- বিশেষ আয়োজন
- কালরাত্রি খন্ডচিত্র
কালরাত্রি খন্ডচিত্র

২৫ মার্চ, ১৯৭১। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ইতিহাসের অন্যতম কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনকে স্থবির করে দিতেই চালানো হয় এই বর্বর আক্রমণ। সেই কালরাত্রির ঘটনাপ্রবাহের নিদর্শন সুসাহিত্যিক শওকত ওসমানের 'কালরাত্রি :খন্ডচিত্র' [প্রকাশ :১৯৮৬; জগচ্চিত্র প্রকাশনী] গ্রন্থটি। দুর্লভ এই গ্রন্থের নির্বাচিত অংশ পত্রস্থ হলো..
পঁচিশে মার্চ, ১৯৭১
সারাদিন শহরময় নানা জল্পনা-কল্পনা। ভবিষ্যৎ গোটা দেশকে কোথায় টেনে নিয়ে যাবে? দু'দিন পূর্বে স্বাধীনতা ঘোষিত। পেছনে সমর্থনের প্রবাহ জলীয় ছোঁয়াচ থেকে জোয়ারে পরিণত। ডাক দিলেই মানুষ হাতের কাছে যা পায় তুলে নিয়ে দৌড়ায়। লাঠি বাঁশের না কাঠের; কাজে লাগবে না লাগবে না- এসব প্রশ্ন সামনে রাখে না। ছাত্রেরা হালে ক'দিন থেকেই ডামি রাইফেল নিয়ে প্যারেড করছে। যাত্রা করো, যাত্রা করো যাত্রীদল। মোকাবিলা করার জন্যে আত্মার গহনে তরঙ্গ-কল্লোল উদ্বেলিত। এমন পরিবেশে কে-ই বা স্থির থাকতে পারে!
সূর্য অস্ত গিয়েছিল সেদিনও যথানিয়মে।
নগরে পথ-দীপ জ্বলে, তবু অন্ধকার থমকে থাকে বহু জায়গায়। সরীসৃপেরা বেরিয়ে আসে রসদ সন্ধানে। আলো ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে তারা খোঁজে অন্ধকার, নিবিড় অন্ধকার। চলাফেরার সুবিধা হয়। শিকার সহজে ধরা পড়ে।
শব্দের ধারাও সন্ধ্যার পর বদলে যায়।
সারাদিন কতো না জায়গা ফুঁড়ে মন্দ্রিত হয়েছে : জয় বাংলা। মাত্র দুটি শব্দে দেশের সন্তানেরা তাদের বহুকালের হারানো ঠিকানা খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু আর স্লোগান কোনো দিক থেকে ভেসে আসে না। গায়কেরা যেন তবলার সুর বাঁধতে ব্যস্ত। তারই ঠুকঠাক শব্দ, কর্মতৎপরতার মূর্ছনা দিকে দিকে ভাসমান।
'ব্যারিকেড গড়ো।'
'খবর পাওয়া গেছে ওরা অ্যাটাক (হামলা) করবে।'
'গড়ো ব্যারিকেড।'
'ইট-পাটকেল, ভাঙা ড্রাম, পুরাতন লোহা-লক্কড়ের গাদা- যা পারো আনো। বয়ে আনো।'
'হাত লাগাও, এসো হাত লাগাও।' সম্মিলিত শ্রম যখন প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়ে, তখন সভ্যতার বুনিয়াদ পত্তন হয়। আর সেই মেহনত যখন মানুষের বিরুদ্ধে খাড়া হয়, তখন সূত্রপাত ঘটে বর্বরতার। বর্বরদের মোকাবিলায় মানুষকে মাঝে মাঝে বর্বতার আশ্রয় নিতে হয়। আহ্, কী নিষ্ঠুর প্রয়োজন! এমন প্রয়োজনেই বদ্ধপরিকর ঢাকা নগরী যেন শেষ সংকেতের অপেক্ষায় ছিল। সেই উন্মাদনার হিসেব-নিকেশ ছিল না। শত্রুর মারণ-ক্ষমতার পরিধি জরিপ করার সময় কোথায়?
