ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশের মুখ

সিলেবাসের বাইরের শিক্ষক

সিলেবাসের বাইরের শিক্ষক

বিপুল সরকার সানি

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২২ | ০০:১৮

দিনাজপুর ঈদগাহ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, জন্ম ১৯৬৬ সালের ১৮ অক্টোবর। সে হিসাবে বয়স ৫৬ বছর। এই বয়সেও ছুটে বেড়ান পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর বাড়ি বাড়ি। বাল্যবিয়ে ঠেকাতে তাঁর যেন দম ফেলার ফুরসত নেই। সকাল ১০টা থেকে বিদ্যালয়ের ক্লাস ও কার্যক্রম শুরু, ছুটি বিকেল ৪টায়। এরপর প্রথমে যান যেসব শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল, তাদের বাড়িতে। এরপর রুটিনমাফিক অন্য শিক্ষার্থীদের বাড়িতে। খোঁজ নেন কোন শিক্ষার্থীর কী সমস্যা, খাতা-কলমের অর্থ সংকট আছে নাকি। থাকলে সাধ্যমতো সহযোগিতা করা। বাল্যবিয়ের শিকার হতে যাওয়া ছাত্রীদের ফিরিয়ে এনেছেন শ্রেণিকক্ষে। নিয়ে গেছেন তাদের লক্ষ্যে। মেয়েরা যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে সে জন্য নিজ উদ্যোগে তৈরি করেছেন মেয়েদের ফুটবল দল। এই দলের সদস্যরা এরই মধ্যে বেশ নাম কুড়িয়েছেন। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। বিভাগের হয়ে খেলে জাতীয় পর্যায়েও চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। যাঁদের মধ্যে একসময়ে বাল্যবিয়ের শিকার হওয়া ছাত্রীও রয়েছেন। তাঁরা আজ নিজ পায়ে দাঁড়িয়েছেন।

বলছি দিনাজপুর ঈদগাহ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমানের কথা। ৫৬ বছর বয়সী একজন শিক্ষক, যাকে কোনোভাবেই তরুণ বলা যাবে না। কিন্তু তিনি এই বয়সেও যেসব কাজ করছেন তাতে বলাই যেতে পারে- তাঁর মধ্যে তারুণ্য আছে।

২০০৬ সালের শেষের দিকে পার্বতীপুর ইন্দ্রপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বদলি নিয়ে দিনাজপুর শহরের ঈদগাহ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন শিক্ষক ফজলুর রহমান। যোগদানের দিনে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ৪৬ শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি দেখে তিনি হাজিরা খাতায় দেখলেন, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা মাত্র ৯১। শহরের মধ্যে একটি বিদ্যালয়, কিন্তু শিক্ষার্থী এত কম কেন? প্রশ্ন জাগতেই বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকদের নিয়ে আলোচনায় বসেন। জানতে পারেন, আশপাশের এলাকার লোকজন যেমন নিম্নবিত্ত, তেমনি সচেতনতার অভাব। এর পর থেকেই তিনি কাজ শুরু করলেন বিদ্যালয় নিয়ে। আশপাশের এলাকাগুলোতে দেখলেন, অনেক মেয়েই রয়েছে, যারা বিদ্যালয়মুখী নয়; অন্য বিদ্যালয়েও পড়াশোনা করে না। এরপর শুরু করলেন অভিভাবকদের বোঝানোর কাজ। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর নাম তাঁর জানা। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অভিভাবককে তিনি চেনেন। তাদের বাড়ি, পেশা তাঁর মুখস্থ এবং তাদের সবার নাম-ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর তাঁর সংগ্রহে। প্রতিদিনই বিদ্যালয়ের ছুটির পর বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন আশপাশের এলাকাগুলোতে। মেয়েদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিতে হাতে-পায়ে ধরেন অভিভাবকদের। তিনি বোঝালেন, মেয়েরা বিদ্যালয়মুখী না হলে যে তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে না।

একসময় অভিভাবকরা বুঝতে শুরু করলেন, তাঁর কথায় সায় দিয়ে মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে শুরু করলেন। প্রথমদিকে অনেক ছাত্রীকেই ভর্তির পর তাদের পড়ালেখার খাতা-কলম, নোটবইসহ বিভিন্ন উপকরণ কিনে দিতে শুরু করেন। তাঁর এই প্রচেষ্টায় বর্তমানে এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৮০। এই বিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে, তাদের অধিকাংশই স্বল্প আয়ের বা নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। এখানে অনেক শিক্ষার্থীরই বাবা নেই, অনেকের মা নেই; আবার অনেকেই এতিম।

