- বিশেষ আয়োজন
- তিন দশকে মুজিব হয়ে ওঠেন জাতির পিতা
সা ক্ষা ৎ কা র
তিন দশকে মুজিব হয়ে ওঠেন জাতির পিতা
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সিপিবি সভাপতি
প্রশ্ন :আপনি বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তিনি কীভাবে মুজিব থেকে জাতির পিতা হয়ে উঠলেন?
উত্তর :শেখ মুজিবুর রহমান শুরুতে বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতা ছিলেন না। শুরুতে তিনি ছিলেন দুরন্ত কিশোর 'মুজিবর'। অনেকের কাছে 'মুজিবভাই'। এরপর 'মুজিবুর রহমান' অথবা 'শেখ মুজিবুর রহমান'। তারপর বহুদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে তার নাম ছিল 'শেখ সাহেব'। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর তার নতুন পরিচয় হয় বঙ্গবন্ধু নামে। তিন দশকের রাজনৈতিক জীবনে একাত্তরের পর তিনিই অভিহিত হন স্বাধীন দেশের স্থপতি জাতির পিতা হিসেবে।
প্রশ্ন :বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের উত্তরণ, বিবর্তনকে কীভাবে দেখেন?
উত্তর :তিন দশকের রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা ও জীবন দর্শনেরও ক্রম-উত্তরণ ঘটেছিল। তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুটি ছিল 'পাকিস্তান আন্দোলনের' লড়াকু ছাত্র-কর্মী হিসেবে, 'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান'-এর স্লোগানধারী হিসেবে। তবে তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের উদারনৈতিক এবং কিছুটা গণমুখীন প্রবণতাসম্পন্ন আবুল হাশিম-সোহরাওয়ার্দীর গ্রুপের অনুগামী। ছিলেন ঢাকার নবাবদের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের বিরোধিতাকারী। বঙ্গবন্ধু একই সঙ্গে ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর বিশেষ ভক্ত। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট- এই তিন দলের তিনটি ঝান্ডা পাশাপাশি নিয়ে কলকাতায় 'রশিদ আলী দিবস' পালনসহ নানা কর্মসূচিতে তিনি ছিলেন একজন উৎসাহী ও যৌবনদীপ্ত অংশগ্রহণকারী। মুসলিম লীগের কর্মী হলেও তখন থেকেই তিনি ছিলেন গণসম্পৃক্ত ধারার লোক। সে সময়ই তার মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিকতা বোধের প্রাথমিক উপলব্ধি তৈরি হতে শুরু করে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালি জাতির ওপর শোষণ-বঞ্চনা, বাংলা ভাষার ওপর আঘাত, মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের দ্বারা দলের নেতৃত্ব করায়ত্ত হওয়া ইত্যাদি ঘটনা শেখ মুজিবকে অতি দ্রুতই পাকিস্তান সম্পর্কে মোহমুক্ত করে তুলেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের দাবি নিয়ে সংগ্রাম করে তিনি জেলে গিয়েছিলেন। তিনি মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের একজন প্রধান সংগঠক হয়ে উঠেছিলেন। এখানেই শুরু হয়েছিল সংগ্রামের নতুন অধ্যায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর 'শেখ মুজিব' প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আইউবী সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামেও তিনি অন্যদের সঙ্গে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন :বঙ্গবন্ধু কমিউনিস্টদের কীভাবে মূল্যায়ন করতেন?
উত্তর :পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের বছরগুলোতে জেলখানাগুলো ভরে উঠেছিল রাজনৈতিক বন্দিদের দিয়ে। 'শেখ সাহেবের' এবং আরও অনেকেরই বার বার জেলে যাওয়া-আসা করতে হলো। 'শেখ সাহেব' দেখলেন যে 'আমরা তো আসি-যাই, কিন্তু জেলখানার প্রায় স্থায়ী বসবাসকারী হয়ে রয়েছেন কমিউনিস্ট নেতারা। তাদের কাজ তো দেখি সবসময় আমাদের অভ্যর্থনা জানানো ও বিদায় দেওয়া। কমিউনিস্টদের আত্মত্যাগ তাকে অভিভূত করেছিল। এ কারণে তিনি কমিউনিস্টদের শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন।
প্রশ্ন :বঙ্গবন্ধু কীভাবে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠলেন?
