ঢাকা রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

ই-কমার্স

আস্থা ও আস্থার সংকট

আস্থা ও আস্থার সংকট

এ কে এম ফাহিম মাশরুর

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৮:০০ | আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২৩ | ১২:৫৮

গত এক দশক ধরে বাংলাদেশে ই-কমার্স একটু একটু করে এগিয়ে চললেও করোনাকালীন মানুষের ব্যাপক আগ্রহ জাগিয়েছিল এ খাত। এ সময়ে অনলাইন কেনাকেটা বিশাল ছাড় আর অফারে ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। দেশে অনলাইন কেনাকাটায় সম্ভাবনা জাগাতে শুরু করা এ খাতে কয়েকটি কোম্পানির গ্রাহকের হাজার কোটি টাকা লুটে নেওয়ার ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরই এ খাতে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ সংকটই সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দেবে বলেও অনেকে মনে করলে সাময়িক এ ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে। 

২০২২ সালে ই-কমার্স খাতে উল্লেখযোগ্য নতুন কোনো সাফল্য আসেনি। ২০২০ ও ২০২১ সালের নতুন নতুন কোম্পানি যেমন এসেছে, তেমনি নতুন ক্রেতার সঙ্গেও বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ তৈরি হয়েছে। অনেকের টাকা আটকে রয়েছে। বছর পার হলেও এ বিষয়ে এখনও কেউ সমাধান পায়নি। ফলে নতুন কোনো ই-কমার্স তৈরি হয়নি। নতুন গ্রাহকরা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। যাঁরা আছেন তাঁরা আগের যুক্ত হওয়া গ্রাহক। গত বছর যাঁরা উদ্যোক্তা হিসেবে অনলাইনে এসেছেন তাঁদের জন্য এগিয়ে যাওয়া চ্যালেঞ্জিং ছিল। এর মধ্যে হঠাৎ করে ডলারের দাম বৃদ্ধি পায় বছরের মাঝামাঝি সময়ে।

বাংলাদেশে এখনও ৭০-৮০ শতাংশ বিদেশি পণ্য আসে। ডলারের দাম ও নানা জটিলতায় অনেক আমদানি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যারা অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিদেশি পণ্য বিক্রয় করছে তাদের জন্য সময়টা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। নানা সংকটে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেক পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ঢাকার বাইরে ই-কমার্সের প্রভাব যতটা বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হয়েছিল তেমনটা হয়নি। বহুমুখী সংকটে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা। দৃশ্যত ই-কমার্স খাতটি এখন উচ্চবিত্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে, তবে সর্বস্তরের মানুষের জন্য হওয়া জরুরি। এ বছর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পণ্যের ডেলিভারি চার্জ বেড়ে গেছে। বাড়তি মূল্য যোগ হওয়ায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা দাম বৃদ্ধিতে বাধ্য হচ্ছেন। এর মূল্য গুনতে হচ্ছে কাস্টমারদের। আগের ১০০ টাকার ডেলিভারি চার্জ এখন ১২০-১৪০ টাকা। ঢাকার বাইরে পণ্য পাঠাতে ডেলিভারি চার্জ বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতা তুলনামূলকভাবে কমে যাচ্ছে।

বেশকিছু ঘটনা ও নীতিমালার ফলে ২০২২ সালে ক্যাশ অন ডেলিভারি (সিওডি) বেড়েছে। ২০২০ সালের দিকে ক্রেতা অগ্রিম টাকা পরিশোধ করে দিতেন। কিন্তু অনেকে পণ্য পেতেন না। মানুষের বিশ্বাস আর আস্থা কমে যাওয়ায় আগে থেকে টাকা দিতে চাই না। তারা প্রডাক্ট দেখে টাকা দেয়। ২০২২ সালে আমাদের ১০ শতাংশ অগ্রিম পেমেন্ট হচ্ছে আর ৯০ শতাংশ ক্যাশঅন ডেলিভারিতে পেমেন্ট। আগের বছরের তুলনায় ২০২২ সালে ক্যাশঅন ডেলিভারি ছাড়া তেমন কিছুই লক্ষণীয় নয়। এ ছাড়া ২০০৯ সালে ভ্যাট-ট্যাক্স কমানোর একটা আন্দোলন শুরু হয়েছিল; যা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।

ই-কমার্স খাতের জন্য সরকারের প্রণীত নীতিমালায় কোনো আনন্দের খবর ছিল না। বরং ২০২২ সালে অতিরিক্ত বোঝাযুক্ত হয়েছে। এই অর্থবছরও ভ্যাট-ট্যাক্স কমানো হয়নি। এর সঙ্গে আরও কঠোর হয়েছে অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম। বলা হয়েছে, ক্রেডিট-কার্ডধারীদের বাধ্যতামূলকভাবে ট্যাক্স রিটার্ন ডকুমেন্ট জমা দিতে হবে। এ কারণে, অনলাইনে কেনাকাটা ও পেমেন্টের ক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার কমেছে।

