বাংলাদেশের মুখ
স্বাবলম্বী নারী উদ্যোক্তা

সাইফুল হক মোল্লা দুলু
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২২ | ০০:১১
সততা, কর্মোদ্যোগ ও কর্মস্পৃহা থাকলে চাকরি না করেও স্বাবলম্বী হওয়া যায়। এই দৃষ্টান্তই স্থাপন করলেন কিশোরগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনার্স করা তরুণ শিক্ষার্থী আফসানা কবীর লিসা (২৪)। তিনি কিশোরগঞ্জ শহরের ফিশারি রোড এলাকায় বসাবাস করেন। ২০২০ সালের কোভিড মহামারির সময় পরিবারে স্বাচ্ছন্দ্য আনার প্রয়োজনে নিজ হাতে বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানের কেক বানিয়ে তা বাজারজাত করা শুরু করেন।
প্রথম পর্যায়ে কেক তৈরি ও সরবরাহের বিষয়ে তিনি ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেন। সেই বিজ্ঞপ্তির সুবাদে শুরু হয় অর্ডার পাওয়া। ধীরে ধীরে অর্ডারের পরিমাণ বাড়তে থাকে। সেইসঙ্গে বাড়তে থাকে তাঁর কর্মব্যস্ততা। এক সময় গড়ে প্রতিদিন তিন-চারটা কেকের অর্ডার পেলেও এখন পাচ্ছেন ১৫ থেকে ১৮টির অর্ডার। এই কাজ তাঁকে শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্য যেমন দিচ্ছে, তেমনি প্রতি মাসে টাকা রোজগারের পথও খুলে দিয়েছে। মাত্র আট হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করে আজ তিনি প্রতি মাসে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকার কেক সরবরাহ করছেন। মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় করছেন। শহরে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে ইতোমধ্যে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন।
লিসা জানান, প্রথম দিকে তাঁর দু'একজন বান্ধবীর কাছ থেকে তিনি এই কাজের অনুপ্রেরণা লাভ করেন। কাজে নেমে এখন তিনি খুবই আনন্দ ও উৎসাহবোধ করছেন। তিনি বলেন, 'চাকরিই জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। চাকরি না করেও উদ্যোক্তা হয়ে চাকরির চেয়ে বেশি আয় করা সম্ভব, যেটি আমি করছি। ইতোমধ্যে লিসা 'বানি কেকস বাই আফসানা' নামের একটি ফেসবুক পেজ খুলেছেন। এই পেজের কারণেও তাঁর ব্যবসার প্রচুর প্রসার ঘটছে। লিসা জানান, একটি সুদৃশ্য ও দৃষ্টিনন্দন কেক তৈরি করতে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। ডিম, ময়দা, চিনি, ফ্রুটকালার, বাটার, ক্রিম ও বিভিন্ন সুগন্ধি কেকে ব্যবহার করতে হয়। একটি কেকে কোন উপাদান কতটুকু লাগবে, তা জানা না থাকলে ভালো ও মজাদার কেক তৈরি করা সম্ভব নয়। কাজে অধৈর্য ও তড়িঘড়ি করাও ঠিক হবে না। কাজের সময় স্থির মানসিকতায় ধৈর্যসহ মনোযোগ দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, 'যাঁরা এই স্ব-উদ্যোগী কাজে নিয়োজিত হয়ে অর্থ উপার্জন করতে চান, তাঁদের হতোদ্যম হলে চলবে না। সততার সঙ্গে পরিশ্রম করতে হবে এবং উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। তবেই তিনি সফল উদ্যোক্তা হতে পারবেন।'
লিসার বাবা ফার্নিচার ব্যবসায়ী হুমায়ূন কবীর বলেন, 'আমার তিন মেয়ের মধ্যে সবার ছোট লিসা। লিসার উদ্যোক্তা হওয়ার এই চেষ্টাকে আমি সবসময়ই সমর্থন করেছি। ওর মতো অন্য মেয়েরাও অবসর সময়ে এসব কাজে মনোনিবেশ করলে তাঁদের সংসারেও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আসবে।'
শোলাকিয়া মোল্লাবাড়ির শ্বেতা ইসলাম বলেন, 'আমি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে জানতে পেরে আমার জন্মদিনের জন্য পাঁচ পাউন্ডের একটি কেক তৈরি করতে লিসা আপুকে অর্ডার করি। দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যময় সুগন্ধিমিশ্রিত চমৎকার কেকটি পেয়ে আমি অভিভূত হয়ে যাই। তাঁর তৈরি কেকের স্বাদও অসাধারণ। গুণগত মানসম্পন্ন কেক প্রস্তুতকারক হিসেবে এখন আমি প্রায়ই তাঁর কাছ থেকে কেক আনি। আমার দেখাদেখি পরিচিত অনেকেই তাঁর কেকের নিয়মিত গ্রাহক হয়েছেন।'
শহরের একাধিক কনফেকশনারির মালিক জানান, গ্রাহকের অতিরিক্ত চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনে তাঁরা প্রায়ই লিসার শরণাপন্ন হন। লিসা তাঁদের মানসম্পন্ন কেক সরবরাহ করেন। অনার্স ও মাস্টার্স পড়ূয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, লিসা আপুর এই আয়বর্ধক উদ্যোগী কর্মকাণ্ড দেখে তাঁরাও ঘরে বসে কেক-পিৎজা ইত্যাদি তৈরি ও সরবরাহ করে আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন। এ রকম দু'জন উদ্যোক্তা হলেন ফাহমিদা আলম নোভা (২৮) ও বিএসসি (প্রকৌশল) শিক্ষার্থী খাদিজা আক্তার লিয়া (২৪)। তাঁরা বলেন, 'পড়ালেখা শেষ করে সাংসারিক কাজে যেটুকু অবসর পাই সেই সময়টা ঘরে বসে কেক অথবা পিৎজা বানিয়ে গ্রাহকদের সরবরাহ করছি। এতে কিছু আর্থিক সুবিধা হচ্ছে।'
জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতি ও নারী নেত্রী অ্যাডভোকেট মায়া ভৌমিক বলেন, 'নারীর ক্ষমতায়নের মূল জায়গা হচ্ছে তাঁর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা। আফসানা কবীর লিসার মতো আরও অনেক মেয়ে ঘরে বসে নারী উদ্যোক্তা হয়ে মাসে মাসে ভালো আয়-রোজগার করছেন। এটা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জন্যও একটি ইতিবাচক সুখবর। এ ধরনের উদ্যোক্তা নারীদের সরকারিভাবেও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া প্রয়োজন।'
ছড়াকার ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক জাহাঙ্গীর আলম জাহান বলেন, 'আমাদের মেয়েরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মসচেতন। তাঁদের কর্মস্পৃহাও প্রচুর। তাঁদের কাজে লাগাতে পারলে এ দেশে নারীর অগ্রগতি ও উন্নয়নকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। লিসা সেই সম্ভাবনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁকে অনুসরণ করে অন্য মেয়েরা এগিয়ে আসছেন- এটা আমাদের নারী সমাজের জন্য অবশ্যই ইতিবাচক উদাহরণ।'
লেখক
কিশোরগঞ্জ
প্রতিনিধি
- বিষয় :
- প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২০২২
- ১৮ বছরে সমকাল