- বিশেষ আয়োজন
- যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল আগেই
যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল আগেই

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানালেও আমাদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল আরও আগে থেকেই। সবার মনের ভেতরে স্বাধীনতা এবং নতুন একটি মানচিত্রের স্বপ্ন লালন শুরু করি '৬৯-এর পর থেকেই। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ার দুই দিন পরেই খুলনায় প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। শুরুর ওই কয়েক দিন খুলনার বিভিন্ন স্থানে একাধিক প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
১৯৬৪ সালে সেন্ট যোসেফ উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে ছাত্র রাজনীতিতে আমার হাতেখড়ি হয়। এসএসসি পাস করে দৌলতপুর বিএল কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই। ততদিনে ছাত্রলীগের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতিটি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে থাকি। ১৯৬৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র আমরা। ওই বছরই হলটি চালু হয়। হলে থেকেই নিয়মিত মিটিং-মিছিলে অংশ নিতাম। আমি খুব ভালো পোস্টার লিখতাম। এক রাতে কয়েকশ' পোস্টার লিখে ফেলতাম। তখন আমাদের নেতা ছিলেন মনিরুল হক চৌধুরী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ইংরেজি বিভাগের প্রধান ছিলেন ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন। ওই সময় অক্সফোর্ড থেকে প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন ছাত্রকে ওরা ভর্তি নিত। ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের কাছে প্রস্তাব আসত। তিনিই ঠিক করে দিতেন কে কে যাবে। ওইবার অক্সফোর্ড যাওয়ার জন্য তিনি আমাকে নির্বাচন করেন।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন দিন দিন খারাপ হচ্ছে। খুলনায় বিএল কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা চলছে। খুলনার কলেজগুলোতে তখন ছাত্র ইউনিয়নের দাপট। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছেন যেভাবেই হোক দেশের কলেজ সংসদগুলোতে ছাত্রলীগকে বিজয়ী হতে হবে। একদিন মনিরুল হক ভাই আমাকে ডেকে বলেন, 'তোমার মনে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হবে না। তোমাকে খুলনা চলে যেতে হবে, সেখানে তোমাকে ভিপি পদে নির্বাচন করতে হবে।' বললাম, 'স্যারের সঙ্গে কথা বলে জানাব।'
স্যারকে বলার পর তিনি বললেন, 'ডোন্ট গো, ডোন্ট ডেস্ট্র্রয় ইউর ক্যারিয়ার।' কথাটি এখনও আমার কানে বাজে। এরপর মনিরুল হক চৌধুরীকে বললাম খুলনায় যাব না। কয়েক দিন পর একদিন বিকেলে তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। সেখানে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন। আমাকে সামনে ঠেলে দিয়ে মনিরুল হক বললেন, 'ও নির্বাচন করতে যাবে না। নির্বাচনে গেলে ওর ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।' বঙ্গবন্ধু আমার দিকে একনজর তাকিয়ে বললেন, 'বাবর আলী, দেশই যদি না থাকে তাহলে ক্যারিয়ার দিয়ে কী হবে ?'
এরপর নানা চিন্তা করে লঞ্চে উঠে খুলনা চলে গেলাম। এরপর বিএল কলেজে ইংরেজিতে আবার ভর্তি হলাম। সভা-সমাবেশ ব্যাপকভাবে চালু হলো। ১৯৬৮-৬৯ সেশনে বিএল কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ৩২টি পদের সবক'টিতে ছাত্রলীগ বিজয়ী হলো। আমি ভিপি এবং ফকির সিরাজুল হক জিএস নির্বাচিত হলেন। এরপর নানা ইতিহাস। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, গণঅভ্যুত্থান, '৭০-এর নির্বাচনের পর একাত্তরের উত্তাল মার্চে এসে পড়ল দেশ।
২ মার্চ হরতাল, ৩ মার্চ হাদিস পার্ক থেকে সকাল ১০টায় বিক্ষোভ মিছিল করা হলো। ওই মিছিলে হানাদারদের গুলিতে ৭ জন শহীদ হন। এরপর আন্দোলন আরও জোরদার হলো। ৭ মার্চ খুলনায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের খুলনা জেলা কমিটি গঠন করা হলো। ১২ মার্চ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে হাদিস পার্কে প্রথম জনসভা করি। সভাশেষে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। সারাদেশের মতো আমরাও ২৩ মার্চ খুলনায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় আক্রমণের সময় আমি রূপসা থাকতাম। ২৬ মার্চে রূপসায় আমার মেসে অভিযান চালায় পাকিস্তান আর্মি। অল্পের জন্য আমাকে ওরা ধরতে পারেনি। সেখান থেকে পালিয়ে পাইকগাছা চলে যাই। দুই দিন থেকে আবার ফিরে এসে বৈকালীর প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিই। ওই সময় ইপিআর সদস্যদের কাছ থেকে রাইফেল চালানো শিখেছি। কিন্তু যুদ্ধে অংশ নেওয়ার মতো সক্ষমতা হয়নি। এই অবস্থায় ভোমরা যুদ্ধে অংশ নিই। ৭২ ঘণ্টা টানা যুদ্ধ চলে। ইপিআর সদস্যরা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন। ভোমরা ক্যাম্প থেকে ভারতের ভেতরে গিয়ে ট্রেনিং নিলাম। পরে কয়েক দফা কলকাতা, দেরাদুনে ট্রেনিং নিয়েছি। এরপর দক্ষিণাঞ্চলসহ সারাদেশে বিভিন্ন সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদাররা আমার গ্রামের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল। অসংখ্যবার আমাদের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু কখনও পরিবার ভয় পায়নি। আমাকে বাধা দেয়নি। আমার বাবা-মায়ের মতো এমন অসংখ্য বাবা-মায়ের আত্মত্যাগের কারণে ৯ মাসের মধ্যে বিশ্বের বুকে নতুন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ।
