদ। বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে প্র্যাকটিস চালাতে থাকেন। কিন্তু মন বসে না। এমবিবিএস পড়ার সময়ই উদ্যোক্তা হওয়ার বাসনার বাসা বাঁধে মনে।

এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি নিয়ে আসেন ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখতেও যে সাহসের প্রয়োজন হয়-এটা ভালো করেই জানেন রাশেদ। বুকে অসীম সাহস আর পরিশ্রমকে সঙ্গী করে শুরু হয় তাঁর নতুন পথের যাত্রা। চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে শ্রীপুরের নিভৃত পল্লি চকপাড়ায় এক খণ্ড পতিত জমিতে ছোট্ট একটি শেড তৈরি করে শুরু করেন টিস্যু উৎপাদন। শুরুর দিকে পরিবার ছাড়া কারও উৎসাহ বা প্রেরণা পাননি রাশেদ।


প্রথমে চীন থেকে ছোট দুটি কনভার্টিং মেশিন কিনে আনেন তিনি। আমদানি করা মেশিন দুটি স্থাপন করেন ছোট্ট সেই ঘরে। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা এটা। ২-৩ জন শ্রমিকও নিয়োগ দেন তিনি। কাঁচামাল সংগ্রহ, উৎপাদন, উৎপাদিত টিস্যু বাজারজাতকরণ, হিসাব রাখা- সব কিছু একাই করতে হয় তাঁকে। কোম্পানির নাম দেওয়া হয় ওমেগাল বাংলাদেশ লিমিটেড। আর উৎপাদিত পণ্যের নাম দেওয়া হয় ওমেগাল টিস্যু। স্থানীয় বাজারে ওমেগাল টিস্যুর একটা চাহিদা তৈরি হয়।

প্রথম দিকে অন্য কোম্পানি থেকে টিস্যুর রোল কিনে প্রক্রিয়াজাত করতেন। পরে সেগুলো প্যাকেট করে বাজারে দিতেন। তখন মাসে গড়ে সর্বোচ্চ ১০ টন টিস্যু বাজারজাত করতে পারতেন। এভাবেই চলতে থাকে ৩-৪ বছর। রাশেদকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। লাভের মুখ দেখতে থাকেন শুরু থেকেই। কারখানায় বাড়াতে থাকেন শ্রমিকের সংখ্যা। খুঁজতে থাকেন উযোগী জমি কিংবা বন্ধ হয়ে যাওয়া কোনো কারখানা। পেয়েও যান। পার্শ্ববর্তী সিংগারদীঘি গ্রামে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি কারখানা ভাড়া নিয়ে ওমেগাল বাংলাদেশ লিমিটেড স্থানান্তর করেন রাশেদ।

ছয় বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বন্ধ ওই কারখানা। ওই কারখানায় আগে টিস্যুই তৈরি হতো। মাসিক ৩ লাখ টাকায় ভাড়া নিয়ে শুরু করেন নতুন উদ্যমে উৎপাদন। প্রায় ৭০ লাখ টাকা খরচ করে সেখানে রাশেদ নতুন বয়লার স্থাপন করেন। চলতি বছরের গোড়ার দিকে ৩৫ জন শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে সেখানে শুরু করেন টিস্যু উৎপাদন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নিজেই সংগ্রহ করেন কাঁচামাল। বর্তমানে রাশেদের কারখানায় প্রতি মাসে ১২০-১৫০ টন টিস্যু উৎপাদন হচ্ছে। তরুণ উদ্যোক্তা রাশেদ ইবনে রেজা বলেন, টিস্যু জাম্প রোল কিনে যাঁরা কনভার্ট করেন তাঁরাই আমাদের মূল গ্রাহক।

এখান থেকে টিস্যুর রোল কিনে নিয়ে তাঁরা নিজেদের নামে বাজারজাত করেন। রাশেদের কারখানায় অন্তত ৫০ টন নিজস্ব ব্র্যান্ডে বাজারে যায়। রাশেদের মা স্কুলশিক্ষিকা সালমা বেগম বলেন, ছেলের প্রতি আমাদের অগাধ বিশ্বাস ছিল, সে পারবেই। আমাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করেনি রাশেদ। ৩০-৩৫ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান করেছে, উৎপাদনের বলয় বাড়িয়েছে। রাশেদের বাবা রেজাউল হক বলেন, চীন থেকেই ব্যবসার ধারণা নিয়ে সে দেশে ফিরে এসেছিল। প্রথম দিকে কিছুটা ভয় হতো, নিজের মেধা আর প্রজ্ঞা দিয়ে ছেলে তার উদ্যোগকে বেশ দূর নিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, আমার ইচ্ছা ছিল ছেলে ডাক্তার হবে, সে ডাক্তার হয়েছে। তবে উদ্যোক্তা হওয়াটা বেশি উপভোগ করছি। কারখানার শ্রমিক জাহিদ হাসান বলেন, শ্রমিকের সঙ্গে মালিকের চেয়ে হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার, এটা সচরাচর চোখে পড়ে না। শ্রমিকদের সামনে নিজেকে কখনও বস হিসেবে হাজির করেন না রাশেদ। এই বিনয় তাঁকে আরও বহু দূর নিয়ে যাবে।
লেখক
গাজীপুর
প্রতিনিধি

আরও পড়ুন

×