ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

সমকাল, বেলা ও এএলআরডির যৌথ আয়োজনে সেমিনার

কক্সবাজারকে বাঁচাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি

কক্সবাজারকে বাঁচাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি

--

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০

স্বাধীনতার ৫২ বছরেও পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে ওঠেনি কক্সবাজার। দখল-দূষণে বিপর্যস্ত নগরীর পরিবেশ ও প্রতিবেশ। আইনের তোয়াক্কা না করেই ইচ্ছামতো এখানে গড়ে তোলা হচ্ছে হোটেল-মোটেলসহ ছোট-বড় স্থাপনা। অবৈধভাবে কাটা হচ্ছে পাহাড়; চলছে বালু উত্তোলন। পর্যটন নগরীকে এমন নাজুক পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অঙ্গীকার জরুরি। এ জন্য চাই সমন্বিত উদ্যোগ। গত ১৮ মে নগরীর হোটেল সি-গালে আয়োজিত ‘বিপর্যস্ত কক্সবাজারের পরিবেশ ও প্রতিবেশ: করণীয় নির্ধারণ’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন বিশিষ্টজন। সমকাল, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এবং অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) এই আয়োজন করে। এতে পরিবেশ নষ্ট করার পেছনে জড়িতদের চিহ্নিত করার দাবি উঠেছে

অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল

 আমরা সবাই জানি, পরিবেশগতভাবে কক্সবাজার বিপর্যস্ত। দুঃখজনক হলেও সত্য– এতে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। আমরা চাই এখনও যতখানি পারা যায় কক্সবাজারকে রক্ষা করতে। এতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে চাই। এ জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এতে কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না। অনেকেই বলেছেন, প্রশাসনকে উদ্যোগটা নিতে হবে। প্রশাসনের মধ্য থেকে কে সেই উদ্যোগ নেবেন? যদি জেলা প্রশাসকের দিকে তাকাই, জুতা সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ– সবকিছু করতে হয়। কাজেই আমরা জানি না, জেলা প্রশাসক সে দায়িত্ব নিতে পারবেন কিনা। কাজেই এটা তাদের ওপর নির্ভর করছে, কারা এ দায়িত্ব নিতে পারবেন।  আমরা জানি, বিপর্যস্ত শুধু কক্সবাজার নয়; দেশের নানা জায়গায় নদী দখল হয়ে যাচ্ছে; পাহাড় কাটা হচ্ছে; বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। ঢাকার সাতমসজিদ রোডে আমরা দাঁড়াচ্ছি। তরুণরা সারারাত গাছ পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু গাছ তো কাটা হয়ে যাচ্ছে। বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের সেই শোভা দেখা যাচ্ছে না। আগের যে কক্সবাজারের ছবি মনের মধ্যে রয়েছে, সেই ছবির সঙ্গে এখনকার ছবি মেলে না। একমাত্র রাজশাহী ছাড়া দেশের কোনো এলাকা সেই সৌন্দর্য রক্ষা করতে পারেনি। সুন্দরবন থেকে বান্দরবান– সব জায়গায় একই অবস্থা। সবাই বলে আসছেন, সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে, কিন্তু হচ্ছে না। এতদিন ধরে সেটা হয় না কীসের জন্য? মাঝখানে বাধাটা কারা দিচ্ছে? এ কথাগুলো স্পষ্টভাবে আমরা বলতেও পারি না। আমরা অনেক কথা বলি; দুর্বৃত্তের কথা বলি। কিন্তু দুর্বৃত্ত কারা, তা চিহ্নিত করতে ভয় পাই। যাদের চিহ্নিত করতে ভয় পাই, তাদের বিরুদ্ধে কীভাবে আমরা পদক্ষেপ নেব? নেওয়া তো সম্ভব না কোনো অবস্থাতেই। আমরা জানি, এটা কারা করে। জেলা প্রশাসক ও ইউএনওদের মুখেও আমরা অসহায়ত্বের সুর শুনি। সেই অসহায়ত্বটা কোথা থেকে আসে? সেখানেই আমাদের কথা বলতে হবে। কথা বলতে পারতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে পরিবেশবান্ধব যে বিষয়গুলো থাকে, আমরা সব সময় তা সত্য বলে মেনে নিই। আমি বিশ্বাস করি, তিনি সেটা চানও এবং আমরাও সবাই সেটা চাইছি। তাহলে আমরা করতে পারছি না কেন? যারা করতে দিচ্ছে না, তাদের শক্তির উৎস কোথায়? সংবিধানে নাগরিকদের সংঘবদ্ধ হওয়ার অধিকার রয়েছে। একত্রিত হয়ে সংগঠন করতে গেলেই সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়। তাহলে কী করে আমি বুঝব, মানুষ কাজ করুক– সেটা সরকার চায়! আমার তো মনে হয় না, সরকার চায় মানুষ কাজ করুক। না হলে এ নিয়মগুলো করে রেখেছে কেন? এনজিও অ্যাক্টের নামে আমাদের বেঁধে ফেলা হয়েছে। যারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ দিয়েছেন; তারাই সবচেয়ে বেশি নির্দেশ উপেক্ষা করেন। তাদের দ্বারাই আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি– এ কথাটা বলার সাহস আমরা রাখতে পারি না। কারণ, বলার পর আমাদের কী হবে, তা আমরা কেউ জানি না। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাতে না পারলে সবাই বিপর্যস্ত হবো।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান উন্নয়ন অবশ্যই হবে। তবে সব জায়গায় একই রকম হবে না। যদি কক্সবাজারে কোনো প্রকল্প-শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়তে চায়, সেখানে যদি বন-গাছ কাটতে হয়, তখন অনুমতি দেওয়া যাবে না। কারণ পাহাড় একটি প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। এটি দুর্যোগ থেকে মানুষকে বাঁচায়। সম্প্রতি মোকার ভয়ে আমরা থরথর করে কাঁপছিলাম।  যদি উপকূলীয় বনের শক্ত বেষ্টনী থাকত, তাহলে কাঁপাকাঁপি অনেকটা কমে যেত। আমরা উন্নয়ন করব বলে এগুলো সব নষ্ট করে দেব, তারপর মোকা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ব– এটিই হচ্ছে আমাদের বৈশিষ্ট্য। দেশে যেখানে যা উন্নয়ন আছে কিংবা হচ্ছে; কক্সবাজারকে অন্য এলাকার সঙ্গে তুলনা করলে হবে না। কারণ এটি প্রতিবেশগত অত্যন্ত সংবেদনশীল জায়গা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো হটলাইন চালু করা যায় কিনা, যেখানে পাহাড় কাটা, নদী দখল কিংবা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করলে সঙ্গে সঙ্গে তথ্য দেওয়া যাবে। এর বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হোক বা না হোক, একটা রেজিস্টার মেইনটেইন করলে পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। আমাদের দেশে আইন আছে কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। সমন্বয়ও নেই। এগুলো ইচ্ছা করেই নেই। কারণ এগুলো থাকলে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধার করা যাবে না। কক্সবাজারে পাহাড় কাটা যাবে না– দাগ-খতিয়ান ধরে আদালত বলে দিয়েছেন। আর কী করব! আদালত তো আর এসে পাহাড় পাহারা দেবেন না! রামুতে বাফুফে ফুটবল ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণ করবে বনের মধ্যে। অথচ বিকল্প আরও দুটো অপশন ছিল। কিন্তু তারা সেখানে যাবে না; বনের মধ্যেই করবে। বন বিভাগ থাকতে ৭০০ একর রক্ষিত বনভূমি ও ন্যাশনাল পার্ক ঘোষিত বনভূমি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য কেমন করে দেওয়া যায়! কক্সবাজার তো প্রকৃতি ও পরিবেশের দিক থেকে আমাদের জন্য জাতীয় ঐতিহ্য। কক্সবাজারে পরিবেশগত সব ইস্যুর একটা তালিকা করে, গুরুত্ব বিবেচনায় নাগরিক সমাজ থেকে উদ্যোগ নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন। বাঁকখালী নদীতে পরিবেশ অধিদপ্তর সৃজিত বন ধ্বংস করে হঠাৎ কিছু টিনের ঘর উঠে গেল। জোয়ার-ভাটার পানি এ ঘরের মধ্যে ঢুকছে। এটা কেমন করে নদীর এলাকা না হতে পারে! এটা কেমন করে ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গা হতে পারে! এসব দেখার কেউ নেই। আবু সাঈদ খান উন্নয়ন নিয়ে যে দর্শন, এটি একটি ভুল দর্শন। উন্নয়নের নামে মেগা প্রকল্প, দালান-কোঠা ইত্যাদি হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন, মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, নৈতিকতার উন্নয়ন– এগুলো আমাদের ডিকশনারিতে নেই। এসব বিষয় পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। তা করতে হলে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। কাজটি কে করবে? অবশ্যই সরকারকে করতে হবে। সে জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ। তারপরও নাগরিক হিসেবে আমরা চিৎকার করতে পারি। আমরা কথা বলতে পারি এবং সেটা আমাদের বলে যেতে হবে। এটি রাজনৈতিক ইস্যু হওয়া দরকার। ভয়ের সংস্কৃতি আছে। সব কথা বলতে পারি না; লিখতেও পারি না। আমাদের হাত-পা ১০০ ভাগ খোলা নেই। তারপরও আমাদের সাহস করে বলতে হবে। সম্মিলিত শক্তির কাছে অশুভ শক্তি নতজানু হয়। জনশক্তি সবচেয়ে বড় শক্তি। দেশের সঠিক ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন আমরা চাই। কক্সবাজারকে বাঁচাতে চাই। এ জন্য ‘কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলন’ গড়ে তোলা দরকার। এ লক্ষ্যে সংগ্রাম কমিটি কিংবা গণকমিটি গঠন করা যেতে পারে। আমরা যারা কক্সবাজারের বাইরে বাস করি, সবাই এ আন্দোলনে শরিক হতে পারি। কক্সবাজারকে বাঁচানোর জন্য সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে।

