বাংলাদেশের মুখ
অসহায় মানুষের পাশে

হাসান হিমালয়
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২২ | ০০:১৯
বিয়ে বা পারিবারিক যে কোনো অনুষ্ঠানের খাবার বেঁচে যাওয়া নিত্যদিনের ঘটনা। কী করেন এসব বেঁচে যাওয়া খাবার দিয়ে? আত্মীয়স্বজনকে বিতরণ অথবা ডিপ ফ্রিজে রেখে দেন। দু'একদিন ঘরে রেখে ফেলেও দেন অনেকে। কিন্তু বেঁচে যাওয়া এই খাবার যদি অসহায় কারও মুখে হাসি ফোটায়, কেমন হয়?
প্রশ্নটা বেসরকারি একটি কোম্পানির প্রকৌশলী শাহরিয়ার কবির মেঘের। যার উত্তর খুঁজতে পাঁচ বছর আগে নগরীর জাতিসংঘ পার্কে হাজির হয়েছিলেন ৪০ জন স্বপ্নবাজ তরুণ। তারপরের গল্পটা স্বপ্নের মতোই।
গত ৫ বছর ধরে বিভিন্ন মানুষের পারিবারিক অনুষ্ঠানের বেঁচে যাওয়া খাবার অসহায় দুস্থ মানুষের মুখে তুলে দিতে কাজ করছেন তাঁরা। দিন-রাতের যে কোনো সময় তাঁদের হটলাইনে (০১৯৯৯-২৬০১৫০) ফোন দিলেই স্বেচ্ছাসেবকরা পৌঁছে যাচ্ছেন বাড়িতে। তাঁরা নিজেরাই প্যাকেট করে আপনাকে সঙ্গে নিয়েই এসব খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন অর্ধাহারে থাকা মানুষের ঘরে।
তরুণদের এ সংগঠনের নাম ফুড ব্যাংকিং কল্যাণ সংস্থা। গত ৫ বছরে ১ হাজার ৬৮১টি অনুষ্ঠানের (২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) খাবার দুস্থদের মাঝে বিতরণ করেছেন। বেঁচে যাওয়া খাবার বিতরণের জন্য খুলনার সব মানুষের কাছে পরিচিত সংগঠনটি।
পাঁচ বছর পরে এসে তাঁদের কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তাঁরা এখন দুস্থ-অসহায়দের মাঝে পোশাক বিতরণ করেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অসহায় নারীদের সেলাই মেশিন, পুরুষদের রিকশা, ভ্যান, চা ও মুদি দোকানে সরঞ্জাম বিতরণ করছেন। সম্প্রতি বন্যার সময় তাঁরা খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন সিলেটে। সেনা সদস্যদের সঙ্গে দুর্গম এলাকায় এসব বিতরণ করেছেন।
করোনার সময়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল সংগঠনটি। লকডাউনের ওই দুঃসময়ে কর্মহীন পরিবারের মাঝে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া, চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছেন তাঁরা।
এর বাইরে স্কুল-কলেজ, নগরীর অভিজাত ফুডকোর্ট এবং বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানের ক্লাবগুলোতে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালান। একজনের নষ্ট করা খাবার, কত অনাহারি মানুষের মুখে পুষ্টি তুলে দিতে পারে তা বোঝানোর চেষ্টা করেন উচ্চবিত্ত মানুষদের।
বড় ছুটির আগে বের হয়ে পড়েন বড় কোনো বিনোদন স্পটে। গত ঈদেই এ সব তরুণ ছুটে যান কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে। সৈকতে জনসচেতনতামূলক নির্দেশনা লাগানো ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভাইরাল হয়েছে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর বিকেলে তাঁদের কার্যালয়ে এসে দুটি পাঞ্জাবি, দুটি শার্ট ও একটি লুঙ্গি দিয়ে গেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি। খাবার বিতরণের যে সব ছবি সংগঠনটির ফেসবুক পেজে প্রচার করা, তার বেশিরভাগই থাকে খালি গায়ে। অসহায় মানুষকে জামাকাপড় পৌঁছে দিতে সংগঠনটির শরণাপন্ন হয়েছেন তিনি। শীতের সময় এই কার্যক্রম বেড়ে যায়।
যেভাবে চলছে কার্যক্রম
খুলনা ফুড ব্যাংকিংয়ের উদ্যোক্তা শাহরিয়ার কবির মেঘ জানান, বেঁচে যাওয়া খাবার দুস্থদের মাঝে দিয়ে দেওয়ার কথা অনেকেই ভাবেন। তাঁদের সঙ্গে অসহায় মানুষগুলোর মিলন ঘটিয়ে দিই আমরা।
মেঘ জানান, আইডিয়াটা প্রথম তাঁর মা দেন। পারিবারিক একটা অনুষ্ঠানের বেঁচে যাওয়া খাবার এলাকার দুস্থদের মাঝে বিতরণের পর বড় পরিসরে কিছু করার পরিকল্পনা মাথায় আসে। বিষয়টি শেয়ার করেন কাছের বন্ধু ইমরান হোসেন মৃধা ও ছোট ভাই শাহরিয়ার শাওনের সঙ্গে। নগরীর শান্তিধাম মোড়ের জাতিসংঘ পার্কে মিটিং হবে। ফেসবুকে একটি ইভেন্টও খোলা হয়।
২০১৭ সালের ৪ আগস্ট জাতিসংঘ পার্কে অনুষ্ঠিত হয় সংগঠনের প্রথম মিটিং। প্রথমে দিনে মিটিংয়ে অংশ নেন ৪১ জন তরুণ। এর মধ্যে ২০ জনের মতো এখন টিকে আছে। নতুন করে যুক্ত হয়েছেন আরও ৩০ জন। তাদের স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা এখন ৫০ জন। বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া এবং সমাজসেবায় নিবন্ধন নেওয়ার কারণে তাঁরা সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রাখেন 'ফুড ব্যাংকিং খুলনা কল্যাণ সংস্থা'।