উত্তর :১৯৬৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর দলের 'দুর্বল' নেতাদের পিছুটানকে অগ্রাহ্য করে দলের নেতৃত্ব তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তী ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে শুধু আওয়ামী লীগেরই নয়, তিনি সংগ্রামরত বাঙালি জাতির নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি এবং তার নাম হয়ে উঠেছিল বাঙালি জাতির ঐক্যের ও সংগ্রামের প্রতীক।
প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার প্রথম দেখা হয়েছিল কীভাবে?
উত্তর :১৯৬৬ সালের ৮ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জেলখানাতেই প্রথম আমার সরাসরি দেখা হয়েছিল। আমি আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের কর্মী কখনোই ছিলাম না। আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম, গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলাম। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ছয় দফা ন্যায্য দাবি, কিন্তু বাঙালির মুক্তির সনদ নয়। তাই ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা দাবিতে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে আমাদের প্রতি জনতার সঙ্গে থাকার নির্দেশনা ছিল। সেই হরতালে পিকেটিং করতে গিয়ে আমি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলাম এবং এক মাসের জেল হয়েছিল। পরের দিন যখন কয়েদিদের 'কেস টেবিলে' আমাদের আনা হয়েছে, তখন কেস টেবিলের চত্বরের পাশে 'দেওয়ানি এলাকায়' প্রবেশের দরজা খুলে ভেতর থেকে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা একজন মানুষ আমাদের উদ্দেশে হাত নাড়লেন। তখন আশপাশের হাজতিরা বলল, এটাই শেখ মুজিব। তাকে এই আমার প্রথম নিজ চোখে দেখার ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সরাসরি সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছিল স্বাধীনতার পরে। আমি ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পরে তা নিবিড় হয়েছিল। ১৯৭২ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তখন পতাকা উত্তোলন করে সম্মেলন উদ্বোধন করার পর আমি স্লোগান দিলাম, 'ছাত্র ইউনিয়ন জিন্দাবাদ, জয় সমাজতন্ত্র'। তখন তিনি কানে কানে আমাকে বললেন, 'দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিপদ এখনও শেষ হয়নি। জয় বাংলা স্লোগানটা একটু দাও'। তার সঙ্গে এক টেবিলে বসে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ আমার হয়েছিল। সেগুলো সব সময় রাজনৈতিক আলাপ ছিল না। আমার বিভিন্ন কর্মকান্ড নিয়ে তিনি মন্তব্য করতেন। জানতে চাইতেন, কী কাজ করছি, কেমন করে করছি। হয়তো কখনও তিনিও নিজের কাজ সম্পর্কে বলতেন যে, সেলিম আজ এ কাজটি করে এলাম। আমিও কিছু বিষয় তার সঙ্গে শেয়ার করতাম। আমি বয়সে ছিলাম তার সন্তানতুল্য, অনেক জুনিয়র একজন ছাত্র আন্দোলনের কর্মী। আমি ভিন্ন দল করতাম। এ বিষয়ে বঙ্গববঙ্গবন্ধু সচেতন ছিলেন। আমি নিজেও সচেতন ছিলাম। এ কারণে কখনও সম্পর্কটা গুরু-শিষ্যের মতো ছিল না।
প্রশ্ন :বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার কখনও খন্দকার মোশতাক বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল?
উত্তর :বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একটি আলোচনার কথা আমার বিশেষভাবে মনে আছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, 'মোশতাক (খন্দকার মোশতাক আহমেদ) সম্পর্কে সাবধানে থাকবা। ওর মাথার ভেতরে খালি প্যাঁচ। মাথায় একটা তারকাঁটা ঢোকালে দেখবা ওইটা বাইর করার সময় স্টু্ক্র হয়ে গেছে!' আমি বললাম, 'আপনি তাহলে তাকে এত কাছে কাছে রাখেন ক্যান?' বঙ্গবন্ধু বললেন, ''কাছে কাছে রাখি যাতে দুষ্টামি না করতে পারে। চোখে চোখে রাখতে হয়। মোশতাক আমাকে কালকে কী বলেছে জানো? বলেছে, 'এত সমাজতন্ত্র কইরো না, এত ধর্মনিরপেক্ষতা কইরো না।' ওকে আমি বলে দিছি, মোশতাক তোর কথা আমি শুনলাম না। আমার দেশের কৃষক-শ্রমিক অস্ত্র নিয়ে, জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, আমি সমাজতন্ত্রের পথেই যাব, আমি ধর্মনিরপেক্ষতার পথেই যাব।'' এই মোশতাকগং এবং অন্যরা বঙ্গবন্ধুকে এই অবস্থান ও পথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য অব্যাহতভাবে চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র করেছিল। তারা এ কথাটি বুঝেছিল যে, তাকে (বঙ্গবন্ধুকে) সম্পূর্ণভাবে 'সরিয়ে দিতে' না পারলে দেশকে সম্পূর্ণ 'এবাউট টার্ন' করিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রগতিশীল লক্ষ্য এবং কাঠামোর বাইরে নিয়ে আসা যাবে না। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল।
প্রশ্ন :বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম প্রতিবাদ মিছিল কীভাবে হয়েছিল?