শামসুল হুদা সবার কথায় উঠে এসেছে, কক্সবাজার পরিবেশ ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। কক্সবাজারের ভবিষ্যতের সঙ্গে আমাদের জাতির ভবিষ্যতের সম্পর্ক আছে। এ সমস্যাকে আমি শুধু কক্সবাজারের সমস্যা বলতে চাই না। এটি জাতীয় সমস্যা। যেমন সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, কক্সবাজারে ৬৩ জেলার মানুষ এসে কিছু একটা করতে চায়। এখানে তাদের একটা কিছু থাকতে হবে। যাদের নেই, তারাও অন্তত বছরে একবার ভিজিট করতে আসে। আবার অনেকেই বহুবার আসে। কক্সবাজারের সমস্যা বিশ্বসমস্যা। কক্সবাজারের সমস্যা বাংলাদেশের সমস্যা। কক্সবাজারের সমস্যা জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হওয়া দরকার। সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব আমাদের সবার। তবে মূল দায়িত্বটা সরকারকেই নিতে হবে এবং এখানে যে আলোচনা হয়েছে, যে সমস্যাগুলো আছে, তা সমন্বিতভাবে দূর করতে হবে। প্রথমত, পরিবেশের যেসব সমস্যা রয়েছে, তার একটি তালিকা হওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত, কারা নদী দখল করছে, কারা পাহাড় কাটছে, কারা বন কাটছে– এটা তো অজানা কিছু নয়। দেখা যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের কারও নাম বলা হচ্ছে, কারও নাম বলা যাচ্ছে না– এ ভয়-ভীতির কালচার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যারা দুর্বৃত্তপনা করছে, তাদেরকে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। তাদের প্রভাব যতই থাকুক না কেন, কক্সবাজারকে রক্ষা করার জন্য আমরা যদি সম্মিলিতভাবে অবস্থান নিতে পারি, তাহলে পরিবেশ রক্ষা পাবে। এ বিষয়ে আমাদের একটি কর্মপরিকল্পনা থাকা দরকার। এর উদ্যোগ জেলা প্রশাসনকে নিতে হবে এবং আমরা তাদের সঙ্গে থাকব।