সংগঠনটির অস্থায়ী কার্যালয় নগরীর ফারাজীপাড়া এলাকার পারিজাত ভবনে (সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলীর বাসভবন)। ফুড ব্যাংকের সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন মৃধা জানান, প্রথম দিকে অনুষ্ঠানের খাবার বেঁচে গেলে মানুষ তাঁদের ফোন দিত। ফেসবুক পেজ ও গ্রুপ থেকে তাঁদের হটলাইনে যোগাযোগ করে অনেকে জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকী ও মিলাদের খাবার তাঁদের দিয়েছেন। তাঁরা দাতাদের সঙ্গে নিয়েই এসব খাবার বিতরণ করেছেন। সাধারণত খাবার প্যাকেট করে নগরীর গল্লামারী, সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ করা হয়।
ধীরে ধীরে বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্টও তাঁদের ফোন দেওয়া শুরু করে। খুলনার নামিদামি অনেক রেস্টুরেন্ট থেকে তাঁরা ফোন পান। তাঁদের বেঁচে যাওয়া খাবার বিতরণ করা হয়। বড় একটি হোটেল দুস্থ শিশুদের খাওয়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তাঁরা শিশুদের নিয়ে যান।
সংগঠনের অন্যান্য কার্যক্রম
সংগঠনের সদস্যরা জানান, দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ করতে গিয়ে বিশাল এক নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে সংগঠনটির। মানুষ এখন যে কোনো ভালো কাজ করতে গেলে তাঁদের শরণাপন্ন হন। সমাজের অনেকের অর্থ আছে কিন্তু মানুষের পাশে দাঁড়ানো বা উপযুক্ত মানুষ খুঁজে পান না। দাতা ও গ্রহীতার মাঝে যোগাযোগ করিয়ে দেন তাঁরা।
এর বাইরে সংগঠনটির পৃথক স্বাবলম্বী কার্যক্রম রয়েছে। দুটি ফান্ডের মাধ্যমে এই কাজ পরিচালনা করা হয়।
স্বেচ্ছায় অনেকে বেকার বা অসহায় কাউকে স্বাবলম্বী করতে রিকশা, ভ্যান, সেলাই মেশিন, মুদি দোকানের মালপত্র কিনে দেন। আবার অনেকে নিজের জাকাতের টাকা ফুড ব্যাংকিং কল্যাণ সংস্থার জাকাত ফান্ডে দান করেন। তাঁরা জাকাতের টাকা সুনির্দিষ্ট খাতগুলোতে ব্যয় করেন। ফুড ব্যাংকিং কল্যাণ সংস্থার স্বেচ্ছাসেবক মাওলানা মো. জাহিদ জানান, গত দুই বছরে তাঁরা প্রায় ৫০ জনকে সেলাই মেশিন, ৫২ জনকে ভ্যান গাড়ি, ৩০ জনকে রিকশা তৈরি করে দিয়েছেন। চা এবং মুদি দোকানের মালপত্র কিনে দেওয়া হয়েছে ৬ জনকে। পুরো টাকাই সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অনুদান। অনেকে রিকশা ও ভ্যান তৈরি করে আমাদের কাছে আসেন উপযুক্ত লোক খুঁজে দিতে।
স্বেচ্ছাসেবক আমিনুর রহমান জানান, সঠিক ব্যক্তিরা যাতে স্বাবলম্বী সামগ্রী পান এজন্য সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর এবং যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরেরও সহযোগিতা নেওয়া হয়। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে তথ্য নিয়ে বেশ কয়েকজনকে হুইলচেয়ার কিনে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া যুব উন্নয়নে প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রায় ২৫ জন নারীকে সেলাই মেশিন দেওয়া হয়েছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সংগঠনের সভাপতি শাহরিয়ার কবির মেঘ জানান, দুস্থ মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতেই আমাদের কার্যক্রম শুরু। সেই কাজকেই আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিই। গত ১০ মাস ধরে আমরা বিনামূল্যে ৮০ জনের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ করি। নগরীর ময়লাপোতা মোড়ে মসজিদের কাছে আমরা বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ বুথ খুলেছি। সেখানে প্রতিদিন ৩০ জনকে খাবার দেওয়া হয়। নগরীর আরও কিছু পয়েন্টে এমন বুথ চালুর ইচ্ছা আছে।
এছাড়া নভেম্বর মাস থেকে কার্যালয়ের ভেতরে মেহমানখানা চালুর পরিকল্পনা করা হয়েছে। মেহমানখানায় প্রতিদিন ২৫ জন মানুষ বসে খেতে পারবেন। এর বাইরে বৃদ্ধদের জন্য একটি বৃদ্ধাশ্রম চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।
লেখক
খুলনা
প্রতিনিধি
- বিষয় :
- প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২০২২
- ১৮ বছরে সমকাল