ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

আগামী

নদী আন্দোলনের যুক্তি, মুক্তি ও উপ্তি

নদী আন্দোলনের যুক্তি, মুক্তি ও উপ্তি

শেখ রোকন

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ২২:৪২

সমকালের ১৮ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে বিশেষ আয়োজনের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- যুক্তি, মুক্তচিন্তা ও আগামী। এর কেন্দ্রে নিঃসন্দেহে রয়েছে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। কিন্তু পরিবেশ, বিশেষত নদী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এর তাৎপর্য সমান গুরুত্বপূর্ণ।

এর আগে সমকালের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা উপলক্ষেই একটি নিবন্ধে লিখেছিলাম- বাংলাদেশ নদী আন্দোলনের 'মোমেন্টাম' পার করছে। (নদী আন্দোলনের সময় ও সমন, সমকাল, ২৭ অক্টোবর, ২০২১)। এক যুগের বেশি আগে আমরা যখন 'রিভারাইন পিপল' গঠন করি, তখন এই প্রশ্ন উঠেছিল- কেন শুধু নদী; কেন সার্বিক পরিবেশ আন্দোলন নয়? আমরা বলেছিলাম, বাংলাদেশে পরিবেশ আন্দোলনের বিকাশ হতে হবে নদীকে কেন্দ্র করেই। শ্নাঘার বিষয়, গত এক যুগে আমাদের অভিমত যথাযথ প্রমাণ হয়েছে। দেশজুড়েই পরিবেশ আন্দোলনের অভিমুখ আজ নদীর দিকে প্রসারিত। কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত পরিবেশ আন্দোলনগুলো যেমন নদী আন্দোলনকেই সামনে রেখে অগ্রসর হচ্ছে; তেমনই দেশের নানা প্রান্তে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন নদী আন্দোলন।

মাঠ পর্যায়ের জাগরণ কেবল নয়; আমরা দেখব, গত এক যুগে নীতিগত দিক থেকেও নদী পেয়েছে বিশেষ মনোযোগ। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নদী সুরক্ষায় যে প্রত্যয় ও সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করেছেন; অতীতে আর কোনো সরকারপ্রধানের ক্ষেত্রে তা দেখা যায়নি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে পরিবেশ সুরক্ষার অঙ্গীকার যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। প্রণীত হয়েছে পানি আইন। গত তিনটি নির্বাচনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় প্রতিটি তাদের ইশতেহারে নদী সুরক্ষার প্রশ্নকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। উচ্চ আদালতের ভূমিকার কথা বলতে হবে আলাদাভাবে। নদী সুরক্ষা প্রশ্নে বেশ কিছু যুগান্তকারী রায় ও নির্দেশনা এসেছে। বিশেষত ২০১৯ সালে বাংলাদেশে প্রবাহিত নদীগুলোকে 'জীবন্ত সত্তা' ঘোষণা ছিল এক যুগান্তকারী অধ্যায়। বিশ্বে হাতেগোনা কয়েকটি দেশ এ ধরনের ঘোষণা দিলেও তা সীমিত থেকেছে একটি বা দুটি বিশেষ নদীর ক্ষেত্রে। বাংলাদেশেই প্রথম প্রবাহিত সব নদীকে এ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

নীতির প্রশ্নে কিংবা মাঠের আন্দোলনে- বাংলাদেশ কেন নদী আন্দোলনের উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠল?
ক. যুক্তি
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন যে আদতে নদী আন্দোলনই হওয়া উচিত- এ জন্য আয়োজন করে যুক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজন পড়ে না। কারণ নদীই বঙ্গীয় ব-দ্বীপের 'ফ্ল্যাগশিপ ফিচার'। যে কোনো প্রাকৃতিক পরিস্থিতি বা প্রতিবেশ ব্যবস্থায় একটি 'ফ্ল্যাগশিপ ফিচার' থাকে, যাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় ওই প্রতিবেশ ব্যবস্থার বাকি উপাদান বা বৈশিষ্ট্যগুলো। যেমন ব্রাজিলের প্রতিবেশ ব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে আমাজন বনাঞ্চল; নেপালের প্রতিবেশ ব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে হিমালয় পবর্তমালা। তেমনই বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থা, জীববৈচিত্র্য, কৃষি ব্যবস্থা, বনাঞ্চল, এমনকি বায়ুর স্বাস্থ্য- সবকিছু ভালো থাকবে, যদি নদীর স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
শুধু তাই নয়; নদীর প্রতি বাংলাদেশে যে ধরনের অত্যাচার ও নির্যাতন চলেছে, তার মাত্রা বিবেচনাতেও প্রবল নদী আন্দোলনের বিকল্প নেই। বিশ্বজুড়েই নদীর সাধারণত পাঁচটি সংকট থাকে- প্রবাহস্বল্পতা, ভাঙন, দখল, দূষণ ও বালু উত্তোলন। কিন্তু যে কোনো দেশের নদনদীতে সব সংকটই বিদ্যমান- এমন নজির নেই বললেই চলে। কোনো দেশের নদী হয়তো মূলত প্রবাহস্বল্পতায় ভুগছে; কোনো দেশে দখল বা দূষণ প্রবল। যেমন ইউরোপের পাথুরে ভূমির নদীতে ভাঙনের সংকট থাকে না। দক্ষিণ আমেরিকার নদীগুলোতে বালু উত্তোলন সাধারণ সংকট হিসেবে হাজির হলেও অনেক নদীতে বাকি চারটি সংকট নেই। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশের প্রায় সব নদীতে ছয়টি সংকটের প্রতিটি বিদ্যমান। এমন পরিস্থিতিতে নদী আন্দোলন গড়ে উঠবে না কোন যুক্তিতে?