উত্তর :১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত সেই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সবচেয়ে আগে পথে নেমেছিলাম আমরাই। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকার রাজপথে প্রথম সংগঠিত মিছিলটি আমার নেতৃত্বে হয়েছিল।
১৫ আগস্ট দুপুরের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তাৎক্ষণিক প্রতিরোধের সম্ভাবনা তেমন আর নেই। আমরা বুঝতে পারি যে, ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি এক রক্তক্ষয়ী প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান সফল করতে পেরেছে এবং সাময়িকভাবে হলেও তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। আমরা তাই ঠিক করি যে, কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে, হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদের মধ্যে দিয়েই আমাদের এই সংগ্রামের সূচনা করতে হবে। আমরা ঠিক করি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস যেদিনই এরপর শুরু হবে সেদিনই আমরা ক্যাম্পাসে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মিছিল করব। সেই পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং এজন্য দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়ে আমরা সন্ধ্যার পর নিজের নিজের নিরাপদ আশ্রয়স্থানে চলে যাই। নিজেদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগের উপায়গুলোও তার আগে ঠিক করে নিই হাতিরপুলের বাসায় বসে।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে একটি ছোট লিফলেট ছাপাই। ক্যাম্পাস ছাড়াও পাড়ায় পাড়ায় এবং ঢাকা শহরের প্রধান কয়েকটি অফিসের কর্মচারীদের মধ্যে অফিস চলাকালে এই লিফলেট আমরা বিতরণ করি। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মন্জুরুল আহসান খানের চামেলীবাগের বাসা থেকে কয়েকটি টিম লিফলেট বিলির এই কাজ চালায়। লিফলেট বিলি করতে গিয়ে কমিউনিস্ট ছাত্র কর্মী খায়রুল সিদ্দিক, মাহবুব, শাহ জামাল, দানিয়াল, মুন প্রমুখ এজিবি অফিস চত্বরে হামলার সম্মুখীন হন এবং তাদের মধ্যে দু'জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। কাজল ব্যানার্জি, শওকত হোসেন প্রমুখ গ্রেপ্তার হয়ে যান।
এসব কাজের পাশাপাশি ঢাকা শহরের বিভিন্ন পাড়ায় এবং জেলাগুলোতে আমরা ক্রমেই যোগাযোগ নিবিড় করার ব্যবস্থা নিই। অনেকের কাছেই সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করে, কর্মীদের সাহসী ও সংহত রাখার কাজে মনোযোগী হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠাই। পোস্টকার্ডে জেলার নেতাদের এভাবে লেখা হতো- 'তোমরা বাবার মৃত্যুতে ভেঙে পড়ো না। সংসারকে আবার দাঁড় করাতে হবে। ভাইবোনদের মানুষ করতে হবে। বিপদের মধ্যে মাথা ঠিক রেখে চলবে। আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে যাবে...' এ ধরনের কথা। সবাই এসব কথার মমার্থ বুঝে নিতে পারত।
পুরান ঢাকায় বেশ কয়েকটি বাসা আমরা এই উদ্দেশ্যে ব্যবহার উপযোগী করে তুলি। এই কাজে কামরুল আহসান খান ও মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ধীরে ধীরে নেতাকর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ বিস্তৃত হতে থাকে। কাজী আকরাম, আনোয়ারুল হক, ওবায়দুল কাদের, মমতাজ হোসেন প্রমুখ বন্ধুদের যুক্ত করে আমরা আরও বড় পদক্ষেপের দিকে অগ্রসর হই।
আমাদের পরিকল্পনা অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হওয়ার প্রথম দিনে 'মুজিব হত্যার বিচার চাই', 'এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে'- এই ধরনের স্লোগান দিতে দিতে ক্যাম্পাসের কলা ভবনের করিডোরে 'জঙ্গি ঝটিকা মিছিল' করি। মাহবুব জামান, কাজী আকরাম হোসেন প্রমুখ এই মিছিলের নেতৃত্ব দেন। এই মিছিলের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কর্মীরা সাহস পান; কিন্তু জাসদপন্থি ছাত্ররা মরিয়া হয়ে ভয়-ভীতির হুমকি দেওয়া শুরু করে। হলে হলে হামলা শুরু হয়। 'মুজিবের দালালরা হুঁশিয়ার' স্লোগান দিয়ে এবং আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে ক্যাম্পাসে পাল্টা মিছিল করে জাসদপন্থিরা। আমরা কয়েকদিন চুপ করে থাকি। নতুন পরিকল্পনা নিয়ে প্রস্তুত হতে থাকি। কয়েকদিন পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস চলাকালে একসঙ্গে কয়েকটি ক্লাসরুমে গিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করার জন্য ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানানোর কর্মসূচি সফল করি।
