ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

অধিকার

নারীর অধিকার মানবাধিকার

নারীর অধিকার মানবাধিকার

সুলতানা কামাল

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৮:০০ | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৩ | ০৩:৫৮

মানবাধিকারের মূল কথা হলো, মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে কিছু অধিকার তার অবশ্যপ্রাপ্য হয়ে যায়; যা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। তাই মানবাধিকারকে বলা হয়েছে সহজাত, সর্বজনীন, অবিচ্ছেদ্য এবং অলঙ্ঘনীয়। এই সনদ অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষ সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ, নির্যাতনমুক্ত ও শঙ্কাহীন জীবনের দাবিদার থাকবে। তার যে কোনো অধিকার লঙ্ঘনে ন্যায়বিচার পাবে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোয় সমঅধিকার, মানবিক মর্যাদা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার এই সনদ জাতিসংঘ দ্বারা রচিত ও গৃহীত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভয়ানক মানবিক বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে। সহজাত সর্বজনীন মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকারের এই দলিল মানবজাতির সভ্যতার ইতিহাসে এক বিরাট অগ্রগতির স্বাক্ষর বহন করে। কিন্তু আজকে একুশ শতকে এসেও বলতে হয়, নারী নারী হয়ে জন্মায় বলেই কিছু অধিকার থেকে- হোক তা আইনিভাবে কি বেআইনি- তাকে বঞ্চিত রাখা হয়। ২০২২ সাল অতিক্রান্ত হলেও নারীর এই অধিকার বঞ্চনার শেষ হয়নি।

সর্বজনীন মানবাধিকারের মূল সনদটি ইংরেজি ভাষায় লেখা। ইংরেজি ভাষায় একবচনে নারী-পুরুষ উভয়লিঙ্গকে বোঝাতে কোনো সাধারণ শব্দ নেই। নারীকে বোঝাতে 'শি' ও 'হার' বলা হয় এবং পুরুষকে বোঝাতে 'হি' ও 'হিজ'। জাতিসংঘ গৃহীত মানবাধিকারের সনদে সব অধিকারের কথাই পুংলিঙ্গে লেখা হয়েছে। প্রায় অর্ধশত বছর পরে নারীবাদী আন্দোলনের চাপে সদস্য রাষ্ট্রগুলো একমত হয়, সনদে যেভাবেই উল্লেখ করা হোক না কেন, প্রতিটি অধিকার নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য হবে। তারপরও যে অপূর্ণতা থেকে যায়, সেটির জন্য ১৯৭৯ সালে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য রোধে 'কনভেনশন অন দি এলিমিনেশন অব অল ফরমস অব ডিসক্রিমিনিশন অ্যাগেইনস্ট উইমেন (সিডোও)' ঘোষিত হয়। বাংলাদেশ কিছু সংরক্ষণ সাপেক্ষে সনদটিতে অনুস্বাক্ষর করেছে। আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের সংবিধানে সব নাগরিককে আইনের চোখে সমান বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কোনো কারণেই কারও প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন না করার স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আমার আজকের আলোচনার নির্দিষ্ট বিষয়- নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদার নিরিখে আজকে বাংলাদেশে নারীর অবস্থানের স্বরূপটা কেমন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নারীর অবস্থানের উন্নতি সাধনে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে সন্দেহ নেই। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসার পর রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন ও অন্যান্য পেশায় নারী গুরুত্বপূর্ণ পদে দৃশ্যমান হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। নারীর অধিকার রক্ষায় বেশ কিছু আইন ও নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদার প্রশ্নে আমরা কতটা পথ এগোতে পেরেছি? এত কিছুর পরেও প্রকৃতপক্ষে আমরা নারীর সার্বিক মুক্তি ও নিরাপত্তা বিধান করতে পারছি না কেন? এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না আইন, নীতি, ঘোষণা বা অঙ্গীকার স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে না। তার জন্য নীতিনির্ধারকদের এবং দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত শক্তিকে দৃঢ় চিত্তে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হয়। বাংলাদেশের নারীদের অভিজ্ঞতায় সেটি কতখানি বাস্তব হয়ে উঠতে পেরেছে?
আমাদের সংবিধান, যা দেশের সর্বোচ্চ আইন বলে গণ্য, সেখানে বলা আছে- জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, কে কোথায় জন্মগ্রহণ করেছে নির্বিশেষে সকল নাগরিক রাষ্ট্রের চোখে সমান অধিকার ও মর্যাদার দাবিদার হবে। বিশেষভাবে বলা হয়েছে, জনজীবনে নারী সকল নাগরিকের মতো সমান অধিকার ভোগ করবে। কর্মক্ষেত্র, বিশ্রাম বা বিনোদনের জায়গায় নারীর প্রতি কোনো বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না। আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক নির্দেশনা হলো- সংবিধান বলবৎ হওয়া মাত্র দেশে প্রচলিত সকল বৈষম্যমূলক আইন বাতিল বলে গণ্য করা হবে।