বাকি বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থার একটি বড় পার্থক্য হলো, এগুলোর অববাহিকা সরলরৈখিক বা বিচ্ছিন্ন নয়। অন্যান্য দেশে সাধারণত আলাদা 'নদী-অঞ্চল' থাকে। বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদই নদী অঞ্চল। উনিশ শতকে এই অঞ্চল জরিপ করতে আসা এক ইংরেজ সার্ভেয়ার মন্তব্য করেছিলেন- এ দেশে পূর্ব থেকে পশ্চিমে যেতে হলে নদী পার না হয়ে পাঁচ মাইলের বেশি যাওয়া যায় না। যদিও অনেক নদী হারিয়ে গেছে; ভৌগোলিক এই বাস্তবতা এখনও বিদ্যমান।
বাংলাদেশের সভ্যতা, সমাজ, সংস্কৃতি, যোগাযোগ ও উৎপাদন ব্যবস্থায় নদনদীর অবদান ও নদী আন্দোলনই প্রধান পরিবেশ আন্দোলন হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। বিশ্বব্যাপী সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে কিছু সূক্ষ্ণ ভেদরেখা থাকে। যেমন যেসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে জড়িত, তারা সাধারণ অর্থনৈতিক সুশাসন নিয়ে আন্দোলনে খুব একটা মনোযোগী হতে পারে না। আবার লিঙ্গ-সমতা নিয়ে আন্দোলনকারীরা হয়তো সাহিত্য আন্দোলনে দেওয়ার মতো সময় নাও পেতে পারে। বাংলাদেশে সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে অদ্বিতীয় পরিস্থিতি হলো- সাংস্কৃতিক আন্দোলন থেকে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন- সবকিছুর সঙ্গে নদী ব্যবস্থার সম্পর্ক রয়েছে এ দেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই। নদীগুলো যখন ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে, ততই আর্থসামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর কুফল স্পষ্ট হচ্ছে। স্পষ্ট হচ্ছে- নদী না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। এটি যেমন ভৌগোলিকভাবে, তেমনই সাংস্কৃতিকভাবে।

এটাও লক্ষণীয়, বাংলাদেশে নদী আন্দোলন যতটা সম্প্রসারিত হচ্ছে, ততটা বিকাশ লাভ করছে না। কারণ কী? আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ বলে- আন্দোলনের মাধ্যমে নদীর মুক্তির আগে খোদ নদী আন্দোলনেরই মুক্তি দরকার।
খ. মুক্তি
নদী আন্দোলনের মুক্তির পথে বাধা কী কী- এ আলোচনা অনিবার্যভাবেই স্পর্শকাতর। কিন্তু নদী সুরক্ষার স্বার্থেই আত্মসমালোচনার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিষয়টি বলতেই হবে। বলতেই হবে যে, খোদ নদী আন্দোলনের সাংগঠনিক প্রবণতা এর বিকাশের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে হাজির হয়েছে। এটি হচ্ছে একই ব্যক্তির একাধিক সংগঠন এবং ক্ষেত্রবিশেষে একই সংগঠনের একাধিক পদ আঁকড়ে থাকা। এর ফলে পদে ও দায়িত্বে ব্যক্তি ভারিক্কি হতে থাকে বটে, সংগঠন সম্প্রসারিত হয় না। যেখানে তিনটি সংগঠনে তিনজন নদী আন্দোলনকর্মী পাওয়া যাওয়ার কথা ছিল, সেখানে দেখা যায় একজন ব্যক্তিই তিনটি সংগঠনের তিন পদ দখল করে রয়েছেন। ফলে দিনের শেষে পরিস্থিতিটি কুমিরের বাচ্চা প্রদর্শনের গল্পের মতোই। নদী আন্দোলনে তাজা রক্ত প্রবেশের পথও রুদ্ধ হয়ে যায়। অবশ্য রাজনৈতিক সংগঠনের ক্ষেত্রে এ প্রবণতা আগে থেকেই ছিল। কিন্তু নদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এর কুফল কেবল নির্দিষ্ট সংগঠনে সীমিত থাকে না।