খুশী কবির সমস্যা ও সমাধান কী– তা আমরা সবাই জানি, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না।  এ ক্ষেত্রে সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। কক্সবাজার একটি বড় শহর, তবে অপরিকল্পিত। এখানে পরিকল্পিতভাবে কোনো কিছু হয়নি। একেবারে বিচের ওপর কারা জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে, ঘর তুলেছে, রিসোর্ট করেছে, কী স্থাপনা করছে, সেগুলো আমরা দেখছি। তাই এসবের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সমন্বয়ের অভাবে আসলে কোনো কিছুই হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে বিরাট ঘাটতি রয়ে গেছে। এলাকার জনগণ এবং যারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাদের মধ্যে গ্যাপ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও উদাসীনতা রয়েছে। এটিই সবচেয়ে বড় সমস্যা। এ সমস্যার কারণে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে কক্সবাজারের। এতে শুধু পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে না; কক্সবাজারে যারা বসবাস করেন, তাদেরও অনেক ক্ষতি হচ্ছে। যখন চকরিয়া, সুন্দরবন ধ্বংস করা হয়েছে তখন সংশ্লিষ্টরা মনে করেছিলেন, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের খুব বেশি প্রয়োজন নেই। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আমাদের পৃথিবী তথা জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা তাদের জানা ছিল না। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল উজাড় করে জনপ্রতি এক একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল চিংড়ি চাষের জন্য। চিংড়ি চাষ টেকসই হয় না, যার উদাহরণ থাইল্যান্ড। এক সময় থাইল্যান্ড বিশ্বের সেরা রপ্তানিকারক দেশ ছিল। এখন তারা এ অবস্থানে নেই। ভারত চলে এসেছে বিশ্বের সেরা রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে। কাজেই কক্সবাজার সুরক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। জাহিদ ইকবাল কক্সবাজার এমন একটি জেলা, যেখানে দেশের ৬৩ জেলার লোকজন আশা করে– এখানে তাদের কোনো একটা কিছু থাকতে হবে। যখন ৬৩ জেলার লোকজনের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু থাকে, তখন সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য একটা চাপ তৈরি হয়। এর মধ্য দিয়ে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা থাকার পরও পরিবেশের প্রতি আমাদের যে কমিটমেন্ট, সেটা অবশ্যই সুস্পষ্ট থাকতে হবে। কক্সবাজার সারাবিশ্বের সম্পদ। এটি কোনোভাবে ধ্বংস করতে দেওয়া যায় না। ইতোমধ্যে সমুদ্রসৈকত ও বাঁকখালী নদী থেকে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা স্থাপনা ও লোকজন উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখন সবার লক্ষ্যবস্তু সেন্টমার্টিন। এখানে হোটেল-মোটেল নির্মাণের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। সেন্টমার্টিনে কোনো কিছু করতে গেলে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুমতি নিতে হয়। রাতের আঁধারে সেখানে কীভাবে ইট, রড-সিমেন্ট নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এটি চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করছে জেলা প্রশাসন। বছরের বেশির ভাগ সময় দ্বীপটা বিচ্ছিন্ন থাকে। সুতরাং যাতায়াত ব্যবস্থা যখন কঠিন হয়, তখন প্রভাবশালী লোকজন স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষায় ইতোমধ্যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মানুষও তো পরিবেশের অংশ। এ পরিবেশে মানুষকেও টিকে থাকতে হবে। এ ছাড়া উন্নয়নেরও কিছু ইস্যু থাকে। উন্নয়নকে আমরা অস্বীকার করতে পারব না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী না চাইতেই কক্সবাজারে অনেক মেগা প্রকল্প দিয়েছেন। পরিবেশ ধ্বংস হবে– এ কথা বলে মেগা প্রকল্প থেকে পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই। পরিবেশের ক্ষতি যতটুকু সম্ভব কমিয়ে রেখে উন্নয়ন করলে এ উন্নয়নকে সবার ধন্যবাদ জানানো উচিত। ফরিদ আহমেদ কক্সবাজারে পাহাড় কাটা একটি বড় ইস্যু।  পাহাড়ি এলাকা অর্থাৎ যেখানে পাহাড় কাটা হচ্ছে, সেখানে বেসরকারি সংগঠনগুলোর সহায়তায় কমিউনিটি গ্রুপ তৈরি করতে পারি কিনা। তাদেরকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারলে তারা ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবেশ অধিদপ্তর প্রতি বছর একটি সমসাময়িক ইস্যুর ওপর সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করে দেশব্যাপী এবং ব্যাপকভাবে পরিবেশ দিবস উদযাপন করে। এ বছরের প্রতিপাদ্য ছিল প্লাস্টিক দূষণ বিষয়ে। বর্তমানে ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের কারণে সমুদ্র সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে। তাই ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কারণ আমরা যে ওয়ানটাইম প্লাস্টিক ব্যবহারের পর রাস্তায় ফেলে দিই, তা ড্রেন-নদী হয়ে সাগরে যাচ্ছে। ফলে সাগর দূষণের শিকার হচ্ছে।

