- বিশেষ আয়োজন
- দেশের জন্য জীবন বাজি
দেশের জন্য জীবন বাজি

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগে আমি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি নির্বাচিত হই। সাংগঠনিকভাবে আমাকে রাজশাহী বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর সংগঠনের নির্দেশে নিজ জেলা বগুড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করি।
বগুড়ায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় 'স্বেচ্ছাসেবক ব্রিগেড' গঠন করা হয়। বগুড়া জিলা স্কুলে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পও চালু করা হয়। সেখানে অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা সদস্যের তত্ত্বাবধানে ব্রিগেডের সদস্যদের কাঠের রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এরই মাঝে ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর আমরা ছাত্র ইউনিয়নের স্থানীয় নেতারা শহরের জিরো পয়েন্টে সংগঠনের জেলা কার্যালয়ে বসে আলোচনা করছিলাম। তখন খবর আসে, রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা বগুড়ার দিকে আসছে। পরের দিন জানতে পারি ঢাকায় হায়েনাদের বর্বর হত্যাযজ্ঞের কথাও।
সবাই মিলে সেই হায়েনাদের প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নিই। আমাদের স্বেচ্ছাসেবক ব্রিগেডের কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লাইসেন্স করা একনলা বন্দুক সংগ্রহ করতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবহর ঠেকানোর জন্য বগুড়া শহরের প্রবেশপথ রংপুর রোডে ব্যারিকেড সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন মোড়ে গাছের ডাল ও বাঁশ কেটে ফেলা হয়। এমনকি ভারী যান যেন মূল শহরে ঢুকতে না পারে, সে জন্য রেলস্টেশন থেকে মালবাহী ট্রেনের কয়েকটি বগি ঠেলে রেলগেট বরাবর রাখা হয়। রেলগেট থেকে উত্তরে কালিতলাহাট পর্যন্ত বিভিন্ন মোড়ে আমাদের যোদ্ধারা সশস্ত্র পজিশন নেয়। রংপুর থেকে পাকিস্তান সেনাদের গাড়ির বহর ২৬ মার্চ সকালে শহরের প্রবেশের মুখে একে একে কালীতলা, দত্তবাড়ি, বড়গোলা ও ঝাউতলা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। সেই লড়াইয়ে টিকতে না পেরে তারা ওই দিন দুপুরের পর পিছু হটে এবং আশ্রয় নেয় শহরের বৃন্দাবনপাড়া এলাকায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের রেস্ট হাউসে। ওই দিন বিকেলে সেই আস্তানা লক্ষ্য করে চারদিক থেকে আক্রমণ শুরু করা হলে পাকিস্তানি সেনারা রংপুর ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যায়। প্রথম সম্মুখযুদ্ধে বিজয় লাভের পর বগুড়া শহরের তিনটি স্কুল- করনেশন ইনস্টিটিউশন, সেন্ট্রাল হাই স্কুল ও মালতিনগর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। করনেশন স্কুল ক্যাম্পের প্রধান ছিলেন রেজাউর রহমান ডিঙ্গু। বগুড়াকে হানাদারমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে আমাদের রণকৌশল কী হবে তা নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম। পাশাপাশি অস্ত্রের প্রশিক্ষণও চলত। একদিন সেখানেই প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কেডস্ এবং ট্রাকস্যুটের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। সেগুলো ভারত থেকে সংগ্রহের জন্য আমার ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়।
আমি ও রেজাউর রহমান ১৩ এপ্রিল বগুড়া থেকে জয়পুরহাট হয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা হই। ওই দিন জয়পুরহাটে অবস্থান করার পর ১৪ এপ্রিল জয়পুরহাটের পাঁচবিবি হয়ে ভারতে প্রবেশ করি। সেখানে বগুড়া জেলার তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সুবোধ লাহিড়ীর বাড়িতে যাই। আমাদের তখন হিলি সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানকার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা যতীন মজুমদারের বাড়িতে আমাদের থাকতে দেওয়া হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কেডস্ এবং ট্রাকস্যুট কেনার পর সেগুলো নিয়ে আমরা বগুড়ায় ফেরার পরিকল্পনা করছি। তখন কালান্তর পত্রিকার সাংবাদিক প্রদীপ বাবু আমাকে বলেন, 'তুই থাক, আমি আর ডিঙ্গু বগুড়ায় যাব।' তারা দু'জন একটি জিপ নিয়ে বগুড়ার উদ্দেশে রওনা দেন। কিন্তু পরে আর আমার বগুড়ায় ফেরা হয়নি। কারণ ততদিনে পাকিস্তানি সেনারা বগুড়া দখল করে নেয়।