যাত্রা করো, যাত্রা করো, যাত্রীদল।
বন্দরের কাল সমাপ্ত।
রাত্রি ন'টার দিকে খবর পাওয়া গেল কুর্মিটোলা থেকে ট্যাঙ্ক বেরিয়ে আসছে। সাঁজোয়া বাহিনী বিভিন্ন জায়গায় পজিশন নিতে ব্যস্ত। শহরে কত রকম গাড়িই তো চলে, রাস্তায় মাঝে মাঝে পার্ক করে। সাঁজোয়া গাড়িগুলোর গতি-প্রকৃতির মধ্যে আলাদা কোনো মাহাত্ম্য ছিল না।
আরো দু'ঘণ্টা পরে।
রাত্রি এগারোটা।
সাঁজোয়া গাড়ি আর স্থবির নয়, নড়াচড়া শুরু হয়েছিল। এই আগুনের আজদাহা সাপ শুধু ধ্বংস করে না, পোড়ায় না। মানুষের দীর্ঘশ্বাস, আর্তনাদের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। বিয়োগান্ত শত শত নাটকের প্রম্পটার- নেপথ্য ভাষক হয়ে এগিয়ে যায় জলাজাঙ্গাল, জনপদের ওপর দিয়ে বিংশ শতাব্দীর এই তৈমুর লং। পা কিন্তু এর খোঁড়া নয়। হঠাৎ আকাশ চকিত হয়ে উঠল। শব্দের তাড়নায় গাছের ডালে বিশ্রামরত পাখিকুল। ভোরের সূচনা করল চিরাচরিত অভ্যাস। কিন্তু সময়ের চেতনা তারা হারিয়ে ফেলেছিল। পাখি ও জীবজন্তু জানত না কালরাত্রি শুরু হয়েছে।
কাঁপতে লাগল গোটা শহর।
যেদিকে তাকাও আগুনের হল্ক্কা। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে দাউদাউ আগুন শুরু হয়েছে মর্টার বর্ষণের ফলে। তার পূর্বে ফ্লোরিসিন বোমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল নগরের আকাশ।
ইউনিভার্সিটি এলাকা কি স্তব্ধ?
না।
এই এলাকা থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের মশাল অনির্বাণ শিখার উৎসরূপে জ্বলে উঠেছিল। পাকিস্তানি শাসকরা তা জানত। অনুন্নত দেশের ছাত্রদের দুর্ভাগ্য বিদ্যা-অর্জন শুধু তাদের দৈনন্দিনতার মধ্যে পড়ে না। দেশের কথাও তাদের ভাবতে হয়। তাই দেশের সমস্যা সম্পর্কে তারা নীরব, নির্বিকার থাকতে অপারগ। ইউনিভার্সিটি এলাকা শাসকদের কাছে ছিল বোলতার চাক। বিশেষ এই চাকে আগুন লাগাও। পোড়াও এই হুলের আড়ত।
হানাদার সৈন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল ফণা বিস্তার মারফত। অগ্নিময় তাদের ছোবল। ত্রাস সঞ্চারে পাকিস্তানি সৈন্যরা ফায়ার করছিল কোনো লক্ষ্যবস্তু ঠিক না রেখে। মর্টারের শব্দ, মেশিনগানের টাক্-টাক্... শল্ শল্... আর্তনাদের মতো মিনিটে মিনিটে প্রলয়ের সূচনারূপে গোটা এলাকায় আতঙ্কের চাঁদোয়া টেনে চলছিল। সলিমুল্লা হল, জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল- এক কথায় অন্য সকল হলের ছাত্র-ছাত্রীরা আরেক সবকের জন্যে তৈরি হচ্ছিল, যা তারা কোনোদিন কল্পনা করেনি। কারিকুলামে এই পাঠের জায়গা থাকে না।
