আগামী
মননের ঔদার্যে

আতাউর রহমান
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ২৩:৫৭
আমার ধারণায়, মননের ঔদার্য ছাড়া কোনো দেশ তথা দেশের কোনো ব্যক্তি নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রস্ম্ফুটিত হতে পারে না। যুক্তি ও মুক্তচিন্তাকে প্রাধান্য দিলে একটি দেশের জনগোষ্ঠী সামগ্রিকভাবে সফল ও সার্থক হয়। মার্কস এবং এঙ্গেলস-এর সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বে কোনো ভুল নেই। নিজ নিজ ক্ষমতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী যেকোনো দেশের অধিবাসী বা জনগণ সমাজের সবাই উপার্জন করবে কিন্তু দেখার বিষয় হলো- উপার্জনের অঙ্কের পার্থক্য যেন বিরাট সামাজিক বিভেদ ও দূরত্ব তৈরি না করে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো শুরুতে ঠিক করলেও ক্ষমতার শক্তিমত্ততা ও অর্থ লোভের খপ্পরে পড়ে বিচ্যুত হয়েছে তাদের সংকল্প থেকে। তাই জগৎবাসী দেখেছে সত্তর বছরের মাথায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠীর কাছে পদানত হয়ে ধসে পড়েছিল। আমরা মাও সে তুং-এর চীন দেশের দিকে তাকালেও আমরা একই ঘটনা দেখতে পাই। ওই তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো আমলাতন্ত্র ও ধনতন্ত্রের কাছে পরাজিত। চীন দেশে আজ ধনী ব্যক্তির সংখ্যা আকাশচুম্বী। এই বিশ্বের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো স্বৈরশাসকেরা। হিটলার, মুসোলিনির আগেও একক ক্ষমতা লিপ্সা বহু সভ্যতাকে ধ্বংস্তূপে পরিণত করেছে। এই ক্ষেত্রে চেঙ্গিস খান ও তৈমুর লংয়ের নাম নির্দি্বধায় উল্লেখ করা যায়। দেশের প্রধান শাসক যদি দয়ালু ও মানব হিতৈষী না হন, তা হলেই বিপত্তি ঘটে। মালয়েশিয়ার রাজনীতিবিদ মাহাথির বিন মহাম্মদ যিনি একজন সুলেখকও ছিলেন, তিনি দু'দফায় ২৪ বছরের জন্যে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছিলেন।
আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আমার ধারণা অনুযায়ী সবচেয়ে দেশপ্রাণ ও সর্বাংশে একজন বাঙালি গণমানুষের নেতা। তিনি ছিলেন যথার্থই প্রকৃতির সন্তান। তিনি জীবনে মঙ্গলময় যা কিছু শিখেছিলেন; প্রকৃতি ও দেশের সাধারণ কর্মজীবী মানুষের কাছ থেকে তা আত্মস্থ করেছিলেন। দেশবাসীর মঙ্গল ভাবনা ছাড়া তাঁর জীবনে দ্বিতীয় কোনো ভাবনা ছিল না। তিনি ছিলেন অমিত সাহসী পুরুষ এবং সে জন্যই স্বাধীন, সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের প্রধান পুরুষ জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে কতিপয় ভীরু ও কুচক্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত তাঁর বাড়িটি ছিল সম্পূর্ণ নিরাপত্তাবিহীন, কারণ যে দেশের মানুষের জন্যে তিনি জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম করেছিলেন এবং তাঁর জন্য পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে জাতির পিতা নিজ দেশে ফিরে এসেছিলেন, ইংল্যান্ড ও ভারত হয়ে। তাঁকে তাঁর দেশেরই কয়েকজন নিষ্ঠুরতম কুচক্রীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। কোনো বাঙালি তাঁর জীবননাশের জন্যে অস্ত্র তুলে ধরবে এটা তাঁর ধারণারও অতীত ছিল। তিনি নিহত হয়েছিলেন সপরিবারে পৃথিবীর সর্বকালের নিষ্ঠুরতম ঘাতকদের হাতে। পাশাপাশি আমাদের এটাও ভাবতে হবে যে, তাঁর হাতের আলোকবর্তিকাটি তাঁরই সুজাত কন্যা যথার্থ মানবপ্রেমী রাষ্ট্রনায়ক, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ হাতে তুলে নিয়েছিলেন। তাঁরা দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকার কারণে ১৯৭৫ সালের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সম্পূর্ণ গণতন্ত্রমনা রাষ্ট্রনায়ক। সত্যিকার গণতন্ত্র সবসময় দেশের জনগণ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। বঙ্গবন্ধুর মহাপ্রয়াণের পরে দেশ কয়েকবার স্বৈরশাসকদের শাসনের কবলে পড়ে যায় এবং তা থেকে আমাদের মুক্তি মিলেছে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনকালে। সমগ্র বিশ্বের কোনো সরকারের শাসনকালই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়, কারণ গঠনমূলক সমালোচনাই হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রধান চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুরা আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও এই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত করার জন্যে অগণিত বার প্রয়াস নিয়েছিল। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে ২০০৪ সালে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা নির্মমতম।সম্মানীয় আইভি রহমানসহ বহুলোক প্রাণ দিয়েছিলেন সেদিনের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর গ্রেনেড হামলায়। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন। সমগ্র বিশ্ব যখন করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত, তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী দেশ পরিচালনায় আমরা বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইনি। এই মহামারিকে শেখ হাসিনা সরকার শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে সমর্থ হয়েছিল, যেখানে পৃথিবীর বিত্তশালী দেশগুলোও হিমশিম খেয়েছিল। আমাদের দেশে এই মহামারিতে জনগণের মৃত্যুর হারও ছিল কম। আমরা বিত্তবান দেশ না হলেও খাদ্য সংকটে পড়িনি। সবচেয়ে বড় সাফল্য যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে এবং দেশে এই মহামারির সংকটের সময়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং পরিপূর্ণভাবে ব্যবহূত হচ্ছে, তাছাড়াও মেট্রোরেলসহ আরও বড় বড় অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র হিসেবে চারটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা নির্ধারণ করেছিলেন। তার মধ্যে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজতন্ত্রকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। জাতির পিতা কখনও উগ্র জাতীয়তাবাদকে প্রশ্রয় দেননি। উগ্র জাতীয়তাবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে স্বৈরশাসকেরা, যা দেশের মানুষের জন্যে গণতান্ত্রিক সরকারের প্রাণধারা নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। আমাদের দেশের শাসন ব্যবস্থা, সমাজতন্ত্রকে এবং অসাম্প্রদায়িকতাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল এবং এখনও দিচ্ছে। বাংলাদেশই সর্বতোভাবে ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণি নির্বিশেষে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ যেখানে মৌলবাদ ও স্বৈরাচারের কোনো স্থান নেই।
বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। এই ছোট ভূখণ্ডের স্বাধীনতা অর্জন যেমন যুগান্তকারী ঘটনা ছিল, তেমনি একইভাবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, বাংলাদেশ আজ থেকে বিশ বছর পরে উন্নত বিশ্বের আকাশে একটি মঙ্গলময় দেশের তারা হয়ে জ্বল জ্বল করে দ্যুতি ছড়াবে।
আমাদের দেশে সংকট আছে। পৃথিবীতে কোন দেশ আছে যেখানে জাগতিক তথা ঐহিক সংকট নেই। আমাদের দেশেও বর্তমানে জাগতিক কিছু সংকট রয়েছে কিন্তু সে সব সংকট মোচনের জন্য বর্তমানের বাংলাদেশের সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমাদেরও দৃঢ়প্রত্যাশা যে; সকল সংকট অতিক্রম করে বাংলাদেশ একটি মানবিক দেশ হিসেবে একদিন বিশ্ব স্বীকৃতি পাবে। সরকারের সমালোচনা থাকবে, সংকটও থাকবে কিন্তু মানবিক সরকারের নেতৃত্বে দেশ এই সংকট মোচন করতে সক্ষম হবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন অনন্য হৃদয়বান মানুষ ও সুলেখক ও সংস্কৃতিবান্ধব রাষ্ট্রপ্রধান। সুকুমার শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়ন দেশকে বিশ্বসভায় এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। আমাদের দেশ শিল্পকলার প্রায় সকল শাখায় এগিয়ে আছে।
আমি আশা করি যে, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিকে আলিঙ্গন করে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও আমরা এগিয়ে যাবে। আমি আশা করব যে, সবার ওপরে বাংলাদেশ সরকার মানব মঙ্গলকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেবে কারণ দেশতো গণমানুষের জন্যই, দেশতো সবাইর। আমাদের দেশ পরিচালনায় সে স্বাক্ষর পরিস্ম্ফুট।
সবশেষে বলব, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে সফল করে দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী বর্তমান সরকারের সময়কালের মধ্যেই দেশকে উন্নতির সড়কে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎই আমাদের ঐকান্তিক প্রত্যাশা করি।
তদানীন্তন পূর্ব বাংলা, বর্তমানের স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবসময়ই অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল এবং আজও আছে। বাঙালির পেটে ভাত না থাকলেও মুখে গান ছিল। আমি আমার কৈশোরে সারারাত জেগে গ্রামীণ যাত্রা গান বা পালা গান দেখেছি এবং শুনেছি। বাংলাদেশের গ্রামীণ মেলা, যাত্রা গান, পালা গান, পুঁথি পাঠ এবং সব ধরনের লোকজ সংস্কৃতি বাঙালি জীবনচর্চার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। খুব বিত্তবান না হলেও বাঙালির জীবনাচরণে সহজিয়া সৌন্দর্যে ছিল সমৃদ্ধ। বাঙালির আতিথেয়তাও সর্বজনবিদিত। একজনের খাবার কেবল বাঙালিই দু'জনে ভাগ করে খেতে অভ্যস্থ।
ভাষার দিক থেকে চর্যাপদ থেকে শুরু করে বাংলা ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ, শ্রুতিমধুর ও কাব্যিক। জীবনের সকল সুখ-দুঃখকে অতিক্রম করে বাঙালি নিজস্ব সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটিয়েছে যুগে যুগে। মহাত্মা লালন, শাহ্থ আব্দুল করিম, গগন হরকরা, কবি জীবনানন্দ দাশসহ অসংখ্য কবি ও গায়কের চারণক্ষেত্র ছিল এই বাংলাদেশ। এমনকি তরুণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনন সমৃদ্ধ হয়েছে যখন তিনি শিলাইদহ, শাহজাদপুর ও পতিসরে এসে পূর্ববঙ্গে ৬-৭ বছর একনাগাড়ে অবস্থান করেছিলেন।
বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিচর্চা ও সার্বিক জীবনবোধের স্ম্ফূরণ ঘটেছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে, যিনি সার্বিকভাবে বাঙালির জীবনকে সমৃদ্ধ ও গৌরবান্বিত করেছেন।
লেখক
মঞ্চসারথি, অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক, লেখক, কবি
একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত
- বিষয় :
- প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২০২২
- ১৮ বছরে সমকাল