অক্টোবরের শুরুতেই আমরা পরিকল্পনা নিই যে, খুব ভালো করে প্রস্তুতি নিয়ে দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, সাধারণ নাগরিকসহ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি অভিমুখে মৌন মিছিল করব। এটাই তখন আমাদের একটা প্রধান কাজের বিষয় হয়ে ওঠে। এই লক্ষ্যে নানাভাবে প্রস্তুতি চলতে থাকে। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তির সঙ্গে আমি নিজে গিয়ে দেখা করি এবং এই মৌন মিছিলে শামিল থাকার জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানাই। তারা প্রায় সবাই আমাদের উৎসাহিত করেন। এ মৌন মিছিলের তারিখ অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে নির্ধারিত হয়। পরে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য আরও সময়ের কথা ভেবে তা ৪ নভেম্বর পুনর্নির্ধারণ করা হয়।
৪ নভেম্বর মৌন মিছিলের প্রস্তুতি যখন সবদিক থেকে শেষ পর্যায়ে, তখন ২ নভেম্বর রাতে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। আমাদের কাছে এই ঘটনা ছিল আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত। আমরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিই যে, এই অবস্থার মধ্যেও আমরা আমাদের মৌন মিছিলের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করব। ৪ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের বটতলায় আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে কালো পতাকা হাতে দুই লাইনে মৌন মিছিল শুরু হওয়ার আগে অনুষ্ঠিত এই বিশাল সমাবেশে আমি বক্তৃতা করি। তারপর শুরু হয় মৌন মিছিল।
নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির কাছে আসতেই পুলিশ আমাদের পথ আটকায় এবং বেশ কিছুক্ষণ পুলিশের সঙ্গে আমার তুমুল তর্কবিতর্ক হয়। শেষ পর্যন্ত পুলিশ সরে দাঁড়াতে বাধ্য হলে মিছিল এগিয়ে যেতে থাকে। ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসায় মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় স্থানে স্থানে সেনাবাহিনীকে আমরা অবস্থান নেওয়া অবস্থায় দেখতে পাই। নীরব মিছিল নিয়ে ৩২ নম্বরের বাড়ির বন্ধ গেটে এসে গেটের সামনে মিছিলের অগ্রভাগ পৌঁছার পর, সকলের পক্ষ থেকে আমি প্রথমে পুষ্পস্তবক অর্পণ করি। ক্রমান্বয়ে মিছিলের সমবেত অন্যরা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। একজন অজ্ঞাত মওলানা সাহেব মোনাজাত করেন। সকলে দু'হাত তুলে মোনাজাতে শরিক হন। আবেগ-আপ্লুত এই অনুষ্ঠান শেষ করে আমরা মিছিলের মুখ ঘুরিয়ে দিই। মৌন মিছিল তখন সরব হয়ে ওঠে। 'মুজিব হত্যার বিচার চাই' স্লোগান দিতে দিতে সরব মিছিলসহ আমরা ক্যাম্পাসে ফিরে আসি।
আমি সব সময় বিশ্বাস করি কোটি জনতার অন্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অমর হয়ে থাকবেন। কারণ, বঙ্গবন্ধু ও জনগণের মিলিত কীর্তি হলো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ধারা ও তার ভিত্তিতে অর্জিত স্বাধীনতা।
উত্তর :শেখ মুজিবুর রহমান শুরুতে বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতা ছিলেন না। শুরুতে তিনি ছিলেন দুরন্ত কিশোর 'মুজিবর'। অনেকের কাছে 'মুজিবভাই'। এরপর 'মুজিবুর রহমান' অথবা 'শেখ মুজিবুর রহমান'। তারপর বহুদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে তার নাম ছিল 'শেখ সাহেব'। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর তার নতুন পরিচয় হয় বঙ্গবন্ধু নামে। তিন দশকের রাজনৈতিক জীবনে একাত্তরের পর তিনিই অভিহিত হন স্বাধীন দেশের স্থপতি জাতির পিতা হিসেবে।
প্রশ্ন :বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের উত্তরণ, বিবর্তনকে কীভাবে দেখেন?