২০০৮ সালের ঘটনা। দিনাজপুর ঈদগাহ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমান জানতে পারেন, তাঁর বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিপড়ূয়া দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এরপর একদিন খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, বিয়ে হয়ে যাওয়া ওই দুই শিক্ষার্থীর মধ্যে একজনের স্বামী মারা গেছে, আর একজনের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। বিষয়টি গভীরভাবে তাঁর মনকে আঘাত করে। তাঁর মনে হতে থাকে, হয়তো চেষ্টা করলে এ দুই শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নষ্ট হতো না। এরপর নিজে নিজে প্রতিজ্ঞা নেন, তিনি আর কোনো ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হতে দেবেন না; বরং মেয়েদের সম্পদে পরিণত করতে কাজ করবেন।

যেই ভাবা, সেই কাজ। ২০১০ সাল থেকেই শুরু করেন বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে লড়াই। শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের সচেতন করতে থাকেন বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে। দিন নেই, রাত নেই; যখনই খবর পেয়েছেন বাল্যবিয়ের, সেখানেই ছুটে গেছেন। অভিভাবকদের বুঝিয়ে বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছেন, আবারও বিদ্যালয়মুখী করেছেন ছাত্রীকে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত শতাধিক বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছেন তিনি। বাল্যবিয়ের শিকার হতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। অনেক শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন, স্কুল-কলেজে ভর্তি করছেন, শিক্ষা উপকরণ দিয়ে সহযোগিতা করছেন। বাল্যবিয়ের শিকার হতে যাওয়া অনেক শিক্ষার্থীই এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন।

২০১৪ সালের ঘটনা। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় আশামণি নামের এক মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন মা-বাবা। রাতের বেলায় সেই সংবাদ পেয়ে বিয়ে ভেঙে দেন এবং পড়ালেখার সব দায়িত্ব গ্রহণ করেন শিক্ষক ফজলুর রহমান। ওই শিক্ষার্থী এখন আহ্‌ছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালে রেডিওলজিস্ট পদে চাকরি করেন। তাঁর চাকরির অর্থ দিয়ে সংসার পরিচালনা হচ্ছে।

সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করার সময় অভিভাবকরা বিয়ে ঠিক করেন আইরিন পারভীন নামের এক শিক্ষার্থীর। ওই সময়ে বিয়ে ভেঙে দেন শিক্ষক ফজলুর রহমান। পরে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় আবারও বিয়ের প্রক্রিয়া শুরু করে পরিবার। ওই সময়েও ফজলুর রহমান তার বিয়ে ঠেকান। এখন আইরিন পারভীনের নাম দেশজুড়ে। আইরিন একজন তুখোড় ফুটবলার। বঙ্গমাতা ফুটবল প্রতিযোগিতায় খেলে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়। সেখানে গোল্ড মেডেলও পান তিনি। রংপুর বিভাগের হয়ে ঢাকায় খেলেন এবং ওই দলটি সারাদেশের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়। বর্তমানে তিনি কলেজের প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করেন।


মা-বাবার অবর্তমানে নানির কাছে মানুষ হচ্ছিল অনন্যা। ২০১৭ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগেই বিয়ে ঠিক হয়। খবর পেয়ে ছুটে যান শিক্ষক ফজলুর রহমান। নানিকে বুঝিয়ে বিয়ে ঠেকান ও দিনাজপুর উপশহর টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটে ভর্তি করে দেন। এরপর টেক্সটাইল ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে বর্তমানে তিনি ঢাকায় চাকরি করছেন। তাঁর বেতনের অর্থ দিয়ে নানির ভরণপোষণ হচ্ছে।

জুলেখার বাবা মারা গেছেন। ২০১৭ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর বিয়ে ঠিক করে পরিবার। সেই বিয়ে ঠেকান ফজলুর রহমান। এরপর তাকে ভর্তি করে দেন দিনাজপুর উপশহর টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটে। টেক্সটাইল ডিপ্লোমা সম্পন্ন করার পর বর্তমানে জুলেখা ঢাকায় চাকরি করেন।

২০১৯ সালে নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করার সময় বিয়ে ঠিক হয়ে যায় সুমী আক্তারের। শিক্ষক ফজলুর রহমান গিয়ে মাকে পড়ালেখার গুরুত্ব বুঝিয়ে বিয়ে ভেঙে দেন। পরে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ও একই ঘটনা ঘটে। এখন তিনি কলেজের প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছেন। বড় হয়ে মেয়েরা যে বোঝা নয়, সেই স্বপ্ন দেখেন সুমি আক্তার।

