- বিশেষ আয়োজন
- মানুষ না পারলে আর কে পারবে!
মানুষ না পারলে আর কে পারবে!

আমরা মানুষ। সৃষ্টির সেরা জীব। আমরা প্রকৃতিরও সন্তান। তা সত্ত্বেও প্রকৃতিকে প্রতিনিয়ত আমরা ধ্বংস করে চলছি। নির্বিকারে বন উজাড় করেছি। এরই ফলে এখন প্রায়ই বিশ্বের অনেক দেশে দাবানলের খবর শোনা যায়। আর এসব দাবানলে কোটি কোটি গাছ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। লাখ লাখ বন্যপ্রাণী মারা গেছে। আমাদের লোভ আর হঠকারিতায় বহু প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। যে প্রকৃতির মধ্যে আমরা বাস করি, তার ভারসাম্য রক্ষার কথা মোটেও ভাবিনি। সবকিছুকে আমাদের লালসার শিকার করেছি। প্রকৃতিকে কোণঠাসা করেছি। কিন্তু আমরা নিজেরাও তো এই প্রকৃতির ভেতরেই আছি। সেই প্রকৃতির প্রতিশোধ আমাদের গায়েই তো লাগবে বেশি। সেটাই এখন হচ্ছে। আমরা পারমাণবিক বোমা তৈরি করেছি। অস্ত্রশস্ত্রে কত কত দেশ তছনছ করে দিয়েছি। অথচ এখন একটা অণুজীবের কারণে কেমন অসহায় হয়ে পড়েছি আমরা। তবে সব খারাপেরই একটা ভালো দিক আছে বলে আমি বিশ্বাস করি।
এই ভাইরাসের প্রকোপে মানববিদ্বেষী কূটনীতি এখন স্তব্ধ হয়ে আছে। সব দেশ এখন করোনাভাইরাসের কবল থেকে বাঁচার লড়াইয়ে ব্যস্ত। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। মানুষ বিরূপ প্রকৃতির কাছে হার মানছে। বাঁচতে হলে বোধোদয় হতেই হবে। আমাদের আরও মানবিক হতে হবে, সত্যিকারের শিক্ষিত হতে হবে। এবার যদি আমাদের বোধোদয় হয়। এখন যদি আমরা আরও একটু প্রকৃতিবান্ধব হই, প্রাণীবান্ধব হই। এই সময়টা পার হলে পুরো মানবজাতির এ ব্যাপারে নতুন উপলব্ধি আসা উচিত। আমার মনে হয় মানুষের উপলব্ধি হয়তো আসবে, হয়তো আসবে না। কিন্তু এই পরিস্থিতিটা তো কিছু প্রশ্ন রেখেই গেল। এর উত্তর কিন্তু আমাদের খুঁজতে হবে।
কিছুদিন আগে ফেসবুকে দেখলাম, কোথায় যেন জেলেরা ডলফিন আর শুশুক ধরে মেরে ফেলছে। একটা বানর খেতে এসেছে বলে ছালার বস্তা দিয়ে মুখ বেঁধে মেরে ফেলেছে। একটি বানরকে কেন শ্বাস আটকে মেরে ফেলতে হবে? প্রাণীদের প্রতি কেন আমাদের এত নিষ্ঠুর হতে হবে? ডলফিন বা বানরও তো আমাদের মতো প্রকৃতির সন্তান। এসব ভেবে প্রায়ই মনটা বিষণ্ণ থাকে। লকডাউনের এই সময়ে ভেবেছিলাম প্রচুর বই পড়ব, কিন্তু মনোযোগ দিতে পারিনি। একটি বইও শেষ করতে পারিনি। ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভীষণ উদ্বেগের মধ্যে আছি।
কিছুদিন আগে ফোনে ফোনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া সেই নির্মম নিষ্ঠুর ভিডিও আমারই দেশে তৈরি- এও বিশ্বাস করতে হবে? আমারই কোনো বোনকে লাঞ্ছনায় নরকের অতলে পৌঁছে দিচ্ছে আমারই পাশের বাড়ির এক ছেলে, এও আমাকে দেখতে হবে আমারই ভাইয়ের রক্তে ভেজা লাল-সবুজের দেশে? নিষ্পাপ শিশু, সরল আদিবাসী, বেড়াতে যাওয়া আনন্দিত স্ত্রী, ঘরের কোণে সংসারী মা- সবাই হয়ে যাচ্ছে নরকের অঙ্গারে পোড়া ছবি। একের পর এক এই সর্বনাশা ঢেউ কোথায় ভাসিয়ে নিচ্ছে আমাদের? তাহলে কি মেনে নিতে হবে, ধর্ষণের অতিমারিই আমাদের গন্তব্য? না। এই পরিণতি আমরা কখনোই মেনে নেব না। এ যদি পৌরুষ হয়, তাকে আমি বলি, ছিঃ। সবাই কণ্ঠ মিলিয়ে চিৎকার করে বলি, ছিঃ।
খবরে পড়ছি, করোনার মহামারির আঘাতে বাংলাদেশে আরও তিন কোটি মানুষ নতুন করে গরিব হবে। হতদরিদ্র থেকে মধ্যবিত্ত পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষ চোখে অন্ধকার দেখছে। করোনার মধ্যেই এলো ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডব। তারপর নৌকাডুবি। বড় দুর্যোগে পর্যুদস্ত মানুষের ওপর ঢেউয়ের মতো একটার পর একটা আরও দুর্যোগ আসছেই। সারাটা পৃথিবীই কোভিড-১৯ এর কবল থেকে বাঁচতে সবার নিদান এখন একটিই- সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। ভাবা যায়, পৃথিবী জুড়ে শুটিংস্পটের হাজার পাওয়ারের বাতি কখনও একটানা এত দিন না জ্বলে থেকেছে!
