ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

আগামী

শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষা

শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষা

লামিয়া হাছান তিথি

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ২৩:৫৫

১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের অর্জন লাল-সবুজের পতাকা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ প্রয়োজন। তৈরি পোশাকশিল্প, রেমিট্যান্স, ওষুধ ও খাদ্যদ্রব্য রপ্তানি থেকে শুরু করে স্থাপত্য, বিজ্ঞান, ক্রীড়া সব বিভাগেই বাংলাদেশ ক্রমঅগ্রসরমান। এক সময় তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা পাওয়া বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন, মালয়েশিয়াকে ছাপিয়ে ২৮তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে। স্বল্প খরচে স্বাস্থ্যসেবা, উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা, তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষ, শিল্পখাতে উন্নয়ন বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করছে। কিন্তু, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ উচ্চশিক্ষার পর প্রবাসে স্থায়ী হতে আগ্রহী।

দেশ থেকে প্রতি বছর অসংখ্য শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার উদ্দেশে পাড়ি জমান বিদেশে। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই পড়াশোনা শেষ করে সেখানে চাকরিতে প্রবেশ করে স্থায়ী হয়ে যান। এর পেছনে নিরাপত্তার অভাব, চাকরির দুষ্প্রাপ্যতা, অপর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধা, যানজট, রাজধানীর করুণ যোগাযোগ ব্যবস্থা, গবেষণার অপ্রতুল সুযোগ গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। এতে করে বাংলাদেশ প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মেধাবী তরুণ-তরুণী হারাচ্ছে। সঙ্গে মেধাও পাচার হচ্ছে বিদেশে। দেশের তরুণ মেধাবী শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং দক্ষ জনশক্তির নিজ দেশ ত্যাগ করে বিদেশকে কর্মক্ষেত্রে হিসেবে স্থায়ীভাবে বেছে নিচ্ছে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণার পরিবেশ তৈরি করতে পারলে বিদেশ থেকেও বাংলাদেশি মেধাবী গবেষকরা দেশে ফিরে এসে কাজ করার অনুপ্রেরণা পাবেন। তাতে আমাদের দেশও উপকৃত হবে। যদি উপযুক্ত গবেষণাগার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক হাইটেক ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠত,তবে এসব মেধাবী তরুণ দেশে ফিরে দেশের ভাগ্য বদলাতে সমুন্নত ভূমিকা পালন করতে পারত।

গবেষণালব্ধ যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োগ করে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। শিক্ষা-গবেষণা ও শিক্ষাবিষয়ক গবেষকদের গুরুত্ব অনুধাবন করে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নরওয়ে, কোরিয়া প্রভৃতি দেশে শিক্ষা নিয়ে পড়া ও গবেষণা করার জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। বিষয়টি আমাদের দেশেও ভাবা যেতে পারে। আমাদের নতুন প্রজন্ম যদি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আয়ত্ত করে নিজেদের আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, তা হলেই দেশের দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও পশ্চাৎপদ সংস্কৃতির অবসান ঘটবে এবং একটি উন্নতও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তৈরি হবে। এই লক্ষ্যে গবেষণাপূর্বক চাহিদাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা আবশ্যক।

কারণ, গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষার ভিত্তি গড়ে না উঠলে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করে দক্ষ ও মেধাবী জনশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ নামমাত্র মূল্যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সুবিধা সরবরাহ করতে পারলেও ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর জন্য এ সেবা পর্যাপ্ত নয়। উন্নয়নের হাওয়া কাজে লাগানোর জন্য দরকার স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে মানোন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। যুগোপযোগী শিক্ষার জন্য পাঠক্রম পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের পাশাপাশি দলগত কার্যক্রম অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও বেশি শিক্ষার্থীবান্ধব করা প্রয়োজন। পুরো বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লব এনে দিতে পারে এবং জনসংখ্যাধিক্যের জন্য এ খাতে বাংলাদেশের মানুষের প্রাপ্ত সুবিধা হবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি। দুটো উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের কোনো এক দুর্গম এলাকায় এক অন্তঃসত্ত্বা নারী প্রসবকালীন জটিলতার সম্মুখীন হলে অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। এসব বিক্ষিপ্ত ঘটনাই বাংলাদেশে উচ্চ মাতৃ ও শিশুমৃত্যুহারের অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত জনপদে উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা চালু করা হলে গ্রামীণ সাধারণ জনপদ খুব সহজেই দোরগোড়ায় আধুনিক চিকিৎসা পরামর্শ পেতে পারে। আউটসোর্সিং এখন দারুণ সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার হিসেবে তরুণ প্রজন্মের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। বিভিন্ন ধরনের দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণের ফলে এই খাতে সফল তরুণের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। আমাদের তরুণরা এই খাতে নিজেদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপশি বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।


বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অধিকহারে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে নতুন খাত সৃষ্টি এবং সম্ভাবনাময় খাতগুলোর ক্রমবিকাশের কোনো বিকল্প নেই।

সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমান বাংলাদেশে এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার ফলে অকালেই অসংখ্য মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হচ্ছে এবং মানুষ মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিংরয়র মাধ্যমে ল্যাবে চাহিদামতো কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরি করে দুস্থ মানুষের স্বাভাবিক জীবন দান করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং হতে পারে এক আশাজাগানিয়া বিজ্ঞানের বিস্ময়, যার মাধ্যমে প্রত্যেক মানুষের নিজের মতো করে বিভিন্ন কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি করা সম্ভব এবং এ নিয়ে সাম্প্রতিক বিশ্বে গবেষণা চলছে।

বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হলো- ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে উন্নীত করা। তবে উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়া অপেক্ষাকৃত অনেক কঠিন। আমাদের মূল চালিকাশক্তি হলো কৃষি। সুতরাং কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়াতে পারব তত দ্রুত আমরা উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত হতে পারব। দেশে এখন বিনিয়োগের উত্তম সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। হাইটেক পার্ক, অত্যাধুনিক ল্যাবসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। শিক্ষিত তরুণদের মাঝে বিরাজমান বেকারত্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য দক্ষতা উন্নয়ন এবং কৃষি যান্ত্রিকীকরণে এর ব্যবহারের জন্য উদ্যোক্তা তৈরির দিকেও মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে। কৃষক ও অন্য ব্যবহারকারীদের ডিজিটাল তথ্যে প্রবেশের সুযোগ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং দক্ষতার উন্নয়ন করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে বর্ধিষ্ণু চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সাল থেকে বুয়েটে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ চালু করা হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির উন্নত ল্যাবরেটরিতে বায়োম্যাটেরিয়ালস, টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং ও সিমুলেশনবেজড বিশ্বমানের গবেষণা হচ্ছে। পাশাপাশি হালের মেশিন লার্নিং ও ডিপ লার্নিংয়ের মাধ্যমে ফুসফুস, হূৎপিণ্ডসহ অন্যান্য অঙ্গের রোগ নির্ণয় ও নিরাময়ের জন্য উন্নত সফটওয়্যার ডেভেলপ করা হচ্ছে। আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্বাস্থ্য খাতে যে বিপ্লবের প্রয়োজন, তা বুয়েটের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট সূচনা করে দিয়েছে- এ কথা অনায়াসেই বলা যায়। আমরা প্রত্যেকেই যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে সমাজের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, কাজ করে যেতে পারি, আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে জাতি হিসেবে আমাদের দেশকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাতে পারব।
লেখক
গ্র্যাজুয়েট রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট  বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট বুয়েট

আরও পড়ুন

×