উত্তর :তিন দশকের রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা ও জীবন দর্শনেরও ক্রম-উত্তরণ ঘটেছিল। তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুটি ছিল 'পাকিস্তান আন্দোলনের' লড়াকু ছাত্র-কর্মী হিসেবে, 'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান'-এর স্লোগানধারী হিসেবে। তবে তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের উদারনৈতিক এবং কিছুটা গণমুখীন প্রবণতাসম্পন্ন আবুল হাশিম-সোহরাওয়ার্দীর গ্রুপের অনুগামী। ছিলেন ঢাকার নবাবদের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের বিরোধিতাকারী। বঙ্গবন্ধু একই সঙ্গে ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর বিশেষ ভক্ত। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট- এই তিন দলের তিনটি ঝান্ডা পাশাপাশি নিয়ে কলকাতায় 'রশিদ আলী দিবস' পালনসহ নানা কর্মসূচিতে তিনি ছিলেন একজন উৎসাহী ও যৌবনদীপ্ত অংশগ্রহণকারী। মুসলিম লীগের কর্মী হলেও তখন থেকেই তিনি ছিলেন গণসম্পৃক্ত ধারার লোক। সে সময়ই তার মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিকতা বোধের প্রাথমিক উপলব্ধি তৈরি হতে শুরু করে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালি জাতির ওপর শোষণ-বঞ্চনা, বাংলা ভাষার ওপর আঘাত, মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের দ্বারা দলের নেতৃত্ব করায়ত্ত হওয়া ইত্যাদি ঘটনা শেখ মুজিবকে অতি দ্রুতই পাকিস্তান সম্পর্কে মোহমুক্ত করে তুলেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের দাবি নিয়ে সংগ্রাম করে তিনি জেলে গিয়েছিলেন। তিনি মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের একজন প্রধান সংগঠক হয়ে উঠেছিলেন। এখানেই শুরু হয়েছিল সংগ্রামের নতুন অধ্যায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর 'শেখ মুজিব' প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আইউবী সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামেও তিনি অন্যদের সঙ্গে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন :বঙ্গবন্ধু কমিউনিস্টদের কীভাবে মূল্যায়ন করতেন?
উত্তর :পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের বছরগুলোতে জেলখানাগুলো ভরে উঠেছিল রাজনৈতিক বন্দিদের দিয়ে। 'শেখ সাহেবের' এবং আরও অনেকেরই বার বার জেলে যাওয়া-আসা করতে হলো। 'শেখ সাহেব' দেখলেন যে 'আমরা তো আসি-যাই, কিন্তু জেলখানার প্রায় স্থায়ী বসবাসকারী হয়ে রয়েছেন কমিউনিস্ট নেতারা। তাদের কাজ তো দেখি সবসময় আমাদের অভ্যর্থনা জানানো ও বিদায় দেওয়া। কমিউনিস্টদের আত্মত্যাগ তাকে অভিভূত করেছিল। এ কারণে তিনি কমিউনিস্টদের শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন।
প্রশ্ন :বঙ্গবন্ধু কীভাবে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠলেন?