পাকিস্তানি সৈন্যরা আর নেপথ্যে শব্দের উৎস নয়। নানা হাতিয়ারে সজ্জিত তারা হলের ভিতরে ঢুকে পড়ল। সামনে ছাত্র পাও, ট্রিগার টেপো। আর কোনো প্রশ্নের দরকার নেই। আর্তনাদ, গোঙানি, আর্ত চিৎকার- হোক তা মানুষের। তার কোনো দাম দিও না। ইমামের নির্দেশ 'হাম জমিন দেখনে মাংতা, আদমি নেহি। আমি মাটি দেখতে চাই। মানুষ না।'
নিউ মার্কেটের মাংসের স্টলের কর্মচারীরা সকাল-সকাল খেয়ে শুয়ে পড়ে। কারণ আবার খুব ভোরেই উঠতে হয়। বাজার শুরু হয়ে যায় অন্ধকার থাকতে থাকতেই। চিরাচরিত তারা ঘুমে ঢলে পড়েছিল। রাত-দুপুরে গোলাগুলির আওয়াজে অনেকের ঘুম ভাঙলেও আবার করোট ফিরে শুয়েছিল। শহরে রাজনীতির উত্তেজনা বলতে গেলে মার্চ মাসের পয়লা থেকেই শুরু। যদিও গুলিগোলার আওয়াজ নিকটে, স্টলের অধিবাসীরা তার কোনো আমল দেয়নি। তা ছাড়া মেহনতি মানুষের কাছে ঘুমের একটা বিশেষ মূল্য আছে। ওদের স্লিপিং পিল, ঘুমের বড়ি খেতে হয় না। দেহ-যন্ত্র সারাদিন এমন চালু থাকে যে ঘুমের ওত পাতা দেখার মতো। বিছানার মধ্যেই গভীর বিশ্রাম লুকিয়ে থাকে।
নিউ মার্কেটের নিকটেই ইউনিভার্সিটি এলাকা। গোটা শহর আলোড়িত। মাংসের স্টলের কর্মচারীরা তারই মধ্যে ঘুমোয় কী করে? অতি পরিশ্রম যারা করে না তাদের পক্ষে এমন পরিস্থিতি কল্পনা প্রায় অসম্ভব।
তারা ঘুমিয়ে ছিল।
মাংসের স্টলে সাজশয্যা আর কী থাকতে পারে? অনেকে তেলচিটে দাগ-ধরা বালিশের মালিক। অনেকের তা-ও নেই। ইটের ওপর কিছু ছেঁড়া কাঁথার সামান্য টুকরো বিছিয়ে নিলেই চলে যায়। বালিশ ছাড়া, শুধু বাহু-বালিশেও বহুজন নিশ্চিন্ত ঘুমায়। এই আর এক আলাদা জগৎ।
দুপুর রাত্রে মিরপুর রোড ধরে হঠাৎ হঠাৎ মিলিটারি জিপ শাঁ শাঁ শব্দে বেরিয়ে যায়। কখনও এসে নিউ মার্কেটের সামনে থামে। আবার স্টার্টের শব্দ। প্রেতায়িত আবহাওয়া।
তারা নির্বিবাদ ঘুমে অথবা অর্ধচেতন স্বপ্নাচ্ছন্ন জগতের মধ্যে শব্দ শুনছিল মাত্র। আর কিছু না। কী ঘটছে, তার দায়িত্ব জাগ্রত মানুষের জন্যে।
শুয়েছিল তারা সারি সারি। স্টলের পর স্টল শায়িত মানুষের এমন প্রলম্ব মিছিল। অনেকের মনে হয়তো সেই ধারণা ধাক্কা দিয়ে গিয়েছিল যে দীন-দরিদ্রদের কেন-ই বা কেউ অনিষ্ট করবে- যারা রাজনীতি করে, তাদের যা হয় হতে পারে।
হঠাৎ কয়েকটা জিপ এসে থামল ঢাকা কলেজের সামনে। নিউ মার্কেট প্রায় ঢাকা কলেজের সম্প্রসারণ। এক অধ্যাপক রসিকতা করে বলতেন, 'কোনটা কার সম্প্রসারণ ধরা কঠিন। এক দিকে ইলেম বিক্রি হয়, অন্যদিকে মাল। আসল উৎপত্তি কোন দিকে- সেটাই আবিস্কার বা গবেষণার বিষয়।'
জিপ থেকে একদল জওয়ান নামল, হাতে স্টেনগান। টর্চের আলো ফেলে তারা একবার দেখে নিল। তারপর ব্রাশ ফায়ার। ট্ট-ট্ট-ট্ট-শ্ শ্ শ্ শ্...।
আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দ হেঁকে গেল, 'হে ঢাকা শহরের খরিদ্দারগণ, এসো বাজারে এসো, কাল সকালে। নতুন মাল আমদানি হয়েছে। এমন সুযোগ আর কোনো দেশে কোনো কালে পাওয়া যাবে না। সুযোগ হারিও না। সারাজীবন আফসোস করে মরবে। অপূর্ব এ মালের স্বাদ। পৃথিবীর আর কোথাও তৈরি হয় না।
মেড ইন পাকিস্তান। শুধু পাকিস্তানে নির্মিত হয়, আর কোথাও না। পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র। এসো, কাল সকালে এসো। বড় থলি নিয়ে এসো। এখানে বিক্রি হবে খুব ভোর থেকেই মানুষের গোস্তের সঙ্গে মেশানো গরুর গোস্ত, খাসির গোস্ত। অপূর্ব তার স্বাদ। অপূর্ব এই পাঞ্চ বা মিশ্রণ। আদম-গোস্ত-গাওয়া-গোস্ত প্রসেস্ড ইন ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান...।
অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার দরজায় বুটের পদাঘাত। দরজা খুলে দিয়েছিলেন তিনি। সন্ত্রস্ত, শঙ্কিত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু তিনি অধ্যাপক, আত্মসম্মান সম্পর্কে সদা সচেতন। এই জন্যে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে বেশি দিন থাকতে পারেননি।
...পাকিস্তানে তিনি দ্বিতীয় না তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক- এ নিয়েও তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তিনি তেমনই হিন্দু ছিলেন, ছিলেন কবি নজরুল যেমন মা কালীর বন্দনা বা জগদ্ধাত্রী পূজার গান লিখেও মুসলমান- যদিও হেন কর্ম শরীয়তে 'বেদাৎ' এবং শক্ত গুনাহ। নৃতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক আলোকে ঠাকুরতা হিন্দু দেবদেবীর শ্রাদ্ধ করতেন। সুতরাং তাঁর পক্ষে হিন্দুত্ব কোনো পরাকাষ্ঠার পতাকা নয়। সৈনিকদের সঙ্গে কথাবার্তার সময় তিনি নামের পূর্বে জন, লরেন্স, রবার্ট যোগ করে দেশি খ্রিষ্টানরূপে আত্মপরিচয় দিতে পারতেন। হয়তো ফন্দির পরিণামে তার প্রাণ বেঁচে যেত। কিন্তু মিথ্যের বনিয়াদে প্রতিষ্ঠিত জুলুমের সম্মুখে গুহঠাকুরতা ভুলে যাননি তিনি জ্ঞানের পূজারী, অধ্যাপনার পেশায় প্রতিষ্ঠিত। সেই মুহূর্তে নিজের নাম এবং পেশার সার্থকতা রক্ষায় তিনি সত্যি জ্যোতির্ময় হয়ে উঠেছিলেন। আত্মপরিচয়ের ওপর তিনি কোনো আবরণ দিলেন না, কোনো আচ্ছাদন দিলেন না। তিনি পাকিস্তানের নাগরিক। অবিশ্যি। এবং ধর্মে হিন্দু। অবিশ্যি নিরপরাধ জবাব। তবে নির্মম। তাই প্রতি-জবাব দিয়েছিল হানাদার জওয়ান বন্দুকের ভাষায়। দোলা-বাসন্তী দেবীর আর্তনাদে বেষ্টিত জ্যোতির্ময় লুটিয়ে পড়লেন।
অধ্যাপনা পেশার গায়ে বর্তমানে শতকুষ্ঠ রোগের দাগ। জ্যোতির্ময়ের ঝলক। অজ্ঞানতার তিমিরান্ধ এই দেশে বহুকাল পথদর্শী তীব্র প্রভা, দৃষ্টান্তরূপে বিরাজ করবে।