হিলিতে থাকতে খবর পাই দিনাজপুরেরও পতন হয়েছে। সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সদস্যরাও হিলি সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ছে। যতীন বাবুর বাড়িতে আমাদের দল ক্রমশ ভারী হচ্ছে। মে মাসের প্রথম দিকে একদিন ভোরে হঠাৎ প্রচণ্ড গুলির শব্দ শুনতে পাই। আমরা সতর্ক হয়ে যাই এবং সবাই মেঝেতে শুয়ে পড়ি। সহযোদ্ধাদের একজন জানাল, পাকিস্তানি সেনারা ওপার থেকে গুলি করছে। যেহেতু হিলি সীমান্ত দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও ইপিআরের সদস্যরা ভারতে ঢুকছে- তাদের টার্গেট করে গুলি ছুড়ছে পাকিস্তানিরা। দূর থেকে দেখি প্রচণ্ড গুলির মুখে ইপিআর সদস্যদের অনেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ অস্ত্র ফেলে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
পাকিস্তানি সেনারা প্রায় আধাঘণ্টা গুলি ছোড়া বন্ধ করে। জীবন বাজি রেখে এর পর আমরা আমাদের কাছে থাকা রাইফেলগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। ইপিআর সদস্যদের ফেলে দেওয়া রাইফেলগুলো নিয়ে আমরা পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি শুরু করি। সীমান্তের গ্রামগুলো- যেখানে পাকিস্তানি সেনাদের দেখা যায়, সেখানেই আমরা গুলি চালাই। বুঝতে পারি, পাল্টা প্রতিরোধের মুখে তারা সীমান্ত ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তারপর থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন হিলি সীমান্তে আর কোনোদিন পাকিস্তানি সেনাদের দেখা যায়নি।
হিলি সীমান্তে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে ওই সম্মুখযুদ্ধ শেষে আমাদের ভারী অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এ জন্য প্রথমে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় যতীন বাবুর খামারবাড়ি তিলোড় এলাকায়। সেখানে বগুড়া থেকে আসা ছাত্র ইউনিয়ন ও শ্রমিক নেতাদের অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। দেখা হয় ব্রিটিশবিরোধী নেতা আন্দামানফেরত ডা. আব্দুল কাদের চৌধুরী, সিনিয়র নেতা বগুড়ার ধুনটের আব্দুল লতিফ, মোখলেছুর রহমান, বন্ধু টিএম মুসা পেস্তা, ফিরোজ এবং রেডিওর সঙ্গে। পরে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (সিপিআই) বালুরঘাটের নেতা তপন বাবু আমাদেরকে তাদের পার্টি অফিসে নিয়ে যান। সেখানে দেখা হয় প্রখ্যাত আরেক নেত্রী ইলা মিত্রের স্বামী রমেন মিত্রের সঙ্গে। তাকে পাঠিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। উদ্দেশ্য ছিল ডা. আব্দুল কাদের চৌধুরীকে নিয়ে যাওয়া।
বালুরঘাটের পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটির কাছে একটি প্রাইমারি স্কুলে আমাদের থাকতে দেওয়া হলো। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটিকে 'ওয়েটিং ক্যাম্প' বলা হতো। ওই ক্যাম্পে প্রশিক্ষক হিসেবে বগুড়ার অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য সোহরাব ভাইকে পাই। সেখানে ১৫ দিনের শারীরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর আমাকে ক্যাম্পের খরচ চালাতে অর্থ সংগ্রহের জন্য কলকাতা পাঠানো হলো। রাম বাবু নামে বগুড়ার দত্তবাড়ি এলাকার এক ব্যক্তির সঙ্গে আমি কলকাতার ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতাম।
পরবর্তী সময়ে আমাদেরকে অন্য ক্যাম্পে নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অস্ত্রের ট্রেনিং দেওয়া হয়। দুই ধরনের ট্রেনিং ছিল- গেরিলা ট্রেনিং, যা চার মাসের এবং অপরটি হলো এক মাসের শর্ট ট্রেনিং। আমি এক মাসের শর্ট ট্রেনিং নিয়েছিলাম। রাইফেল এবং স্টেনগান চালানো শেখানো হয় আমাকে।
আমাকে ৭ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে আমাদেরকে দেশে পাঠানোর জন্য সীমান্তের কাছে রাখা হয়। আমরা সবাই দেশে ঢোকার অপেক্ষায় ছিলাম। আমাদের মতোই ১৪ জনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অপর একটি গ্রুপ কুমিলল্গা সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢুকে পড়ে। তবে তারা কেউ আর প্রাণে বাঁচেনি। তখন আমাদেরকে 'যতটা সম্ভব ক্যাজুয়ালিটি এড়ানো'- এই কৌশল অবলম্বন করতে বলা হয়। এ কারণে সব ধরনের প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধ চলা অবস্থায় আমাদের আর দেশে ফেরা হয়নি। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হওয়ার পর আমরা দেশে ফেরার সুযোগ পাই।