এর পাশাপাশি অনলাইন সেলারদের আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যবসা করছেন, তাঁরা এই নীতিমালা কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছেন। এসব উদ্যোক্তার ব্যবসার আকার ছোট। এ ছাড়া যদি অনলাইনে ব্যবসা করতে হয় তাহলে ব্যবসা চালুর ৯০ দিনের মধ্যে ডিজিটাল বিজনেস আইডি করতে হবে; সরকারের পক্ষ থেকে এমন ঘোষণায় বিপাকে পড়েছেন ছোট ব্যবসায়ীরা। আমি মনে করি, এটি সব প্রতিষ্ঠানের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। বড় বড় ই-কমার্স সাইটে যাঁরা ব্যবসা পরিচালনা করছেন, তাঁদের জন্য এটি কঠিন না হলেও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা যাঁরা বাসা থেকেই ব্যবসা করছেন তাঁদের জন্য এসব মেনে ব্যবসা পরিচালনা করা কঠিন। এর বাইরে রেজিস্টেশন নিয়েও তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। এখন অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করা যাচ্ছে না। আগে যাঁরা করেছেন এখনও অনেকেই ডিকলারেশন পাননি। এসব কারণে ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে জটিলতা বেড়ে যাবে। এ ছাড়া আগামী বছরে ডিজিটাল বিজনেস আইডির (ডিবিআইডি) আবেদনের জন্য বিদ্যমান ফির পাশাপাশি অতিরিক্ত টাকা দিতে হবে। ডিবিআইডি শুধু যাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসা আছে, তাঁদের জন্য হওয়া জরুরি। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য এটি বাধ্যতামূলক করা সঠিক হবে না। কারণ যদি বেশি নীতিমালা আরোপ করা হয় তাহলে দেশে ৪-৫ লাখের অধিক যে উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে, তাঁরা এ খাত থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেবেন।

এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ উদ্যোক্তাদের ওপর যেন নিয়ম-কানুনের বোঝা চাপিয়ে না দেয়, সেদিকে খেয়াল করা উচিত। আগে টাকা না নিয়ে সিওডিতে ব্যবসা পরিচালনা করার সুযোগ দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের প্রতারণার স্বীকার হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পণ্য বুঝে টাকা পরিশোধ করার সুযোগ থাকে এতে। কেননা এর আগে যেসব প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে, তার মূল কারণই হচ্ছে অগ্রিম টাকা পরিশোধ। সিওডির ক্ষেত্রে জোড় দিয়ে নীতিমালা করলে ছোট ও মাঝারি ব্যবস্যায়ীরা টিকে থাকতে পারবেন। যেসব প্রতারণার ঘটনা এর আগে ঘটেছে, তা কোনো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার মাধ্যমে হয়নি। বড় বড় কোম্পানি যাদের ট্রেড লাইসেন্স আছে, কোম্পানির নিবন্ধন আছে, তারাই বড় বড় প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। বড় বড় প্রতারকদের কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বোঝা চাপানো যুক্তিযুক্ত নয়। এটা দেশের উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার পথ কঠিন করে দিচ্ছে।

সত্যিকার অর্থে এ খাতে আগের তুলনায় ২০২২ সালে অর্জন বলতে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই হয়নি। ২০২১ সালের প্রতিক্রিয়াই ২০২২ সালে লক্ষণীয়। বেশি গ্রাহক তৈরি হয়নি। আমার হিসাব মতে, অনেক ছোট ছোট উদ্যোক্তা ঝরে পড়ে গেছে। ফেসবুকে যাঁরা ব্যবসা করছেন অর্থনৈতিক কারণে চলে যাচ্ছেন। 

প্রকৃতপক্ষে কয়েক বছর ধরে ই-কমার্স নিয়ে সরকারি বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে যে ধরনের গুঞ্জন তৈরি হয়েছে তা বাস্তব নয়। এ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে, এটা একেবারেই ভিত্তিহীন। ই-কমার্স খাত এগিয়ে যাচ্ছে এটা সত্য, তবে গত ৩-৪ বছরে তা ২০-৩০ শতাংশের বেশি নয়। অনেক পরিসংখ্যানে দেখানো হচ্ছে ১০০, ২০০ কিংবা ৪০০ শতাংশ বৃদ্ধি এটা অমূলক। বাংলাদেশে ২০ হাজার কোটি টাকার বাজার আছে এ কথারও ভিত্তি নেই। এ বাজার এখনও ১০ হাজার কোটি টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই সংখ্যা বাড়াতে উদ্যোক্তাদের সার্বিক সহযোগিতা করতে হবে। প্রতারকদের কারণে যেন ছোট ব্যবসায়ীরা ঝামেলায় না পড়েন সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। নতুন বছরে সরকারের কাছে প্রত্যাশা, উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা এগিয়ে আসবে। নতুন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা বড় প্রয়োজন। তাঁদের ক্ষুদ্র শর্তে ঋণ সহজশর্তে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সারাদেশে ডেলিভারি চার্জ সহজ ও কমানোর জন্য ভূমিকা নিতে হবে। পণ্য ডেলিভারির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয় অনলাইনের ক্রেতাদের। এটি পণ্যের দাম বৃদ্ধি করছে; ফলে সার্বিকভাবে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ই-কমার্স খাতকে এগিয়ে নিতে সরকারের পাশাপাশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। আমি মনে করি, ডেলিভারির ক্ষেত্রে সরকারি ডাকঘর অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। এর মাধ্যমে সারাদেশে ডেলিভারি চার্জ কমানো যেতে পারে। এখন ঢাকার বাইরে পণ্য পাঠাতে গেলে ১৫০ টাকার মতো খরচ হয়। সরকার ইচ্চ্ছা করলে এটিকে ৩০-৪০ টাকার মধ্যে নিয়ে আসতে পারে। এ জন্য ডাকঘরগুলোকে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে। আমাদের পাশের দেশ ভারতে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬ শতাংশ লোক অনলাইনে কেনাকাটা করছে। এদিকে এগিয়ে চীন ৫০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে আমরা এক শতাংশের আশপাশে রয়েছি। অনলাইন কেনাকাটা বাড়াতে ডেলিভারি চার্জ কমাতে হবে, ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে উদ্যোক্তাদের ওপর বোঝা কমাতে হবে।

লেখক
প্রধান নির্বাহী, বিডি জবস

আরও পড়ুন

×