বাংলাদেশের মুখ
আলোর দিশারি

মেরিনা লাভলী
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২২ | ০০:২০
পিছিয়ে থাকা উত্তরাঞ্চলের মানুষদের চক্ষু চিকিৎসায় অবদান রেখে চলেছেন। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বিনামূল্যে চোখের আলো ফিরিয়েছেন অর্ধলক্ষাধিক মানুষের। চক্ষুসেবায় বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপন করে কৃষক, খেটে খাওয়া দিনমজুরের চক্ষুসেবা নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন আলোর দিশারি ডা. খায়রুল ইসলাম দীপু। সপ্তাহে পাঁচ দিন গ্রাম-গঞ্জ, চরসহ প্রত্যন্ত এলাকায় কখনও বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিনামূল্যে চক্ষুশিবির করে চিকিৎসা দিচ্ছে ডা. দীপুর বিশেষজ্ঞ দল। তাঁর উদ্যোগে স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের চোখের স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে গঠন করা হয়েছে দৃষ্টি কর্নার। চোখের স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে 'চক্ষু স্বাস্থ্যসেবায় হিরো' পদক পেয়েছেন ডা. দীপু। তাঁর আওতায় শত শত মানুষের কর্মসংস্থানও হয়েছে।
রংপুর নগরীর প্রাণকেন্দ্র থেকে সাড়ে ৫ কিলোমিটার দূরে দর্শনায় তিনি 'দীপ আই কেয়ার ফাউন্ডেশন' প্রতিষ্ঠা করেছেন। পাকা সড়কের পাশে প্রতিষ্ঠানে ঢুকতেই যে কোনো সেবাপ্রত্যাশীর চোখ জুড়িয়ে যাবে সবুজ গাছ-গাছালি ও ভবনের নান্দনিক স্থাপত্যকলা দেখে। সবুজে মোড়ানো চারদিক। ভেতরে পরিপাটি-চাকচিক্য পরিবেশে রোগীর সেবা নেওয়ার ব্যবস্থা। প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ আসছেন এ প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে। রংপুর বিভাগসহ আশপাশের বিভাগ থেকে মানুষের আগমনে প্রতিদিন ভিড় লেগে থাকে এ বিশেষায়িত হাসপাতালে।
যেভাবে শুরু
রেল কর্মকর্তা শাহ্ আমিরুজ্জামানের বড় ছেলে ডা. খায়রুল ইসলাম দীপু। রংপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে রংপুর মেডিকেল কলেজে তিনি লেখাপড়ার সুযোগ পান। এরপর ঢাকায় ডিপ্লোমা ইন অফথামোলজি এবং লন্ডন স্কুল অ্যান্ড হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন থেকে কমিউনিটি আই হেলথ বিষয়ে এমএসসি অর্জন করেছেন। সরকারি মেডিকেল কলেজে লেখাপড়ার সময় থেকে দেশের মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা জাগে ডা. দীপুর মনে। এরপর লেখাপড়া শেষ করে উত্তরাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনপদ রংপুরের সুবিধাবঞ্চিত অসচ্ছল মানুষকে উন্নত চক্ষুসেবা দেওয়ার লক্ষ্যে কার্যক্রম চালু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের ৯ অক্টোবর তাঁর নিজস্ব পৌনে ২ একর জমির ওপর 'দীপ আই কেয়ার ফাউন্ডেশন' প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠানে যুক্ত করেন চক্ষুসেবার আধুনিক যন্ত্রাংশ, প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল।
চক্ষুসেবা প্রদানে উদ্যোগ