লেখক, মুক্তিযোদ্ধা
অনুলিখন :: মোহন আখন্দ,ব্যুরোপ্রধান, বগুড়া
বগুড়ায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় 'স্বেচ্ছাসেবক ব্রিগেড' গঠন করা হয়। বগুড়া জিলা স্কুলে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পও চালু করা হয়। সেখানে অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা সদস্যের তত্ত্বাবধানে ব্রিগেডের সদস্যদের কাঠের রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এরই মাঝে ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর আমরা ছাত্র ইউনিয়নের স্থানীয় নেতারা শহরের জিরো পয়েন্টে সংগঠনের জেলা কার্যালয়ে বসে আলোচনা করছিলাম। তখন খবর আসে, রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা বগুড়ার দিকে আসছে। পরের দিন জানতে পারি ঢাকায় হায়েনাদের বর্বর হত্যাযজ্ঞের কথাও।
সবাই মিলে সেই হায়েনাদের প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নিই। আমাদের স্বেচ্ছাসেবক ব্রিগেডের কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লাইসেন্স করা একনলা বন্দুক সংগ্রহ করতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবহর ঠেকানোর জন্য বগুড়া শহরের প্রবেশপথ রংপুর রোডে ব্যারিকেড সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন মোড়ে গাছের ডাল ও বাঁশ কেটে ফেলা হয়। এমনকি ভারী যান যেন মূল শহরে ঢুকতে না পারে, সে জন্য রেলস্টেশন থেকে মালবাহী ট্রেনের কয়েকটি বগি ঠেলে রেলগেট বরাবর রাখা হয়। রেলগেট থেকে উত্তরে কালিতলাহাট পর্যন্ত বিভিন্ন মোড়ে আমাদের যোদ্ধারা সশস্ত্র পজিশন নেয়। রংপুর থেকে পাকিস্তান সেনাদের গাড়ির বহর ২৬ মার্চ সকালে শহরের প্রবেশের মুখে একে একে কালীতলা, দত্তবাড়ি, বড়গোলা ও ঝাউতলা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। সেই লড়াইয়ে টিকতে না পেরে তারা ওই দিন দুপুরের পর পিছু হটে এবং আশ্রয় নেয় শহরের বৃন্দাবনপাড়া এলাকায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের রেস্ট হাউসে। ওই দিন বিকেলে সেই আস্তানা লক্ষ্য করে চারদিক থেকে আক্রমণ শুরু করা হলে পাকিস্তানি সেনারা রংপুর ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যায়। প্রথম সম্মুখযুদ্ধে বিজয় লাভের পর বগুড়া শহরের তিনটি স্কুল- করনেশন ইনস্টিটিউশন, সেন্ট্রাল হাই স্কুল ও মালতিনগর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। করনেশন স্কুল ক্যাম্পের প্রধান ছিলেন রেজাউর রহমান ডিঙ্গু। বগুড়াকে হানাদারমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে আমাদের রণকৌশল কী হবে তা নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম। পাশাপাশি অস্ত্রের প্রশিক্ষণও চলত। একদিন সেখানেই প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কেডস্ এবং ট্রাকস্যুটের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। সেগুলো ভারত থেকে সংগ্রহের জন্য আমার ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়।
আমি ও রেজাউর রহমান ১৩ এপ্রিল বগুড়া থেকে জয়পুরহাট হয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা হই। ওই দিন জয়পুরহাটে অবস্থান করার পর ১৪ এপ্রিল জয়পুরহাটের পাঁচবিবি হয়ে ভারতে প্রবেশ করি। সেখানে বগুড়া জেলার তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সুবোধ লাহিড়ীর বাড়িতে যাই। আমাদের তখন হিলি সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানকার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা যতীন মজুমদারের বাড়িতে আমাদের থাকতে দেওয়া হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কেডস্ এবং ট্রাকস্যুট কেনার পর সেগুলো নিয়ে আমরা বগুড়ায় ফেরার পরিকল্পনা করছি। তখন কালান্তর পত্রিকার সাংবাদিক প্রদীপ বাবু আমাকে বলেন, 'তুই থাক, আমি আর ডিঙ্গু বগুড়ায় যাব।' তারা দু'জন একটি জিপ নিয়ে বগুড়ার উদ্দেশে রওনা দেন। কিন্তু পরে আর আমার বগুড়ায় ফেরা হয়নি। কারণ ততদিনে পাকিস্তানি সেনারা বগুড়া দখল করে নেয়।
