ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

তথ্যপ্রযুক্তি

নতুন সময়ের মানবসম্পদ

নতুন সময়ের মানবসম্পদ

সৈয়দ আলমাস কবীর

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৮:০০ | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৩ | ০৩:৫৮

ডিজিটাল বাংলাদেশের কারণে জীবনযাত্রার সর্বক্ষেত্রেই আমরা এখন প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। করোনা মহামারিতে যখন গোটা বিশ্ব টালমাটাল, পরিস্থিতি মোকাবিলায় এমনকি উন্নত দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছিল, তখনও বিভিন্ন ডিজিটাল উদ্যোগ মানুষকে দেখিয়েছে নতুন পথ, জুগিয়েছে প্রেরণা। প্রযুক্তির সহায়তায় করোনা সচেতনতা, বিভিন্ন দিকনির্দেশনা, স্বাস্থ্যসেবাসহ সব ধরনের সেবা দেশের কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। তার সুফল কিন্তু আমরা ভোগ করেছি এ ২০২২ সালে এসেই। টেলিমেডিসিন, হোম অফিস, অনলাইন ক্লাস, জুম প্রযুক্তির সাহায্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিজেদের ঘর থেকেই সম্পন্ন করছেন অনেকে। আমাদের বর্তমান লাইফস্টাইলেও আজ প্রযুক্তির ব্যবহার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দিন দিন টেকনোলজির সর্বোচ্চ ব্যবহারের ফলে জীবনযাত্রাকে আমরা অপটিমাইজ করছি। স্বাধীনতার ৫১ বছরে একটি তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সমৃদ্ধ বাংলাদেশে ইতোমধ্যে জেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা, মোবাইল মানি ট্রান্সফার, বিমানের টিকিট, ই-টেন্ডারিংসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশে প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা গত এক যুগ থেকেই দৃশ্যমান। ইতোমধ্যে মহাকাশে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইটসহ কয়েকটি বড় প্রাপ্তি বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে অন্য রকম উচ্চতায়। বাংলাদেশ প্রযুক্তি বিশ্বে অর্জন করে নিয়েছে নিজেদের একটি সম্মানজনক স্থান। আইসিটি সম্প্রসারণ ও ব্যবহার জনসাধারণের নাগালের মধ্যে আনার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এ বছর। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইন্টারঅপারেবল ডিজিটাল লেনদেন প্ল্যাটফর্ম (আইডিটিপি) হিসেবে 'বিনিময়'-এর যাত্রা শুরু। 'বিনিময়' ওয়েবভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম, যা একটি সেবা হিসেবে ব্যাংক, এমএফএস ও পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটরের নিজস্ব অ্যাপে যুক্ত হচ্ছে। এটি গ্রাহক, ব্যবসায়ী, পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার (পিএসপি), ই-ওয়ালেট, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটর, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লেনদেনের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করবে। 'বিনিময়' সব ধরনের আর্থিক লেনদেনকে সাশ্রয়ী, সহজ এবং স্বচ্ছ করে তুলবে, যার মধ্যে রয়েছে কর্মচারীদের বেতন প্রদান, রেমিট্যান্স পাঠানো, ট্যাক্স ও ভ্যাট প্রদান, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ এবং ই-কমার্স লেনদেন। এমএফএস থেকে পেমেন্টে সার্ভিস প্রোভাইডারের (পিএসপি) অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে খরচ হবে হাজারে মাত্র ৫ টাকা। ইন্টারঅপারেবল ডিজিটাল লেনদেনে গ্রাহক পর্যায়েও খরচ লক্ষণীয় মাত্রায় কমিয়ে আনা হয়েছে। অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর এবং বহুবিধ সুবিধাসংবলিত জীবন বীমা করপোরেশনের 'ই-ইন্স্যুরেন্স সিস্টেম'। ই-ইন্স্যুরেন্স সিস্টেম ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি মাইলফলক এবং এর সূচনা কিন্তু কিছুদিন আগে। চলতি বছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ই-রিটার্ন সিস্টেমের মাধ্যমে এক লাখের বেশি করদাতার অনলাইনে আয়কর রিটার্ন সফলভাবে জমা হয়েছে। এ ছাড়া আরও প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার করদাতার অনলাইন আয়করের খসড়া তৈরি হয়েছে। ডিজিটালাইজেশন আয়কর প্রদানে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছে।

তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে তরুণরাই হচ্ছেন মূল চালিকাশক্তি। ভবিষ্যতের দুনিয়া চলবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায়। ফলে প্রোগ্রামিংয়ে দক্ষ না হলে পিছিয়ে পড়তে হবে তরুণদের। বাংলাদেশে প্রোগ্রামিংয়ের আন্তর্জাতিক এ আয়োজন তরুণদের মধ্যে প্রোগ্রামিং শেখার আগ্রহ বৃদ্ধি করবে। এ বছরই প্রথম প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্বকাপখ্যাত ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং কনটেস্টের (আইসিপিসি) চূড়ান্ত আসর (ওয়ার্ল্ড ফাইনালস) আয়োজন করেছে বাংলাদেশ। আইসিপিসি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক (ইউএপি) আয়োজিত এ প্রতিযোগিতায় ৪৭টি দেশ থেকে ১৩৭টি দল অংশ নিয়েছে।
পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের সংযুক্তির মহাসড়কের নাম ফাইভ-জি প্রযুক্তি। ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথ বেয়ে আমরা ফাইভ-জি যুগে প্রবেশসহ ডিজিটাল সংযুক্তির মহাসড়ক গড়ে তুলছি। আমরা ২০১৮ সালে ফাইভ-জি প্রযুক্তির পরীক্ষা সম্পন্ন করেছি এবং ২০২২ সালের শুরুতেই বাংলাদেশ ফাইভ-জি যুগে প্রবেশ করেছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে ফাইভ-জিতে কানেক্ট করা হয়েছে এবং সরকারের সব কানেকটিভিটি করে ফেলা সম্ভব হয়েছে, সরকারি হাসপাতালসহ অন্যান্য অফিসকেও কানেক্ট করা হয়েছে। সবাই ফাইভ-জির জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছে এই বছর এবং এখন ইউস কেইস নিয়ে সার্ভে দরকার। ২০২৩ সালে ফাইভ-জি পরিপূর্ণভাবে বাংলাদেশে শুরু করা, যাতে সম্ভব হয় তার জন্য পরিকল্পনা করতে হবে।

দেশে ২০০৮ সালে মাত্র সাড়ে সাত জিবিপিএস ইন্টারনেট ব্যবহূত হতো এবং ব্যবহারকারী ছিল মাত্র ৭ লাখ। বর্তমানে দেশে ১৩ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং ৩৮৪০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারের উদ্যোগে ফাইবার অপটিক কেবল পৌঁছলেও প্রান্তিক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা সহজলভ্য হয়নি এখনও। আগামী বছর এই কানেকটিভিটি দেশের ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়নে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং তবেই ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উপভোগ করতে পারবে। ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে ৬০০০ জিবিপিএসেরও বেশি আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইথের প্রয়োজন হতে পারে। আমাদের নিজস্ব চাহিদা মেটানোর পরও হাতে যথেষ্ট পরিমাণ বথ্যান্ডউইথ আছে ও থাকবে। আইসিটি খাতে ২০২২ সালে কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পূরণের প্রত্যাশা থাকলেও, তা শতভাগ পূরণ হয়নি। ডিজিটাল সেবার ক্ষেত্রে প্রতিবেশী ও সমপর্যায়ের অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ব্যবসা সহজ করতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার (ওএসএস) চালু করেছে। যদিও তা খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না। ২০২২ সালের শেষে এসে দেখা যাচ্ছে, একটি সড়কেও এই ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) অথবা ইন্টারনেট অব এভরিথিংভিত্তিক (আইওই) স্বয়ংক্রিয় টোল আদায়ের ব্যবস্থা চালু হয়নি। প্রায়ই মহাসড়ক ও সেতুতে টোল দিতে যানবাহনের জট লেগে যায়। ২০২৩ সালে অন্তত ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে সড়কে টোল আদায়ের কাজটি স্বয়ংক্রিয় করা সম্ভব হবে, যাতে যানবাহনকে থামতে না হয়। দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে মানবসম্পদ বাড়লেও তারা ইন্ডাস্ট্রির উপযোগী হয়ে গড়ে উঠছে না। নতুন যুগের এসব চাকরির জন্য প্রয়োজন উঁচু স্তরের কারিগরি দক্ষতা। ডাটা সায়েন্টিস্ট, আইওটি এক্সপার্ট, রোবটিক্স ইঞ্জিনিয়ারের মতো আগামী দিনের চাকরিগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী তরুণ জনগোষ্ঠী। আগামী বছর থেকে প্রয়োজনে শিক্ষানবিশ কার্যক্রম বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি বাস্তব জীবনের কার্যক্রম সম্পর্ক হাতে-কলমে শিখতে পারে। শুধু পুরস্কার বিতরণে সীমাবদ্ধ না থেকে ফ্রিল্যান্সারদের রি-স্কিলিং ও আপ-স্কিলিংয়ের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে আমাদের।

আইসিটি খাত বর্তমানে শীর্ষস্থানীয় রপ্তানি খাতের একটি। কিন্তু ২০২২ সালে আইসিটি খাতে আমরা আশানুরূপ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারিনি। ২০২৩ সালে এই গ্যাপ পূরণ করতে পারলে ২০২৫ সালের মধ্যে রপ্তানি আয় বেড়ে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে বলে আমি আশাবাদী।

লেখক
প্রযুক্তিবিদ
সাবেক সভাপতি, বেসিস

আরও পড়ুন

×