উত্তরাঞ্চলের অসচ্ছল রোগীদের একই ছাদের নিচে চোখের অনেক ধরনের সেবা স্বল্প মূল্যে নিশ্চিত করেছেন ডা. দীপু। তিনি দীপ আইকেয়ার ফাউন্ডেশনে ১০০ টাকার টিকিটের মাধ্যমে রোগীদের চোখের নানা পরীক্ষাসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। সেই সঙ্গে রোগীদের স্বল্প খরচে অপারেশনসহ পরবর্তী কাউন্সেলিং করাও হচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ডা. দীপুর নেতৃত্বে এ প্রতিষ্ঠানে ১৬ লাখ ৮৬ হাজার ১১১ জন রোগীকে চক্ষুসেবা দেওয়া হয়েছে। তিনি এ হাসপাতালে ছানি অপারেশনসহ পেডিয়াট্রিক অপথামোলজি, ভিট্রিও রেটিনা, অরবিট অকুলোপ্লাস্টি, কর্নিয়া ও গ্লুকোমা বিভাগ চালু করেছেন। অপরিণত শিশুদের অন্ধত্বের হাত থেকে রক্ষায় ডা. দীপু উত্তরবঙ্গে প্রথমবারের মতো একটি রেটিনোপ্যাথি অব প্রিম্যাচুরিটি স্ট্ক্রিনিং সেন্টার চালু করেছেন। ৩৫ সপ্তাহের আগে জন্ম নেওয়া শিশুদের রেটিনায় রক্তক্ষরণ সৃষ্টি হলে এ সেন্টারের মাধ্যমে ওই শিশুর চোখের সঠিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ডা. দীপু তাঁর প্রতিষ্ঠানে মরণোত্তর চক্ষুদানের কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে অন্ধত্ব থেকে মুক্তির সুযোগ তৈরি করেছেন। ইতোমধ্যে দুই ব্যক্তি এই সুবিধা পাওয়ার পর আরও ২০ জন দৃষ্টিহীন অসচ্ছল মানুষ এ ফাউন্ডেশনে কর্নিয়া চেয়ে আবেদন করেছেন।
এছাড়া দেশে ডায়াবেটিক রোগীর হার বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের চোখে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি রোগ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় একজন রোগীকে অনিরাময়যোগ্য অন্ধত্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ থেকে উত্তরাঞ্চলের মানুষকে রক্ষায় দেশে প্রথমবারের মতো বিশেষায়িত এ হাসপাতালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি স্ট্ক্রিনিং সেবা চালু করা হয়েছে। নামমাত্র মূল্যে এ সেবার ব্যবস্থা করেছেন ডা. দীপু। সেই সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সূলভ মূল্যে অস্ত্রোপচারেরও ব্যবস্থা করেছেন তিনি।
চক্ষুসেবা দেওয়ার দীর্ঘ ১৪ বছরে ডা. দীপুর এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৮৭ হাজার ৯৭৩টি চোখের ছানি অপারেশন করা হয়েছে। এর মধ্যে শিশু রয়েছে প্রায় দেড় হাজার। বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসা লক্ষাধিক মানুষের চোখের অপারেশন করা হয়েছে। তিন হাজারেরও বেশি চক্ষুশিবিরের মাধ্যমে বিনামূল্যে চোখের ছানি অপারেশন করা হয়েছে ৪৫ হাজার ৩৩১টি। ৩৫ জন চিকিৎসকসহ ২৩০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর এ প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে।
এর মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগই নারী। দীপ আই কেয়ার প্রতিষ্ঠার আগে চক্ষুসেবা খাতে রংপুরের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলে প্রায় ২শ জন রোগী প্রতিদিন চিকিৎসা নিতেন। এখন এ প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন ১ হাজারের বেশি রোগী চোখের সেবা নিচ্ছেন। প্রতিদিন অস্ত্রোপচার হচ্ছে গড়ে ১০০ জনের। এর মধ্যে প্রতিদিন ক্যাম্প থেকে আসা ৪০ থেকে ৫০ জনের চোখের ছানি বিনামূল্যে অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে।
চক্ষুসেবার ফেরিওয়ালা
ডা. দীপুর চিকিৎসক দল অনেকটা ফেরি করে বিনামূল্যে চক্ষুসেবা দিয়ে যাচ্ছে। প্রতি শনি থেকে বুধবার রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় চিকিৎসক দল ক্যাম্প করে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ছানিপড়া রোগীদের বিনামূল্যে অপারেশনের জন্য নির্বাচন করেন। এরপর প্রতিষ্ঠানের বাসে করে হাসপাতালে নিয়ে আসা, চোখের অস্ত্রোপচার, অপারেশন-পরবর্তী রাত্রিযাপন ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে এ প্রতিষ্ঠান থেকে।