হিলিতে থাকতে খবর পাই দিনাজপুরেরও পতন হয়েছে। সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সদস্যরাও হিলি সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ছে। যতীন বাবুর বাড়িতে আমাদের দল ক্রমশ ভারী হচ্ছে। মে মাসের প্রথম দিকে একদিন ভোরে হঠাৎ প্রচণ্ড গুলির শব্দ শুনতে পাই। আমরা সতর্ক হয়ে যাই এবং সবাই মেঝেতে শুয়ে পড়ি। সহযোদ্ধাদের একজন জানাল, পাকিস্তানি সেনারা ওপার থেকে গুলি করছে। যেহেতু হিলি সীমান্ত দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও ইপিআরের সদস্যরা ভারতে ঢুকছে- তাদের টার্গেট করে গুলি ছুড়ছে পাকিস্তানিরা। দূর থেকে দেখি প্রচণ্ড গুলির মুখে ইপিআর সদস্যদের অনেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ অস্ত্র ফেলে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
পাকিস্তানি সেনারা প্রায় আধাঘণ্টা গুলি ছোড়া বন্ধ করে। জীবন বাজি রেখে এর পর আমরা আমাদের কাছে থাকা রাইফেলগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। ইপিআর সদস্যদের ফেলে দেওয়া রাইফেলগুলো নিয়ে আমরা পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি শুরু করি। সীমান্তের গ্রামগুলো- যেখানে পাকিস্তানি সেনাদের দেখা যায়, সেখানেই আমরা গুলি চালাই। বুঝতে পারি, পাল্টা প্রতিরোধের মুখে তারা সীমান্ত ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তারপর থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন হিলি সীমান্তে আর কোনোদিন পাকিস্তানি সেনাদের দেখা যায়নি।
হিলি সীমান্তে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে ওই সম্মুখযুদ্ধ শেষে আমাদের ভারী অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এ জন্য প্রথমে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় যতীন বাবুর খামারবাড়ি তিলোড় এলাকায়। সেখানে বগুড়া থেকে আসা ছাত্র ইউনিয়ন ও শ্রমিক নেতাদের অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। দেখা হয় ব্রিটিশবিরোধী নেতা আন্দামানফেরত ডা. আব্দুল কাদের চৌধুরী, সিনিয়র নেতা বগুড়ার ধুনটের আব্দুল লতিফ, মোখলেছুর রহমান, বন্ধু টিএম মুসা পেস্তা, ফিরোজ এবং রেডিওর সঙ্গে। পরে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (সিপিআই) বালুরঘাটের নেতা তপন বাবু আমাদেরকে তাদের পার্টি অফিসে নিয়ে যান। সেখানে দেখা হয় প্রখ্যাত আরেক নেত্রী ইলা মিত্রের স্বামী রমেন মিত্রের সঙ্গে। তাকে পাঠিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। উদ্দেশ্য ছিল ডা. আব্দুল কাদের চৌধুরীকে নিয়ে যাওয়া।
বালুরঘাটের পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটির কাছে একটি প্রাইমারি স্কুলে আমাদের থাকতে দেওয়া হলো। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটিকে 'ওয়েটিং ক্যাম্প' বলা হতো। ওই ক্যাম্পে প্রশিক্ষক হিসেবে বগুড়ার অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য সোহরাব ভাইকে পাই। সেখানে ১৫ দিনের শারীরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর আমাকে ক্যাম্পের খরচ চালাতে অর্থ সংগ্রহের জন্য কলকাতা পাঠানো হলো। রাম বাবু নামে বগুড়ার দত্তবাড়ি এলাকার এক ব্যক্তির সঙ্গে আমি কলকাতার ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতাম।
পরবর্তী সময়ে আমাদেরকে অন্য ক্যাম্পে নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অস্ত্রের ট্রেনিং দেওয়া হয়। দুই ধরনের ট্রেনিং ছিল- গেরিলা ট্রেনিং, যা চার মাসের এবং অপরটি হলো এক মাসের শর্ট ট্রেনিং। আমি এক মাসের শর্ট ট্রেনিং নিয়েছিলাম। রাইফেল এবং স্টেনগান চালানো শেখানো হয় আমাকে।
আমাকে ৭ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে আমাদেরকে দেশে পাঠানোর জন্য সীমান্তের কাছে রাখা হয়। আমরা সবাই দেশে ঢোকার অপেক্ষায় ছিলাম। আমাদের মতোই ১৪ জনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অপর একটি গ্রুপ কুমিলল্গা সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢুকে পড়ে। তবে তারা কেউ আর প্রাণে বাঁচেনি। তখন আমাদেরকে 'যতটা সম্ভব ক্যাজুয়ালিটি এড়ানো'- এই কৌশল অবলম্বন করতে বলা হয়। এ কারণে সব ধরনের প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধ চলা অবস্থায় আমাদের আর দেশে ফেরা হয়নি। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হওয়ার পর আমরা দেশে ফেরার সুযোগ পাই।
লেখক, মুক্তিযোদ্ধা
অনুলিখন :: মোহন আখন্দ,ব্যুরোপ্রধান, বগুড়া
মন্তব্য করুন