আগামী
বাংলাদেশ যেমন দেখতে চাই

মোহাইমিনুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ২৩:৫৪
পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম আর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের কিছু সময় পরে দাঁড়িয়ে আগামীর বাংলাদেশ কেমন দেখতে চাই- ভাবলেই শান্তির এক শীতল হাওয়া বয়ে যায় হৃদয়জুড়ে। যুদ্ধবিধ্বস্ত তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ হিসেবে শুরুর দিকের কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে, ফিনিক্স পাখির মতো যে দেশের উত্থান হয়েছে সগৌরবে, তার গল্প আমাকে মুগ্ধ করে। কেননা, ভবিষ্যতে কেমন বাংলাদেশ চাই, সেটি কল্পনা করতে আমাকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির আশ্রয় নিতে হয় না, বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে তা মনে হয় ঢিল ছোড়া দূরত্ব। সোনার বাংলা তাই আজ আর স্বপ্ন নয়, সেটি আজ পৌঁছে গেছে স্বপ্নের কাছাকাছি। বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
ক্ষুদ্র আয়তনের একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ এরই মধ্যে সারা বিশ্বের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্রঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে তার ভূমিকা, জনবহুল দেশে নির্বাচন পরিচালনায় স্বচ্ছ ও সুষ্ঠুতা আনয়ন, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের ইতিবাচক পরিবর্তন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেওয়া এই বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে আসতে অতিক্রম করতে হয়েছে হাজারো প্রতিবন্ধকতা। নারী বঞ্চনার তিক্ত অতীত পেরিয়ে বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে অনেক দূর এগিয়েছে। পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ। আর এই শিল্পের সিংহভাগ কর্মী হচ্ছে নারী। ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশে গ্রামীণ উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছে। ডিজিটাল অর্থনীতিই জাতীয় পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার সম্ভব করে তোলে। বিশ্বব্যাপী অবাধ তথ্য প্রবাহ ভোক্তা, সরবরাহকারী, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে তথ্য-সূত্রে গ্রথিত করে। সবাই উপকৃত হয়। বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে যা বিশেষ ভূমিকা রাখে। তথ্যপ্রযুক্তি দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে এনে দিয়েছে নতুন মাত্রা।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ফলে দ্রুত দেশের যে কোনো প্রান্তে অর্থনৈতিক লেনদেনের সুবিধা সাধারণ মানুষের জীবনে এনে দিয়েছে স্বস্তি। তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে স্টার্টআপ সংস্কৃতির বিস্তৃতি ঘটেছে। নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকারি সহায়তা প্রদানের জন্য তৈরি করা হয়েছে 'স্টার্টআপ বাংলাদেশ' প্ল্যাটফর্ম। আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে, ভাবলেই আমি প্রথমত দেখতে চাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। কেননা, আমি বিশ্বাস করি অন্যান্য সব সামাজিক সমস্যা কোনো না কোনোভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত। আর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তিতে নিজেদের 'মার্কেট লিডার' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। ভবিষ্যতের পৃথিবী হবে তথ্যপ্রযুক্তির। বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ভিত্তি করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, সেই জোয়ারে নৌকা ভাসিয়ে বঙ্গোপসাগরের এই বদ্বীপটিও অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে, সেটি আমার প্রত্যাশা।
জনসংখ্যার বোনাস যুগে পৌঁছানো বাংলাদেশের রয়েছে ক্রমবর্ধমান উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতি, দক্ষ মানবসম্পদ এবং সৃজনশীল উদ্যোক্তা শ্রেণি, বিপুল পরিমাণ তরুণ জনসংখ্যা এবং তাদের মধ্যে অদম্য কাজ করার স্পৃহার সাথে রয়েছে সরকারের নানা উদ্যোগ। তাই ভবিষ্যতের বাংলাদেশের এই স্বপ্ন দেখাটা খুব একটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলবে এই দেশের তরুণরা। আর তাই তাদের কাঁধে ভর করে বিপ্লব চলে আসবে কৃষি ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অগ্রগণ্য ভূমিকার কারণে আমাদের কৃষি উৎপাদন, ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন হবে এবং বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন পুরোপুরিভাবে পাল্টে যাবে। দেশের সর্বত্র মোবাইল টেকনোলজি এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ পরিবর্তন আসবে। বেকারত্বের অভিশাপমুক্ত থাকবে আমাদের এই স্বপ্নের বাংলাদেশ। একটা দেশ এবং জাতি গঠনে শিক্ষার ভূমিকা অনস্বীকার্য, দেশকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাতে সাহায্য করতে পারে সেই দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ আজ নতুন কিছু উদ্ভাবনের মাধ্যমে তার দেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। আধুনিক সমাজে শিক্ষার গুরুত্ব দেশের প্রতিটি শ্রেণির মানুষ উপলব্ধি করতে পারছে।
শুধু পুঁথিগত শিক্ষা নয়, বরং কল্যাণমুখী এবং বাস্তবধর্মী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠবে। ফলে শিক্ষার প্রকৃত মান উন্নয়ন হবে। তাই আমরা শুধু শিক্ষিত নয় বরং সুশিক্ষিত প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠব।
পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে এখনও নারীরা অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তবুও নারীরা সব প্রতিকূলতা জয় করে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন, গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হচ্ছেন। আশা করি, ভবিষ্যতেও তারা আমাদের দেশকে একত্রিত হয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। নারীর প্রতি সহিংসতা, নারীর সামাজিক অনিরাপত্তা, সমাজের অসমতা ও লিঙ্গবৈষম্য পুরোপুরিভাবে নিঃশেষ হয়ে যাবে। একটি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ হবে, যেটি দেশের নিরাপত্তা ও বৃদ্ধিকে সমৃদ্ধ করবে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশও ধীরে ধীরে তথ্যপ্রযুক্তির অনেক পথ পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে অগ্রগতিও আশাপ্রদ। তথ্যপ্রযুক্তির বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশের সন্তানরা দেশে-বিদেশে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন। তথ্যপ্রযুক্তিকে আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডের সব ক্ষেত্রে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারলে সমাজ দ্রুত উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখোমুখি আমাদের সোনার বাংলাসহ পুরো বিশ্ব। সেই বিপর্যয় রোধে বিশ্বব্যাপী অস্তিত্ব রক্ষার যে আন্দোলন, সেই আন্দোলনে অগ্রগণ্য ভূমিকায় থাকবে আমাদের বাংলাদেশ। সবুজের সমারোহে ভরপুর ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের নৈসর্গিক রূপ দেখে মনে হবে যেন নন্দনকাননের সৌন্দর্যমণ্ডিত কোনো সার্থক চিত্রশিল্পীর আঁকা নিখুঁত চিত্রকর্ম।
আমি এমন এক সমাজের স্বপ্ন দেখি- যেখানে অজ্ঞতা থাকবে না, কুসংস্কার থাকবে না; সমাজের কোনো জনগোষ্ঠী ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গভেদে বৈষম্যের শিকার হবে না, থাকবে না ক্ষুধা; দারিদ্র্যমুক্ত একটি অসাম্প্র্রদায়িক প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক আধুনিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। যেখানে চোখ বন্ধ করলে মানসপটে ভেসে উঠবে সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যমলা সোনার দেশ- এটিই হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।
লেখক
৪০তম বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত মেধাক্রম-০১
- বিষয় :
- প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২০২২
- ১৮ বছরে সমকাল