নূর ইসলাম বেলাল নামে একজন ফুটবলার তাঁর বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে মেয়েদের ফুটবল টিম গঠন করার প্রস্তাব দেন। পরে তাঁর কথায় উৎসাহিত হয়ে ফজলুর রহমান এই বিদ্যালয়ের ২৪ শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে মেয়েদের ফুটবল টিম গঠন করেছেন। একাধিকবার এই টিমের খেলোয়াড়রা বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। নিজ উদ্যোগে ২০১৫ সালে এই টিম গঠন করেন। এই টিমের মেয়েদের ফুটবল থেকে শুরু করে বুট-মোজাসহ যাবতীয় সামগ্রী ক্রয় করে দেন তিনি। শুধু তাই নয়, এসব সদস্যকে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি। মেয়েদের ফুটবল টিম গঠন করার পর দ্রুত বিদ্যালয়ের নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। এখন যেসব বিদ্যালয়ে মেয়েদের ফুটবল টিম রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম এ বিদ্যালয়। তারা ২০১৬ সাল থেকেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। এখানকার শিক্ষার্থীরা জেলা-উপজেলাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন।

বিদ্যালয়ের মেয়েদের ফুটবল টিম এবারও গ্রীষ্ফ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় উপজেলা ও জেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়। আগামী অক্টোবরে তারা বিভাগীয় পর্যায়ে খেলতে যাবে। এর আগে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট প্রতিযোগিতায় এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপজেলা ও জেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০১৯ সালে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বঙ্গমাতা ফুটবল প্রতিযোগিতায় দিনাজপুর জেলার হয়ে খেলে বিভাগীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। পরে এ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী বিভাগের হয়ে কেন্দ্রে খেলে এবং সেখানে রংপুর বিভাগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। মেয়েদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ফজলুর রহমান বিদ্যালয়েই গড়ে তুলেছেন ছোট একটি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র। এই কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা দেন একজন চিকিৎসক। সামান্য কিছু ওষুধও দেওয়া হয়। মেয়েদের ঋতুকালীন সমস্যা বা বয়ঃসন্ধিজনিত সমস্যার জন্য আলাদা করে শিক্ষিকা রয়েছেন। তাদের পরিবারের সদস্য ও অভিভাবকদের নিয়েও মাসিক বৈঠক হয় এই বিদ্যালয়ে। শোনা হয় তাদের কথা, চাওয়া কিংবা পরামর্শ নেওয়া হয়। ছুটির দিনগুলোতে কিংবা অবসরে শিক্ষক ফজলুর রহমান মেয়েদের নিয়ে যান গোড়-এ শহীদ ময়দানে। নিজেই খেলাধুলায় নেমে পড়েন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।

করোনাকালে প্রায় দেড় বছর বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তুফজলুর রহমানের শিক্ষা প্রদান বন্ধ ছিল না; ছিল না তাঁর কার্যক্রমও বন্ধ। প্রতিদিনই তিনি শিক্ষার্থীদের খোঁজ নিয়েছেন। মোবাইলে খোঁজ নিয়েছেন, বাড়িতে গিয়ে দূর থেকে কথা বলেছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে। করোনাকালে যাতে করে মানসিক সমস্যা না হয়, পড়ালেখার ক্ষতি না হয়- সেদিকে বুঝিয়েছেন শিক্ষার্থীদের।

শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি একজন প্রিয় শিক্ষক। সব শিক্ষার্থীই তাঁর খুব ভক্ত। যদি কোনো শিক্ষার্থী জানতে পারেন, স্যার দুই-তিন দিন বিদ্যালয়ে আসবেন না, তাহলে তাদের মধ্যে এর প্রভাব পড়ে। অনেকেই ফোন করে প্রিয় শিক্ষকের খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করেন। অনেক শিক্ষার্থীই চিন্তিত হয়ে পড়েন পিতৃতুল্য শিক্ষকের জন্য। যদি তিনি কোনো কারণে অসুস্থ হন, তাহলে শিক্ষার্থীরা খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করেন। অনেক শিক্ষার্থী সরাসরি বাড়িতে চলে আসেন শিক্ষকের জন্য। ২০২১ সালে মহামারি করোনার সময়ে তিনিও আক্রান্ত হন। অসুস্থ হয়ে প্রায় ২৬ দিন বাড়িতে ছিলেন। এ সময় অনেক শিক্ষার্থী ছুটে আসেন তাঁর বাড়িতে। শিক্ষকের খোঁজ নেন, সঙ্গে নিয়ে যান বিভিন্ন ফলমূল ও পুষ্টিকর খাবার।

এই বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীই রয়েছেন, যাঁদের বাবা নেই। তাঁরা এ শিক্ষককে বাবার মতো করে দেখেন, কখনও কখনও সন্তানের মতো আবদার করেন। তিনিও নিজ সন্তানের মতো করেই শিক্ষার্থীদের আবদার পূরণ করেন।