এখন সংক্রমণের ভয় কাটিয়ে ধীরে ধীরে মানুষের মনে আস্থা ফিরে আসছে। কলরবে ভরে উঠছে শুটিংয়ের লোকেশনগুলো। ধীরে ধীরে সচল হয়েছে ক্যামেরা। ছবি দেখার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে সিনেমা হল। এতকিছুর মধ্যেও সামনে নাকি ওঁৎ পেতে আছে দুনিয়াজোড়া অর্থনীতির সংকট। এই সংকটের মধ্যে চলচ্চিত্র দম নিয়ে শক্ত পায়ে দাঁড়াতে পারবে তো? ভালোবাসার এই শিল্পমাধ্যমটির জন্য সবসময় হাহাকার করে বুক।
শুধু চলচ্চিত্রশিল্পই তো নয়, পুরো বিশ্ব দাঁড়িয়ে আছে অচেনা এক ভবিতব্যের সামনে। নানা লেখাপত্রে পড়ছি, করোনার এই বিপর্যয়ের পরে পৃথিবী নাকি আর আগের মতো থাকবে না। স্বাধীনতার চেয়েও মানুষের কাছে জরুরি হয়ে উঠছে সুস্থতা। তার ছুতোয় রাষ্ট্রগুলো হয়ে উঠবে আরও সংকীর্ণ, আরও নিষ্ঠুর। নানা দেশের সীমান্তের দেয়াল আরও উঁচু হবে। তার চেয়ে বড় ভয়, বদলে যাবে মানুষের মন আর আচরণ। সামাজিক দূরত্ব রক্ষায় অন্যের প্রতি আমাদের যে অবিশ্বাস, তা-ই হয়তো ধীরে ধীরে হয়ে উঠবে এক সামাজিক বিশ্বাস। মানুষ হয়ে পড়বে আরও আত্মকেন্দ্রিক। খোলা আকাশের চেয়ে বেশি আপন হয়ে উঠবে হাতের মোবাইল স্ট্ক্রিন। আপৎকালের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ব্যক্তিকে নিয়ে যাবে আরও গাঢ় অন্ধকার কোটরে। সেটি যদি হয়, তা হবে সভ্যতার মৃত্যু। করোনা মহামারির এই মৃত্যুর চেয়ে সেটি হবে আরও ভয়াবহ।
তাই সংক্রমণ থেকে বাঁচতে আমরা হাত গুটিয়ে রাখব সত্যি, কিন্তু অন্যকে বাঁচাতে হৃদয়টাও বাড়িয়ে দেব। খুলে রাখব মনের সব জানলা। যে স্বপ্ন আর প্রত্যাশার মধ্যে মানুষ বাঁচে, সবাই মিলেই তার ভাগীদার হব। আর মানুষই তো শুধু নয়, প্রকৃতি আর প্রাণিজগৎ মিলিয়েই তো আমরা। তাদের প্রতি আমাদের অসম্ভব নিষ্ঠুরতাই তো ফিরে এলো মহামারির চেহারা নিয়ে। সবাইকে নিয়েই না হয় আমরা মিলেমিশে চলি। মানুষই যদি তা না পারে, তা হলে আর কে পারবে! মানুষের ওপর আমার বিশ্বাসের শেষ নেই। রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন না, মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ!
এত উদ্বেগের মধ্যেও সবুজ আমায় খুব প্রশান্তি দেয়। যে ঢাকা শহরে পাখির ডাক শোনা দুর্লভ ছিল। সেখানে ছাদ কিংবা বারান্দায় যখনই যাই, পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনেছি। সেদিন দেখি, কোত্থেকে একটি মাছরাঙাও এসে হাজির। সত্যিই অভাবনীয় দৃশ্য। তবে সাধারণ ও স্বাভাবিক জীবনই চাই। এমন কোনো মৃত্যু চাই না, যেখানে দাফন ঠিকমতো করা সম্ভব নয়। এ দুঃসময় কাটুক।
লেখক
অভিনেত্রী
মন্তব্য করুন