গুহঠাকুরতা জানতেন না, মিথ্যে বনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত সত্য স্রেফ মূল্যহীন ভস্ম মাত্র।
তাই কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন ডক্টর গোবিন্দ দেব। দার্শনিক ক্ষেত্রে তিনি আইডিয়ালিস্ট বা ভাববাদী। শোষক-শাসকদের নিকট এমন চিন্তার সমর্থন সর্বদা অগ্রগণ্য। গোবিন্দ দেবকে তাদের হত্যার প্রয়োজন ছিল না।
কিন্তু বছরের পর বছর মধ্যযুগীয় বর্ণবিদ্বেষের লাভায় দেশবাসীর আত্মা ভিজিয়ে রাখার পরিণাম এমনই ঘটে। সংস্কৃত নামধারী। অতএব পাকিস্তানের শত্রু। ডক্টর গোবিন্দ দেবের আর একটি অপরাধ ছিল। তিনি দয়ালু এবং বর্ণবিদ্বেষের ঊর্ধ্বে বিচরণ করেন। এক মুসলমান মেয়ে তার পালিতা কন্যা। নাম রোকেয়া। তিনি মোহাম্মদ আলি নামে এক ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে দেন। জামাই ব্যাংকে চাকরি করতেন। সংস্কৃত নামধারী, অতএব ধর্মবিরোধী। ডক্টর দেব ও তার জামাইকে হানাদাররা রেহাই দিতে পারে না। হিন্দু মুসলমান আত্মীয়তার সূত্রে নয় শুধু, আবহমান কালের সূত্রে বাঁধা উভয়ের রক্ত সেদিন মিশে গিয়েছিল একই মেঝের সমতলে। পালক শ্বশুর ও জামাতার সুবাদ তো সেখানে তুচ্ছ কথা।
হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যরা মানবিক গুণসম্পন্ন, মাভৈঃ-স্বর অধ্যাপকদের খুঁজেছিল সেদিন ভার্সিটি পাড়ায়। তাই পরিসংখ্যানবিদ অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকে তাদের বড় প্রয়োজন ছিল। পরিসংখ্যান স্ট্যাটিসটিকসের সঙ্গে রাজনীতি বা সত্যের কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
...অধ্যাপক মনিরুজ্জামান সেই রাত্রে জায়নামাজের ওপর বসে কোরান তেলওয়াতে মন দিলেন। পরিবারের অন্যান্য সকলে ত্রস্ত, শঙ্কিত অধীর উৎকণ্ঠার ভেতর মুহূর্ত গণনা করছিল। পবিত্র কোরান গ্রন্থ সম্মুখে। আল্লাহর বাণীর ভেতর অধ্যাপক জামান নিমগ্ন।
... রাত তিনটে। জামান সাহেবের বাড়িতে পাকিস্তানি হানাদাররা হামলা শুরু করল। প্রথমেই দরজার ওপর দমাদ্দম লাথি। তারপর আরও আঘাত। দরজা ভেঙে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঘরে ঢুকল।
অধ্যাপক মনিরুজ্জামান অবিচল বসে আছেন। সামনে কোরান শরিফ। তেলাওয়াত তিনি বন্ধ করেননি।
জায়নামাজের পবিত্রতা রক্ষা করবে, ইসলাম রক্ষার জন্যে যারা খুনি জল্লাদ সেজেছে- তারা শোষণের চাকা অব্যাহত রাখতে যাদের মোতায়েন করা হয়েছে, তারা আর যা-ই হোক মুসলমান নয়, আর যারা ওদের মোতায়েন করেছে, তারাও ধার্মিক মুসলমান নয়, যদিও ইসলামের নামাবলি তারা সর্বাঙ্গে জড়িয়ে রাখে এবং মুখে শাস্ত্রবাণী উচ্চারণ করে সভামঞ্চে প্রতিদিন।