মো. আবুল হাশেম ২০১৩ সালের মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ৩০০ মিটারের মধ্যে স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ। সে বিষয়ে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত সচেষ্ট, যাতে নতুন কোনো স্থাপনা করতে না পারে। এর আগে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে, তা বিভিন্ন সময়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আরও উচ্ছেদ করার কাজ চলছে। কক্সবাজারের হোটেল-মোটেলগুলো তাদের বর্জ্য পরিকল্পিতভাবে ফেলছে না। সব বিষয় মাথায় রেখে পরিকল্পিত শহর গড়ার লক্ষ্যে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রীয়ভাবে এসটিপি নির্মাণে কাজ করছে। পাশাপাশি সেন্টমার্টিনে যেসব অবৈধ স্থাপনা রয়েছে, তা উচ্ছেদ করা হবে। একই সঙ্গে কোথাও যেন নতুন করে অবৈধ স্থাপনা তৈরি না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। কক্সবাজার বিশ্বের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। তাই কক্সবাজার রক্ষায় আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাত কক্সবাজারের ওপর পড়ে উপকূলীয় এলাকা হিসেবে। তাই পরিকল্পনা রয়েছে উপকূলীয় এলাকাতে কীভাবে বনায়ন ফিরিয়ে আনা যায়।

মো. আনোয়ার হোসেন সরকার পাহাড় কাটা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। আমি যখন দেড় বছর আগে কক্সবাজারে আসি; পাহাড় কাটা দেখে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ শুরু করি। দেখা গেছে, জেলা প্রশাসন বালুমহাল ইজারা দিয়েছে এক জায়গায়; ইজারাদার বালু কাটে আরেক জায়গায়। এটি আমাকে খুব ব্যথিত করেছে। এসব কারণে জেলা প্রশাসন বেশ কিছু ইজারা বাতিলও করেছে। পাহাড় কাটার সময় এ পর্যন্ত ৫০টিরও বেশি ট্রাক জব্দ করেছি। মামলাও দিয়েছি; জনসচেতনমূলক অনেক সভা করেছি। তার পরও পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে না। পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হলে আগে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে এবং রাজনৈতিক কমিটমেন্ট নিয়ে আসতে হবে। তাহলে কক্সবাজারে পাহাড় কাটা বন্ধ করা সম্ভব। বিভিন্ন জায়গায় পাহাড় কাটায় নিয়োজিত অবৈধ ডাম্পার অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। কক্সবাজারের হারানো পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। মো. সারওয়ার আলম রোহিঙ্গা আসার কারণে প্রভাবটা সরাসরি পড়েছে বনভূমির ওপর। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের জন্য কাগজ-কলমে ৬ হাজার ১৬৪ একর বনভূমির কথা বলা হলেও বাস্তবে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাসহ রোহিঙ্গাদের দখলে ১০ হাজার একরের ওপরে। ওখানে যত উন্নয়ন হচ্ছে; প্রতিটি কাজে বনের বালু ব্যবহার হচ্ছে, বনের মাটি ব্যবহার হচ্ছে। গাছ তো এখন তেমন নেই। তারপরও কাটা হচ্ছে পাহাড়। এগুলো মোকাবিলা করেই কাজ করতে হচ্ছে। কক্সবাজারে বন কিংবা বনভূমি রক্ষা করতে হলে কোথায় কী হবে, তার একটা মাস্টারপ্ল্যান দরকার। এর বাইরে কোনো কিছু করা যাবে না। এগুলো করতে গেলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কমিটমেন্ট থাকতে হবে। যারা তা অমান্য করবে, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কক্সবাজারে গত কয়েক বছরে বন বিভাগ প্রায় ২০ হাজার একর বনায়ন করেছে। কক্সবাজারে সুপেয় পানির খুবই অভাব। এর অন্যতম কারণ বন বিপর্যয়। বনের আচ্ছাদন কমে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি ধরে রাখা যাচ্ছে না। নিচের পানি অতিরিক্ত তুলে ফেলা হচ্ছে। ভেতরে ঢুকে পড়ছে লবণাক্ত পানি। বৃষ্টি কিংবা নদীর পানি যদি ধরে রাখতে না পারি তাহলে সামনে সুপেয় পানির সমস্যা আরও বাড়তে পারে।

লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ২০টি দায়িত্ব রয়েছে। প্রথম দায়িত্ব ছিল মাস্টারপ্ল্যান করা। মাস্টারপ্ল্যান মানে কক্সবাজার জেলার ৬৯০ দশমিক ৬৭ বর্গ কিলোমিটার জায়গায় কোথায় কী হবে তার তালিকা করার জন্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটা বোর্ড হলো এবং জায়গাও গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারপর মাস্টারপ্ল্যান করার জন্য ডিবিবি তৈরি করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনও নিয়ে ফেলি আমি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার আগে। এর পর আজ পর্যন্ত আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। কারণ এখানে বিভিন্ন প্যাঁচ দেওয়া হয়। এতে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অসহায় হয়ে গেছে। সুতরাং কক্সবাজারে কোথায় কী করতে হবে, স্থানীয় লোকজনকে বসে ঠিক করতে হবে। তা না হলে কোনো কিছুই হবে না। বর্তমানে আইন আছে কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। আমাদের মধ্যে কোনো বিবেক নেই। নৈতিকতা জিরো হয়ে গেছে। সরকারি কর্মকর্তারা চাকরি করতে আসবেন। তাঁরা আইনের বাইরে যাবেন না। এসিআর ভালোর জন্য সবাইকে ম্যানেজ করে তাঁকে চলতে হবে। কক্সবাজারকে রক্ষার জন্য স্থানীয়দের সোচ্চার হতে হবে। আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা চকরিয়া সুন্দরবনকে যদি আমরা সুরক্ষিত রাখতাম এবং প্রকল্প নেওয়ার আগে কস্ট অব বেনিফিট অ্যানালাইসিস করতাম, তাহলে বুঝতে পারতাম সুন্দরবন থেকে বেনিফিট বেশি, নাকি চিংড়ি চাষ থেকে। এখন চিংড়ির এক্সপোর্ট সম্পূর্ণ বন্ধ। অন্যদিকে বনও ধ্বংস হয়ে গেছে। তাহলে বেনিফিটটা কোথায়? তাই প্রতিটি প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে কস্ট অব বেনিফিট অ্যানালাইসিস করা দরকার। কক্সবাজারে যে পাহাড়-বন ধ্বংস হচ্ছে, এতে কী পরিমাণ পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, তার একটা পূর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রয়োজন। সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য কারণে যেভাবে কক্সবাজারের পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে, এটাকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া আইনের প্রয়োগ সবার ক্ষেত্রে সমান হওয়া উচিত।


    

 সভাপতি ও সঞ্চালনা

আবু সাঈদ খান উপদেষ্টা সম্পাদক সমকাল প্রধান আলোচক

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রধান নির্বাহী বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) আলোচক

অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল নির্বাহী পরিচালক মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশন খুশী কবির সমন্বয়ক, নিজেরা করি শামসুল হুদা নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি জাহিদ ইকবাল অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কক্সবাজার ফরিদ আহমেদ পরিচালক পরিবেশ অধিদপ্তর, কক্সবাজার মো. আবুল হাশেম সচিব কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ মো. আনোয়ার হোসেন সরকার বিভাগীয় কর্মকর্তা কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগ মো. সারওয়ার আলম বিভাগীয় কর্মকর্তা কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ সাবেক চেয়ারম্যান কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা প্রেসিডেন্ট কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অনুলিখন 

ইব্রাহিম খলিল মামুন কক্সবাজার প্রতিনিধি, সমকাল

আরও পড়ুন

×