উত্তর :১৯৬৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর দলের 'দুর্বল' নেতাদের পিছুটানকে অগ্রাহ্য করে দলের নেতৃত্ব তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তী ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে শুধু আওয়ামী লীগেরই নয়, তিনি সংগ্রামরত বাঙালি জাতির নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি এবং তার নাম হয়ে উঠেছিল বাঙালি জাতির ঐক্যের ও সংগ্রামের প্রতীক।
প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার প্রথম দেখা হয়েছিল কীভাবে?
উত্তর :১৯৬৬ সালের ৮ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জেলখানাতেই প্রথম আমার সরাসরি দেখা হয়েছিল। আমি আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের কর্মী কখনোই ছিলাম না। আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম, গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলাম। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ছয় দফা ন্যায্য দাবি, কিন্তু বাঙালির মুক্তির সনদ নয়। তাই ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা দাবিতে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে আমাদের প্রতি জনতার সঙ্গে থাকার নির্দেশনা ছিল। সেই হরতালে পিকেটিং করতে গিয়ে আমি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলাম এবং এক মাসের জেল হয়েছিল। পরের দিন যখন কয়েদিদের 'কেস টেবিলে' আমাদের আনা হয়েছে, তখন কেস টেবিলের চত্বরের পাশে 'দেওয়ানি এলাকায়' প্রবেশের দরজা খুলে ভেতর থেকে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা একজন মানুষ আমাদের উদ্দেশে হাত নাড়লেন। তখন আশপাশের হাজতিরা বলল, এটাই শেখ মুজিব। তাকে এই আমার প্রথম নিজ চোখে দেখার ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সরাসরি সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছিল স্বাধীনতার পরে। আমি ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পরে তা নিবিড় হয়েছিল। ১৯৭২ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তখন পতাকা উত্তোলন করে সম্মেলন উদ্বোধন করার পর আমি স্লোগান দিলাম, 'ছাত্র ইউনিয়ন জিন্দাবাদ, জয় সমাজতন্ত্র'। তখন তিনি কানে কানে আমাকে বললেন, 'দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিপদ এখনও শেষ হয়নি। জয় বাংলা স্লোগানটা একটু দাও'। তার সঙ্গে এক টেবিলে বসে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ আমার হয়েছিল। সেগুলো সব সময় রাজনৈতিক আলাপ ছিল না। আমার বিভিন্ন কর্মকান্ড নিয়ে তিনি মন্তব্য করতেন। জানতে চাইতেন, কী কাজ করছি, কেমন করে করছি। হয়তো কখনও তিনিও নিজের কাজ সম্পর্কে বলতেন যে, সেলিম আজ এ কাজটি করে এলাম। আমিও কিছু বিষয় তার সঙ্গে শেয়ার করতাম। আমি বয়সে ছিলাম তার সন্তানতুল্য, অনেক জুনিয়র একজন ছাত্র আন্দোলনের কর্মী। আমি ভিন্ন দল করতাম। এ বিষয়ে বঙ্গববঙ্গবন্ধু সচেতন ছিলেন। আমি নিজেও সচেতন ছিলাম। এ কারণে কখনও সম্পর্কটা গুরু-শিষ্যের মতো ছিল না।
প্রশ্ন :বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার কখনও খন্দকার মোশতাক বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল?
উত্তর :বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একটি আলোচনার কথা আমার বিশেষভাবে মনে আছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, 'মোশতাক (খন্দকার মোশতাক আহমেদ) সম্পর্কে সাবধানে থাকবা। ওর মাথার ভেতরে খালি প্যাঁচ। মাথায় একটা তারকাঁটা ঢোকালে দেখবা ওইটা বাইর করার সময় স্টু্ক্র হয়ে গেছে!' আমি বললাম, 'আপনি তাহলে তাকে এত কাছে কাছে রাখেন ক্যান?' বঙ্গবন্ধু বললেন, ''কাছে কাছে রাখি যাতে দুষ্টামি না করতে পারে। চোখে চোখে রাখতে হয়। মোশতাক আমাকে কালকে কী বলেছে জানো? বলেছে, 'এত সমাজতন্ত্র কইরো না, এত ধর্মনিরপেক্ষতা কইরো না।' ওকে আমি বলে দিছি, মোশতাক তোর কথা আমি শুনলাম না। আমার দেশের কৃষক-শ্রমিক অস্ত্র নিয়ে, জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, আমি সমাজতন্ত্রের পথেই যাব, আমি ধর্মনিরপেক্ষতার পথেই যাব।'' এই মোশতাকগং এবং অন্যরা বঙ্গবন্ধুকে এই অবস্থান ও পথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য অব্যাহতভাবে চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র করেছিল। তারা এ কথাটি বুঝেছিল যে, তাকে (বঙ্গবন্ধুকে) সম্পূর্ণভাবে 'সরিয়ে দিতে' না পারলে দেশকে সম্পূর্ণ 'এবাউট টার্ন' করিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রগতিশীল লক্ষ্য এবং কাঠামোর বাইরে নিয়ে আসা যাবে না। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল।
প্রশ্ন :বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম প্রতিবাদ মিছিল কীভাবে হয়েছিল?
