ভণ্ড পীর-মোল্লা আর গুরু-পুরোহিতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বা ঘৃণা জানায় যারা, তারাই আবার পীরের দরগা কিংবা বাবা ঠাকুরের থানে যায় মানত আদায় করতে। সংসারে জীবিত মানুষের কাছে যখন নানাভাবে কেবল প্রতারিতই হতে থাকে, তখন তারা মৃত পীর বা সন্তের কাছে যায় আশ্রয় ও আশ্বাসের আশায়। সেখানেও অবশ্যি পীরের জীবিত খাদেম বা সন্তের সেবায়েতদের নানা রকম প্রতারণার শিকার তারা হয়, তবু মৃত পীর বা সন্তের প্রতি গভীর বিশ্বাস তাদের দরগা বা থানে বারবার টেনে নিয়ে যায়। নিঃসন্তানের সন্তান লাভে কামনাই হোক কিংবা সন্তানবতীর সন্তানের কল্যাণ কামনাই হোক, কিংবা হোক কঠিন রোগের হাত থেকে মুক্তি বা মামলায় জয়লাভের কামনা- সবকিছুর জন্য মৃতের কাছে ধরনা দেওয়াটাই জীবিতের শরণ নেওয়ার চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ মনে হয় তাদের কাছে। আর এ ব্যাপারে হিন্দু ও মুসলমানের কোনো পার্থক্য নেই। নেত্রকোনার মদনপুরে শাহ সুলতানের দরগায় রোজ যারা শিরনি দিয়ে যায়, তাদের কে হিন্দু কে মুসলমান- এ প্রশ্ন কেউ জিজ্ঞেস করে না, নিজেরাও হিন্দু কি মুসলমান তা মনে রাখে না। আমাদের গ্রাম থেকে নেত্রকোনা যেতে হয় মদনপুরের শাহ সুলতানের দরগার সামনে দিয়ে। নেত্রকোনার দিকে যাত্রা করলেই ঠাকুমা আমাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিতেন যে, এক আনার বাতাসা কিনে শাহ সুলতানের দরগায় শিরনি দিয়ে যেতে যেন ভুলে না যাই।
শরীরে 'ম্যাজ' বা আঁচিল দেখা দিলে আমাদের এলাকার মানুষ কেন্দুয়ার লস্করপুরের শিববাড়িতে গোলমরিচ মানত করতো। শিব ঠাকুরকে গোলমরিচ দিলে নাকি শরীরের আঁচিল মিলিয়ে যায়। এ বিশ্বাসেও হিন্দু আর মুসলমানের কোনো ভেদ ছিল না। চন্দপাড়ার কালীবাড়িতে প্রতি বছর ফাল্কগ্দুন চৈত্র মাসে যখন পুজো হতো, তখন গাঁয়ের অনেক মানুষ দেবীকে উৎসর্গ করার জন্য পাঁঠা (ছাগ) নিয়ে আসত, সে মানুষদের মধ্যে সুবল দাসদের মতন আকালু শেখরাও থাকতো। এসব ব্যাপারে অর্থাৎ পীরের দরগায় শিরনি দিতে কিংবা শিববাড়িতে গোলমরিচ ও কালীবাড়িতে ছাগ উৎসর্গ করতে পুরুত বা মোল্লার নিষেধ বিধিকে থোড়াই পরোয়া করতো তারা। পীরের শিরনি তো হতো ঘরে ঘরে। সারা বাংলার সত্যপীর ছাড়াও আমাদের এলাকায় শিরনি দেওয়া হতো হাজির পীর, ঠুনকা পীর, আৎখা পীর, কানুপীর এবং এ রকম আরো অনেক পীরের নামে। আমার ঠাকুর মাকেও এসব শিরনি দিতে দেখেছি।
সংস্কৃত মন্ত্র বা আরবি সূরা জানুক আর নাই জানুক গাঁয়ের মানুষ জানতো তার দৈনন্দিন বালামুসিবত দূর করার মন্ত্র। সবাই সব মন্ত্র জানতো না নিশ্চয়, তবে বিভিন্ন বিষয়ের মন্ত্র জানা নানা বিশেষজ্ঞ গুণিন গাঁয়ে ছিল অনেক। যেমন সাপের বিষ নামানোর ওঝা, বোরো ক্ষেতের ওপর থেকে শিলাবৃষ্টি দূর করে দেওয়ার হিরালি, ভূত ছাড়ানোর কবিরাজ। গাঁয়ের শতকরা আশি বা পঁচাশি জন কিংবা তারও বেশি মানুষের কাছে এসব ওঝা, হিরালি, কবিরাজের মান্যতা পুরুত বা মোল্লার চেয়ে অনেক বেশি। রোগ-ব্যারামেও ডাক্তারের চেয়ে এসব ওজা গুণিন ও কবিরাজের ওপর তাদের অনেক বেশি ভরসা ও নির্ভরতা। আর এদের ওপর নির্ভর না করে বা ভরসা না রেখেই বা কী করবে, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সুযোগ বা ক্ষমতাই তাদের কতটুকু? লৌকিক জগতের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত বলেই তো তারা অলৌকিকের শরণ নেয়।
এভাবেই সুখে-দুঃখে আশায়-নিরাশায়, বিশ্বাসে-অজ্ঞতায়, সংস্কারে- কুসংস্কারে গাঁয়ের সব প্রাকৃতজনকে একসাথে জড়াজড়ি করে থাকতে দেখেছি। আকালু শেখ আর সুবল দাসদের মধ্যে যে হাতাহাতি হয়নি কখনো, তা নয়। তবে হাতাহাতির চেয়ে হাতে হাতে মিলিয়ে কাজ করতেই তারা বেশি অভ্যস্ত ছিল। দিনের কাজের শেষে সন্ধ্যায় তারা যে আসর জমাতো, তাতে একই ধরনের বন্দনায় গলা মিলিয়ে গাইতো- পুবেতে বন্দনা করি পুবের ভানুস্বর।
একদিকে উদর গো ভানু চৌদিকে পশর

বিষয় : পাকিস্তানের ভূতদর্শন

মন্তব্য করুন