মনিরুজ্জামান সাহেবকে ওরা, জায়নামাজ বুটের তলায় মাড়িয়ে, টেনেহেঁচড়ে বাইরে নিয়ে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে গুলি করল।
...কসাইয়ের দল হত্যা করল জামান সাহেবের চৌদ্দ বছরের ভাগ্নে মঞ্জুকে। আকরামুজ্জামান, জামান সাহেবের নিজের সন্তান, বয়স মাত্র ষোলো। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে। পাকিস্তানি সৈন্যরা দুই কিশোরকে গুলির চোটে ফেলে দিল নিঃশেষিত প্রাণ। এভাবে তাদের অনুসরণ করে পরলোকে চলে গেলেন জামান সাহেবের আপন ভাই শামসুজ্জামান। তবে পাকিস্তানি সৈন্যরা একদম পুরোপুরি শতে-শত জন্তু, তা বলা যায়। শতকরা দশমিক এক আধ মনুষ্য চেতনা সেই রাতে ওদের মধ্যে অবশিষ্ট ছিল। নচেৎ জামান সাহেবের এক মেয়ে ও দশ বছরের ছেলে মাসুদ কীভাবে রেহাই পেয়ে গেল এই নারকীয় জীবনের যন্ত্রণার মুখখামুখি। পূর্ব পাকিস্তানে ইসলাম বিলুপ্ত হতে চলেছে। তাই তারা পাকিস্তানবিরোধী। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের এই অভিযোগের সুরাহা করার জন্যেই সৈন্য লেলিয়ে দেওয়া হয় সকল পূর্ব পাকিস্তানিকে ইসলামী সবক-দানে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় হানাদাররা ঢুকেছিল উচ্চশিক্ষিত অধ্যাপকদের প্রফেসার-রূপে। বন্দুকের আওয়াজ সেই লেকচারের নারকীয় প্রতিধ্বনি।
প্রাণের বলি বন্ধ ছিল না। বাংলাদেশের মাটির প্রতি ভালোবাসা ছিল, তাই কি মৃত্তিকা-বিজ্ঞানের প্রফেসার ডক্টর ফজলুর রহমান নির্মমতার অমন শিকার হলেন? প্রায় একই রেখায় আঁকা যায় হত্যার নকশা। অকস্মাৎ দস্যুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে বেদেরেগে গুলি চালানো। সেখানে টার্গেট বা লক্ষ্যবস্তু দেখার প্রয়োজন নেই। অথবা, কোথাও কোথাও দু'একটি প্রশ্ন। অপরাধীকে সাফাই দেওয়ার সুযোগ কিন্তু তার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। হত্যাকারীর খেয়ালই সর্বেসর্বা। শিকার যেখানে রেহাই পেয়েছে তা-ও ওই খেয়ালের জের। ঢাকা নিউ মার্কেট সেদিন সন্ধ্যা থেকেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সমাজের অস্বাভাবিক হাওয়া বোধ হয় জীবজন্তুর গায়েও লাগে। কুকুরের লম্বা একটানা ডাকে তখন শব্দ আলাদা হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ মনে করে, কুকুর কাঁদছে। হয়তো কান্না নয়, তবে অস্বাভাবিকতা সেখানে স্পষ্ট। বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের নিকট পূর্বাশঙ্কা নানাভাবে ছায়া ফেলে। অশরীরী একটা প্রভাব তখন পণ্ডিত হোক মূর্খ হোক সকলেই অনুভব করে। এমন কি দামাল তিন-চার বছরের শিশু পর্যন্ত চুপ করে যায়।
মন্তব্য করুন