নদী আন্দোলনের মুক্তির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বাধা আন্দোলনটিকে 'জীবিকা' হিসেবে গ্রহণ করা। নদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যদি কাউকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়, তাহলে একদিকে যেমন এর নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে সমঝোতা করতে হতে পারে; তেমনই সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকার পরও আন্দোলনে কারও সম্পৃক্ততা নিছক জীবিকার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়তে পারে।

প্রকল্পভিত্তিক নদী সুরক্ষা উদ্যোগও নদী আন্দোলনের স্বাভাবিক বিকাশ ও সম্প্রসারণের জন্য একটি বড় বাধা। সরকারি কিংবা বেসরকারি- উভয় ক্ষেত্রেই এটা সত্য। এমন উদাহরণ আশপাশেই দেখা যাবে যে, ঢাকঢোল পিটিয়ে নদী উদ্ধার প্রকল্প সূচিত হচ্ছে। যত দিন প্রকল্প ও তহবিল রয়েছে; প্রত্যয় ও অঙ্গীকার ততদিন জোরালো। প্রকল্প শেষ তো, ধীরে ধীরে তা মিইয়ে যেতে থাকে। এ ধরনের প্রকল্প ও তহবিল এলে একদিকে কিছু অতিথি পাখি যেমন উৎসাহিত হয়, তেমনই প্রকল্প শেষে ভাঙাহাট পরিস্থিতি দেখে সত্যিকার নদী আন্দোলনকারীরা হতোদ্যম হয়ে পড়েন। অতীতে আমরা দেখেছি, কীভাবে গ্রাম-গঞ্জে কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রকল্পভিত্তিক অ্যাক্টিভিজমের কারণে প্রকৃত অ্যাক্টিভিজম বা স্বতঃস্ম্ফূর্ত সামাজিক আন্দোলন নিঃশেষ হয়ে গেছে। পরিবেশ আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এমন আশঙ্কাজনক প্রবণতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। অতএব সময় থাকতেই প্রকল্পভিত্তিক নদী আন্দোলন থেকে সরে আসতে হবে।
এখানেই আসলে নদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী নৈতিক অবস্থানের প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়। ব্যক্তিগত ও বৈষয়িক লাভের ঊর্ধ্বে উঠে নদী আন্দোলনে যুক্ত হতে না পারলে শেষ পর্যন্ত সেই সম্পৃক্ততা টেকসই হয় না। পাশাপাশি সাম্প্রতিক প্রপঞ্চ হিসেবে দেখা দিয়েছে 'ক্লিকবেইট' নদী আন্দোলন। যে ধরনের আন্দোলন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সক্রিয়তাতেই শেষ হয়ে যায়; মাঠের আন্দোলনে এর প্রভাব সামান্য। স্বীকার করতে হবে, সামাজিক মাধ্যমে নদীবিষয়ক যে কোনো তৎপরতারই ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। কিন্তু সেটা যদি শুধু ক্লিকসর্বস্ব থেকে যায়; আখেরে লাভের চেয়ে যে ক্ষতিই বেশি হয়- তুরস্কের গাজি পার্ক আন্দোলন এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এমন উদাহরণ দেশ থেকেও দেওয়া যাবে।