লেখক, মুক্তিযোদ্ধা
অনুলিখন :হাসান হিমালয়, স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা ব্যুরো
১৯৬৪ সালে সেন্ট যোসেফ উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে ছাত্র রাজনীতিতে আমার হাতেখড়ি হয়। এসএসসি পাস করে দৌলতপুর বিএল কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই। ততদিনে ছাত্রলীগের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতিটি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে থাকি। ১৯৬৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র আমরা। ওই বছরই হলটি চালু হয়। হলে থেকেই নিয়মিত মিটিং-মিছিলে অংশ নিতাম। আমি খুব ভালো পোস্টার লিখতাম। এক রাতে কয়েকশ' পোস্টার লিখে ফেলতাম। তখন আমাদের নেতা ছিলেন মনিরুল হক চৌধুরী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ইংরেজি বিভাগের প্রধান ছিলেন ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন। ওই সময় অক্সফোর্ড থেকে প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন ছাত্রকে ওরা ভর্তি নিত। ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের কাছে প্রস্তাব আসত। তিনিই ঠিক করে দিতেন কে কে যাবে। ওইবার অক্সফোর্ড যাওয়ার জন্য তিনি আমাকে নির্বাচন করেন।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন দিন দিন খারাপ হচ্ছে। খুলনায় বিএল কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা চলছে। খুলনার কলেজগুলোতে তখন ছাত্র ইউনিয়নের দাপট। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছেন যেভাবেই হোক দেশের কলেজ সংসদগুলোতে ছাত্রলীগকে বিজয়ী হতে হবে। একদিন মনিরুল হক ভাই আমাকে ডেকে বলেন, 'তোমার মনে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হবে না। তোমাকে খুলনা চলে যেতে হবে, সেখানে তোমাকে ভিপি পদে নির্বাচন করতে হবে।' বললাম, 'স্যারের সঙ্গে কথা বলে জানাব।'
স্যারকে বলার পর তিনি বললেন, 'ডোন্ট গো, ডোন্ট ডেস্ট্র্রয় ইউর ক্যারিয়ার।' কথাটি এখনও আমার কানে বাজে। এরপর মনিরুল হক চৌধুরীকে বললাম খুলনায় যাব না। কয়েক দিন পর একদিন বিকেলে তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। সেখানে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন। আমাকে সামনে ঠেলে দিয়ে মনিরুল হক বললেন, 'ও নির্বাচন করতে যাবে না। নির্বাচনে গেলে ওর ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।' বঙ্গবন্ধু আমার দিকে একনজর তাকিয়ে বললেন, 'বাবর আলী, দেশই যদি না থাকে তাহলে ক্যারিয়ার দিয়ে কী হবে ?'
এরপর নানা চিন্তা করে লঞ্চে উঠে খুলনা চলে গেলাম। এরপর বিএল কলেজে ইংরেজিতে আবার ভর্তি হলাম। সভা-সমাবেশ ব্যাপকভাবে চালু হলো। ১৯৬৮-৬৯ সেশনে বিএল কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ৩২টি পদের সবক'টিতে ছাত্রলীগ বিজয়ী হলো। আমি ভিপি এবং ফকির সিরাজুল হক জিএস নির্বাচিত হলেন। এরপর নানা ইতিহাস। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, গণঅভ্যুত্থান, '৭০-এর নির্বাচনের পর একাত্তরের উত্তাল মার্চে এসে পড়ল দেশ।
২ মার্চ হরতাল, ৩ মার্চ হাদিস পার্ক থেকে সকাল ১০টায় বিক্ষোভ মিছিল করা হলো। ওই মিছিলে হানাদারদের গুলিতে ৭ জন শহীদ হন। এরপর আন্দোলন আরও জোরদার হলো। ৭ মার্চ খুলনায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের খুলনা জেলা কমিটি গঠন করা হলো। ১২ মার্চ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে হাদিস পার্কে প্রথম জনসভা করি। সভাশেষে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। সারাদেশের মতো আমরাও ২৩ মার্চ খুলনায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় আক্রমণের সময় আমি রূপসা থাকতাম। ২৬ মার্চে রূপসায় আমার মেসে অভিযান চালায় পাকিস্তান আর্মি। অল্পের জন্য আমাকে ওরা ধরতে পারেনি। সেখান থেকে পালিয়ে পাইকগাছা চলে যাই। দুই দিন থেকে আবার ফিরে এসে বৈকালীর প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিই। ওই সময় ইপিআর সদস্যদের কাছ থেকে রাইফেল চালানো শিখেছি। কিন্তু যুদ্ধে অংশ নেওয়ার মতো সক্ষমতা হয়নি। এই অবস্থায় ভোমরা যুদ্ধে অংশ নিই। ৭২ ঘণ্টা টানা যুদ্ধ চলে। ইপিআর সদস্যরা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন। ভোমরা ক্যাম্প থেকে ভারতের ভেতরে গিয়ে ট্রেনিং নিলাম। পরে কয়েক দফা কলকাতা, দেরাদুনে ট্রেনিং নিয়েছি। এরপর দক্ষিণাঞ্চলসহ সারাদেশে বিভিন্ন সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদাররা আমার গ্রামের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল। অসংখ্যবার আমাদের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু কখনও পরিবার ভয় পায়নি। আমাকে বাধা দেয়নি। আমার বাবা-মায়ের মতো এমন অসংখ্য বাবা-মায়ের আত্মত্যাগের কারণে ৯ মাসের মধ্যে বিশ্বের বুকে নতুন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ।
লেখক, মুক্তিযোদ্ধা
অনুলিখন :হাসান হিমালয়, স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা ব্যুরো
মন্তব্য করুন