করোনাকালে সাইকেল নিয়ে ছুটে বেরিয়েছেন শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি, যাতে কেউ ঝরে না যায়, কেউ যাতে বাল্যবিয়ের শিকার না হয়। ওই সময়ে স্কুল বন্ধ ছিল। কিন্তু প্রতিদিন নিয়ম করে সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে সারাদিন শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি ছুটে বেরিয়েছেন এই শিক্ষক। শুধু করোনার ওই সময়টাতেই নয়, এ বিদ্যালয়ে যোগদান করার পর থেকেই তাঁর এ নেশা। স্কুল ছুটির পর তিনি নিয়ম করেই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বাড়িতে চলে যান। অভিভাবকসহ এলাকার লোকজনকে বোঝান বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে। তাঁর কথার অনুপ্রাণিত হয়ে এখন আর কোনো অভিভাবক তাঁর সন্তানকে বাল্যবিয়ে দিতে চান না। তাঁরা সবাই বুঝে গেছেন বাল্যবিয়ের কুফল। ছেলে হোক কিংবা মেয়ে- সবাই পড়ালেখার মাধ্যমে যে বড় পর্যায়ে যেতে পারে, মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করতে পারে এবং দারিদ্র্য ঘোচাতে পারে তা সম্ভব হয়েছে শিক্ষক ফজলুর রহমানের এমন উদ্যোগে। এককথায় বলা যেতে পারে, একজন শিক্ষকের কথায় বদলে যাচ্ছে একটি সমাজ। আহ্‌ছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালে চাকরি করা আশামণি বলেন, 'স্যার না হলে আজ এতদূর আসতে পারতাম না। চাকরি করতাম না। হয়তো সংসার করতাম। আজ আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি। আমার মা-বাবা ও স্বজনরা আমাকে নিয়ে গর্ব করেন। এর চেয়ে জীবনে বেশি কী প্রয়োজন হয়।'

ফুটবল খেলোয়াড় আইরিন পারভীন বলেন, 'আমাকে এখন শুধু জেলার মানুষরাই নন, সারাদেশের মানুষই জানেন। আমার স্বপ্ন, আমি একদিন জাতীয় দলের হয়ে খেলব। দেশের জন্য কিছু করব। আজ আমি এই যে স্বপ্ন দেখছি, তা আমাদের স্যারের জন্যই। স্যার না হলে আজ আমি খেলোয়াড় হতাম না।'

ঢাকার একটি টেক্সটাইলে চাকরি করা অনন্যা বলেন, 'মা-বাবার অভাব একটা সময় অনুভব করতাম। কিন্তু এখন আর তেমনটা মনে হয় না। স্যার আমার বাবার মতো। বাল্যবিয়ের হাত থেকে রক্ষা করে কলেজে ভর্তি করে দিয়েছেন। আমাকে পড়ালেখার সব সহযোগিতা করেছেন। এখন চাকরি করছি, নানিকে নিয়ে ভালো আছি।'

শিক্ষক ফজলুর রহমান বলেন, 'আমি যেসব কাজ করছি, তা আমার দায়িত্ব। আমি মনে করি, একদিন এমন সময় আসবে, যখন দেশে কোনো বাল্যবিয়ে থাকবে না। শুধু বাল্যবিয়েই নয়, মেয়েরা বর্তমানে এগিয়ে যাচ্ছে; আর তাদের আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব শিক্ষকদের মধ্যে পড়ে। আমি শুধু তাই করেছি। আমি যে একজন শিক্ষক আর আমার এই সমাজকে কিছু দেওয়ার দায়বদ্ধতা আছে, সেখান থেকেই আমার পথচলা। সব শিক্ষকই কাজ করছেন এই সমাজকে বদলে দেওয়ার জন্য।'

দিনাজপুর শিক্ষক সমিতির সহসাধারণ সম্পাদক লোকমান হাকিম বলেন, 'শিক্ষক ফজলুর রহমান এখন একটি অনুকরণীয় নাম। প্রথমে আমরা তাকে চিনতাম বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কাজ করা শিক্ষক হিসেবে। এখন তিনি ওই বিদ্যালয়ে বাল্যবিয়ের হার কমিয়েছেন, ঝরে পড়ার হার কমিয়েছেন, পাশাপাশি তাঁর শিক্ষার্থীদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। তাঁর উদ্যোগে বাল্যবিয়ের শিকার হতে যাওয়া ছাত্রীরা কেউবা খেলোয়াড়, কেউবা চাকরি করছেন। এটা একজন শিক্ষকের অনেক বড় সাফল্য। আমরা চাই, প্রতিটি বিদ্যালয়ে এমন ফজলুর রহমান গড়ে উঠুক।'
লেখক
দিনাজপুর
প্রতিনিধি

আরও পড়ুন

×