প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে কী করতে হবে?
গ. উপ্তি
নৈতিকতার প্রশ্নটি 'মুক্তি' পর্বেই বলে নিয়েছি। যুগোপযোগী ও বিকাশমুখী নদী আন্দোলনের বুনন বা উপ্তির প্রশ্নে বলতে হবে- নদীর ব্যবহারিক মূল্য ফিরিয়ে আনতেই হবে। আর তা ফিরিয়ে আনতে হবে নদীর সাংস্কৃতিক মূল্য ফিরিয়ে আনার মধ্য দিয়ে। কারণ নদীর সংকট শুরুই হয় প্রধানত সাংস্কৃতিক বিমুখতা, সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা থেকে। নদী যে আমাদের সমাজ ও সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ- সেটা মনে রাখার জন্য নদীর সঙ্গে সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা জরুরি। সেই ঘনিষ্ঠতা যখন বিনষ্ট হয়ে গেছে, তখন নদী মরে গেলে; দখল ও দূষণ হলে আমাদের বেশিরভাগেরই কিছু যায় আসে না। অনেকে নদীর সঙ্গে সাংস্কৃতিক নৈকট্যের সংকীর্ণ অর্থ গ্রহণ করেন। যেন সংগীত, সাহিত্য, চলচ্চিত্রে নদীর জোরালো উপস্থিতিই যথেষ্ট। এগুলো নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উপাদান। এর সঙ্গে যোগ হতে পারে নদীকেন্দ্রিক মেলা বা নৌকাবাইচ। কিন্তু শুধু গান-বাজনা দিয়ে নদীর সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা ঘোচানো যাবে না। মরে যাওয়া নদীর জন্য হাহাকার দিয়ে শিল্প-সাহিত্য হতে পারে। কিন্তু সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা কাটানোর জন্য প্রয়োজন জীবন্ত, সচল ও স্বাস্থ্যবান নদী।

আর সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা কাটাতে হলে নদীর অর্থনৈতিক গুরুত্ব ফিরিয়ে আনতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে নদীর গুরুত্ব ফিরিয়ে আনতে হবে। এর একটি উদাহরণ আমি প্রায়শ দিয়ে থাকি। যেমন বাড়ির পাশের ছোট্ট রাস্তাটিও কাউকে দখল বা বিনষ্ট করতে দিই না আমরা। বিনষ্ট বা দখল হতে দেখলে পুলিশ-প্রশাসনের জন্য বসেও থাকি না। কারণ সড়ক বা রাস্তাটি তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজন। একইভাবে নদী যখন দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজন হবে, তখন আর কেউ নষ্ট হতে দেবে না। এ জন্য মৎস্যসম্পদ, সুপেয় পানি, সেচ, নৌপথ, চিত্তবিনোদনের মাধ্যম হিসেবে নদীগুলোকে টিকিয়ে রাখার বিকল্প নেই।

আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো নদীর অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে সাব্যস্ত করা। নদী মরে গেলে যেহেতু প্রতিবেশ ও খাদ্যচক্র বিনষ্ট হয় এবং মানুষের জীবন ও জীবিকা ঝুঁকির মুখে পড়ে; তাই নদী সুরক্ষা মানবাধিকার সুরক্ষারই নামান্তর। সর্বজনীন মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি বড় বিবেচনা হচ্ছে- সংশ্নিষ্ট ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা তাদের সমর্থিত কোনো গোষ্ঠী জড়িত কিনা। নদী দখল-দূষণ, বালু উত্তোলনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, বিপুল অধিকাংশ দখল ও দূষণকারীই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী তথা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। এমনকি আমাদের নদীগুলোতে যে প্রবাহস্বল্পতা দেখি; এর নেপথ্যেও রয়েছে হয় পররাষ্ট্রের পানি প্রত্যাহারের আয়োজন, না হয় নিজ রাষ্ট্রের অপরিকল্পিত স্থাপনা।

নদীবিরোধী তৎপরতা যে হারে ও মাত্রায় বেড়েছে, তাতে নদী আন্দোলনগুলোকে মানবাধিকারের প্রশ্নটি গুরুত্ব দিয়ে 'ডিল' করতে হবে। উচ্চ আদালতের পক্ষে দেশের সব নদনদীকে 'জীবন্ত সত্তা' ঘোষণার পর বিষয়টি আগের চেয়ে নিঃসন্দেহে সহজ হয়েছে।

ঘ. উপসংহার
পরিশেষে এ কথা বলতে হবে- বাংলাদেশের নদী আন্দোলনের গতি ও বিকাশের ক্ষেত্রে সমকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছে। দেশব্যাপী নদনদীর পরিস্থিতি যেমন তুলে ধরেছে, তেমনই পরিস্থিতি উত্তরণের পথ নিয়ে বিশ্নেষণ, আলোচনা, সম্পাদকীয় পরামর্শ দিয়েছে। নদী সুরক্ষায় তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে একক ও যৌথ কর্মসূচিও গ্রহণ করেছে। নদী আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গ ও সংহতির জন্য দৈনিকটিকে নদীময় শুভেচ্ছা। সামনের দিনগুলোতেও যথার্থ নদী আন্দোলনে উপ্তি বা বুনন পর্যায়ে সমকাল নিশ্চয়ই সঙ্গে থাকবে।
লেখক
মহাসচিব
রিভারাইন পিপল

আরও পড়ুন

×