চক্ষুসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য ডা. দীপু ২০১৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান শহরে অন্ধত্ব নিরসনে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক পুরস্কার ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর দ্য প্রিভেনশন অব ব্লাইন্ডনেস কর্তৃক 'আই হেলথ হিরো-২০১৬' পুরস্কার পান। বাংলাদেশ থেকে তিনিই প্রথম চক্ষুসেবার মর্যাদাপূর্ণ এ পুরস্কার অর্জন করেন।
ডা. খায়রুল ইসলাম দীপু জানান, অন্ধত্ব ও ক্ষীণদৃষ্টি সম্পর্কিত জাতীয় জরিপ অনুযায়ী, দেশে অন্ধ মানুষের সংখ্যা সাড়ে ৭ লাখ। প্রতি বছর নতুন করে ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষ অন্ধত্ববরণ করছেন। অথচ দেশে মাত্র ১ হাজার ২০০ জনের মতো চক্ষু চিকিৎসক রয়েছেন। চক্ষু চিকিৎসককে রোগ নির্ণয় ও রোগ সম্পর্কিত বিভিন্ন কাজে সহায়তা প্রদানকারী অফথালমিক অ্যাসিসট্যান্ট (এমএলওপি) রয়েছেন মাত্র ৭০০ জন। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে একজন চক্ষু চিকিৎসকের বিপরীতে ৪ জন এমএলওপি থাকা প্রয়োজন। এমএলওপি তৈরির লক্ষ্যে উত্তরবঙ্গে প্রথম দীপ ইনস্টিটিউট অব কমিউনিটি অফথালমোলজি নামে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। এখান থেকে প্রশিক্ষিত জনবল একদিকে যেমন চক্ষু চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের চক্ষু সেবা প্রদানে সহায়তা করে দেশের অন্ধত্ব নিবারণে ভূমিকা রাখবে, তেমনি বিভিন্ন হাসপাতালে নিজেদের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারবে।
ডা. দীপু আরও বলেন, 'আমি দেশের ৪টি স্থানে আমার প্রতিষ্ঠানের মতো আরও ৪টি বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং ২০টি স্থানে ভিশন সেন্টার স্থাপন করব। ভিশন সেন্টারে আমাদের প্রশিক্ষিত জনবল থাকবে এবং তাঁরা প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের চোখের প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন এবং রংপুর থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চিকিৎসা প্রদান করবেন। এতে করে চরসহ বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের অর্থ ও কর্মঘণ্টা বাঁচবে। আমরা ৩০০ স্কুলে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার শিশুর চোখ পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছি। এ ছাড়া এ প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে দর্শনাতেই পথশিশুদের জন্য একটি স্কুল তৈরি হচ্ছে। যেখানে প্রতি বছর ৫০ জন শিশুকে বিনামূল্যে পড়াশোনা করার সুযোগ দেওয়া হবে। তারা প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ পাবে।' তিনি আরও বলেন, 'মানুষের চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনা গেলে তাঁরা কর্মক্ষম হবেন। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে এবং পরিবারের বোঝা হয়ে থাকবেন না কেউ। আমি সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছি। বিনা চিকিৎসায় উত্তরাঞ্চলসহ দেশে অন্ধত্ব ঠেকাতে এমন অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করছে আমার দীপ আই কেয়ার ফাউন্ডেশন।'
লেখক
রংপুর
প্রতিনিধি
- বিষয় :
- প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২০২২
- ১৮ বছরে সমকাল