কিন্তু সংবিধান বলবৎ হওয়ার ৫০ বছর পার করেও আমরা দেখতে পাচ্ছি- এই নির্দেশনাকে অমান্য করে চরম বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন প্রচলিত রয়েছে, যা ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত মৌলিক কিছু ক্ষেত্রে নারীকে সমঅধিকার ও সমমর্যাদা থেকে আইনিভাবেই বঞ্চিত করা অব্যাহত রেখেছে। এই আইন অনুযায়ী শুধু একই ধর্মের নারী-পুরুষের মধ্যে নয়, বিভিন্ন ধর্মের নারীদের মধ্যেও বিয়ে, বিয়ে বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অসম অধিকার বজায় রেখেছে। এই আইনের কারণে একজন নারী যত শিক্ষিত বা উচ্চপদস্থ পেশাজীবী অথবা যতই প্রভাবশালী নাগরিক হোন না কেন, ব্যক্তিগত জীবনে পুরুষের অধীন ও পুরুষনির্ভর জীবনযাপন করতে বাধ্য থাকেন। নারী অধিকার ও মানবাধিকার আন্দোলনের দীর্ঘদিনের আবেদন, নিবেদন, দাবি সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত এই আইন বাতিল করা হয়নি। সংবিধানকে মান্য করলে পারিবারিক আইনের প্রচলন যে সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক- এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ সিডোও সনদ অনুস্বাক্ষর করল কিন্তু ধারা ২ এবং ১৬-এর (১) গ উপধারা সংরক্ষণসহ। ধারা ২ হচ্ছে সিডোওর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা, যেখানে সদস্য রাষ্ট্রগুলো নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপের অঙ্গীকার ঘোষণা করছে। ১৬ (১) গ হচ্ছে নারীর বৈবাহিক জীবনে সমঅধিকার নিশ্চিত করার ঘোষণা। জাতীয় নারী আন্দোলন এবং একই সঙ্গে জাতিসংঘের সিডোও কমিটির বারবার তাগাদা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এই সংরক্ষণ তুলে নেওয়ার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং নানা অজুহাতে তা বজায় রেখেছে।