উত্তর :১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত সেই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সবচেয়ে আগে পথে নেমেছিলাম আমরাই। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকার রাজপথে প্রথম সংগঠিত মিছিলটি আমার নেতৃত্বে হয়েছিল।
১৫ আগস্ট দুপুরের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তাৎক্ষণিক প্রতিরোধের সম্ভাবনা তেমন আর নেই। আমরা বুঝতে পারি যে, ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি এক রক্তক্ষয়ী প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান সফল করতে পেরেছে এবং সাময়িকভাবে হলেও তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। আমরা তাই ঠিক করি যে, কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে, হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদের মধ্যে দিয়েই আমাদের এই সংগ্রামের সূচনা করতে হবে। আমরা ঠিক করি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস যেদিনই এরপর শুরু হবে সেদিনই আমরা ক্যাম্পাসে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মিছিল করব। সেই পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং এজন্য দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়ে আমরা সন্ধ্যার পর নিজের নিজের নিরাপদ আশ্রয়স্থানে চলে যাই। নিজেদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগের উপায়গুলোও তার আগে ঠিক করে নিই হাতিরপুলের বাসায় বসে।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে একটি ছোট লিফলেট ছাপাই। ক্যাম্পাস ছাড়াও পাড়ায় পাড়ায় এবং ঢাকা শহরের প্রধান কয়েকটি অফিসের কর্মচারীদের মধ্যে অফিস চলাকালে এই লিফলেট আমরা বিতরণ করি। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মন্জুরুল আহসান খানের চামেলীবাগের বাসা থেকে কয়েকটি টিম লিফলেট বিলির এই কাজ চালায়। লিফলেট বিলি করতে গিয়ে কমিউনিস্ট ছাত্র কর্মী খায়রুল সিদ্দিক, মাহবুব, শাহ জামাল, দানিয়াল, মুন প্রমুখ এজিবি অফিস চত্বরে হামলার সম্মুখীন হন এবং তাদের মধ্যে দু'জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। কাজল ব্যানার্জি, শওকত হোসেন প্রমুখ গ্রেপ্তার হয়ে যান।
এসব কাজের পাশাপাশি ঢাকা শহরের বিভিন্ন পাড়ায় এবং জেলাগুলোতে আমরা ক্রমেই যোগাযোগ নিবিড় করার ব্যবস্থা নিই। অনেকের কাছেই সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করে, কর্মীদের সাহসী ও সংহত রাখার কাজে মনোযোগী হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠাই। পোস্টকার্ডে জেলার নেতাদের এভাবে লেখা হতো- 'তোমরা বাবার মৃত্যুতে ভেঙে পড়ো না। সংসারকে আবার দাঁড় করাতে হবে। ভাইবোনদের মানুষ করতে হবে। বিপদের মধ্যে মাথা ঠিক রেখে চলবে। আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে যাবে...' এ ধরনের কথা। সবাই এসব কথার মমার্থ বুঝে নিতে পারত।
পুরান ঢাকায় বেশ কয়েকটি বাসা আমরা এই উদ্দেশ্যে ব্যবহার উপযোগী করে তুলি। এই কাজে কামরুল আহসান খান ও মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ধীরে ধীরে নেতাকর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ বিস্তৃত হতে থাকে। কাজী আকরাম, আনোয়ারুল হক, ওবায়দুল কাদের, মমতাজ হোসেন প্রমুখ বন্ধুদের যুক্ত করে আমরা আরও বড় পদক্ষেপের দিকে অগ্রসর হই।