বাংলাদেশের নারী আন্দোলন তাদের নানা দাবিদাওয়ার মধ্যে সর্বজনীন পারিবারিক আইন প্রণয়নের ওপর জোর দিয়ে আসছে। আশির দশক থেকেই সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ 'নারীর অধিকার মানবাধিকার' এই নীতির আলোকে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যমূলক আইন বাতিল করার সুপারিশমালা পর্যন্ত তৈরি করে প্রতিটি সরকারের কাছে তা নিয়ে দেনদরবার করে চলেছে। বাংলাদেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে নারী আন্দোলনের নিরলস সংগ্রামের ফলে। কিন্তু সে আইনের প্রয়োগ এতই দুর্বল এবং আইনের বাস্তবায়নে নিয়োজিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর প্রতি এতই বিদ্বেষদুষ্ট যে এখন পর্যন্ত আমরা যে পরিসংখ্যান পাই, তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশে ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার যত মামলা হয়, তার মাত্র চার থেকে পাঁচ ভাগ মামলায় আসামিরা শাস্তি পায়। ধর্ষণের মামলায় শাস্তির হার আরও কম। ব্র্যাকের একটি গবেষণায় দেখা গেছে জেন্ডার সহিংসতায় ৩৮৫টি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ। যেসব নারী আদালতের আশ্রয়প্রার্থী, তাদেরই কোনো কোনো আদালতে তিরস্কৃত হতে হয়েছে- এমনও দৃষ্টান্ত বিরল নয়। পারিবারিক সহিংসতাকে অপরাধ বলেই গণ্য করা হতো না এই কিছুদিন আগেও। এর বিরুদ্ধে আইন পেতে নারীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০১০ সাল পর্যন্ত। যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও, বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি। নারীরা বিচার চাইতে গেলে মামলা না নেওয়া, অপ্রযোজ্য ধারায় মামলা দায়ের করা, তদন্ত বা ডাক্তারি পরীক্ষায় সত্য গোপন করা, মামলা করার কারণে পুনরায় তার ওপর আক্রমণ করা; সেটিই যেন নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। যারা এমন অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য দায়ী, তাদের জবাবদিহির কোনো নজির পাওয়া যায় না। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণ, ধর্ষণের পরে হত্যা বা আত্মহত্যা, দলবেঁধে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, শারীরিক নির্যাতন, অপহরণ, হত্যা, নিখোঁজের ঘটনার মতো নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমে বেড়ে চলেছে। আমাদের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে শিশু ও নারী নির্যাতনের প্রকাশিত ঘটনা ছিল ৩ হাজার ৬৪৪টি। সেই সংখ্যা ২০২২-এ এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২১০টিতে। পরিবার বা পরিবারের বাইরে কোথাও নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি এখনও। এর মধ্যে করোনা এবং তার পরবর্তীকালে কিশোরী ও কন্যাশিশুদের মধ্যে বাল্যবিয়ের হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যায়। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে বিশেষ পরিস্থিতিতে ব্যতিক্রমের সুযোগ রাখার কারণে নারীর বিরুদ্ধে এ ধরনের বেআইনি অপরাধমূলক কাজ করে পরিবার, সমাজ সহজেই পার পেয়ে যায়। শিক্ষা ব্যবস্থা ও সামাজিক সংস্কৃতিতে রক্ষণশীল মৌলবাদী এবং নারীর প্রতি বিদ্বেষ ও অসম্মানজনক ধ্যান-ধারণার অনুপ্রবেশে সরকারের প্রশ্রয় অত্যন্ত স্পষ্ট।

একদিকে নারীর অধিকার রক্ষার ঘোষণা, অন্যদিকে তার বিপরীতধর্মী সংস্কৃতির সঙ্গে আপস- সরকারের এই দোদুল্যমানতার কারণে নারীর ক্ষমতায়ন যতটুকুই হয়েছে, তার সঙ্গে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নে প্রত্যাশিত মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। নির্বাচনের সময় আসন্ন। রাজনৈতিক দল, বিশেষত ক্ষমতাসীন দল বরাবরের মতো সব নাগরিকের সঙ্গে নারীর অধিকারেরও অনেক অঙ্গীকার করবে। আমরা আশা করব ক্ষমতায় গিয়ে তারা একইভাবে তাদের নিজেদের করা অঙ্গীকার ভুলে যাবে না। বর্তমান সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে- কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না- নীতিসমৃদ্ধ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের নৈতিক দায় গ্রহণ করেছে। আমরা আশা করব সরকার সেই দায় সম্মানের সঙ্গে বহন করবে। আমাদের দাবি নারী থাকবে স্বাধীন, নিরাপদ এবং নির্যাতনমুক্ত- ২৪ ঘণ্টা, ঘরে-বাইরে।

লেখক
মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন

আরও পড়ুন

×