আমাদের পরিকল্পনা অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হওয়ার প্রথম দিনে 'মুজিব হত্যার বিচার চাই', 'এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে'- এই ধরনের স্লোগান দিতে দিতে ক্যাম্পাসের কলা ভবনের করিডোরে 'জঙ্গি ঝটিকা মিছিল' করি। মাহবুব জামান, কাজী আকরাম হোসেন প্রমুখ এই মিছিলের নেতৃত্ব দেন। এই মিছিলের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কর্মীরা সাহস পান; কিন্তু জাসদপন্থি ছাত্ররা মরিয়া হয়ে ভয়-ভীতির হুমকি দেওয়া শুরু করে। হলে হলে হামলা শুরু হয়। 'মুজিবের দালালরা হুঁশিয়ার' স্লোগান দিয়ে এবং আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে ক্যাম্পাসে পাল্টা মিছিল করে জাসদপন্থিরা। আমরা কয়েকদিন চুপ করে থাকি। নতুন পরিকল্পনা নিয়ে প্রস্তুত হতে থাকি। কয়েকদিন পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস চলাকালে একসঙ্গে কয়েকটি ক্লাসরুমে গিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করার জন্য ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানানোর কর্মসূচি সফল করি।
অক্টোবরের শুরুতেই আমরা পরিকল্পনা নিই যে, খুব ভালো করে প্রস্তুতি নিয়ে দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, সাধারণ নাগরিকসহ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি অভিমুখে মৌন মিছিল করব। এটাই তখন আমাদের একটা প্রধান কাজের বিষয় হয়ে ওঠে। এই লক্ষ্যে নানাভাবে প্রস্তুতি চলতে থাকে। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তির সঙ্গে আমি নিজে গিয়ে দেখা করি এবং এই মৌন মিছিলে শামিল থাকার জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানাই। তারা প্রায় সবাই আমাদের উৎসাহিত করেন। এ মৌন মিছিলের তারিখ অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে নির্ধারিত হয়। পরে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য আরও সময়ের কথা ভেবে তা ৪ নভেম্বর পুনর্নির্ধারণ করা হয়।
৪ নভেম্বর মৌন মিছিলের প্রস্তুতি যখন সবদিক থেকে শেষ পর্যায়ে, তখন ২ নভেম্বর রাতে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। আমাদের কাছে এই ঘটনা ছিল আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত। আমরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিই যে, এই অবস্থার মধ্যেও আমরা আমাদের মৌন মিছিলের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করব। ৪ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের বটতলায় আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে কালো পতাকা হাতে দুই লাইনে মৌন মিছিল শুরু হওয়ার আগে অনুষ্ঠিত এই বিশাল সমাবেশে আমি বক্তৃতা করি। তারপর শুরু হয় মৌন মিছিল।
নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির কাছে আসতেই পুলিশ আমাদের পথ আটকায় এবং বেশ কিছুক্ষণ পুলিশের সঙ্গে আমার তুমুল তর্কবিতর্ক হয়। শেষ পর্যন্ত পুলিশ সরে দাঁড়াতে বাধ্য হলে মিছিল এগিয়ে যেতে থাকে। ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসায় মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় স্থানে স্থানে সেনাবাহিনীকে আমরা অবস্থান নেওয়া অবস্থায় দেখতে পাই। নীরব মিছিল নিয়ে ৩২ নম্বরের বাড়ির বন্ধ গেটে এসে গেটের সামনে মিছিলের অগ্রভাগ পৌঁছার পর, সকলের পক্ষ থেকে আমি প্রথমে পুষ্পস্তবক অর্পণ করি। ক্রমান্বয়ে মিছিলের সমবেত অন্যরা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। একজন অজ্ঞাত মওলানা সাহেব মোনাজাত করেন। সকলে দু'হাত তুলে মোনাজাতে শরিক হন। আবেগ-আপ্লুত এই অনুষ্ঠান শেষ করে আমরা মিছিলের মুখ ঘুরিয়ে দিই। মৌন মিছিল তখন সরব হয়ে ওঠে। 'মুজিব হত্যার বিচার চাই' স্লোগান দিতে দিতে সরব মিছিলসহ আমরা ক্যাম্পাসে ফিরে আসি।
আমি সব সময় বিশ্বাস করি কোটি জনতার অন্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অমর হয়ে থাকবেন। কারণ, বঙ্গবন্ধু ও জনগণের মিলিত কীর্তি হলো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ধারা ও তার ভিত্তিতে অর্জিত স্বাধীনতা।
মন্তব্য করুন