একান্ত মেধাহীন হয়েও মুখ থেকে মায়ের দুধের গন্ধ শুকোবার আগেই যে আমি চারপাশের সামাজিক-রাজনৈতিক আলোড়ন-আন্দোলন ও ঘটনা-দুর্ঘটনা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিলাম, তার মূলে ছিল আমার বাবা ও ঠাকুরদার অতি আগ্রহ। তাঁরা যেসব আড্ডায় ও বৈঠকে সমাজ ও রাজনীতির অনেক বড়ো বড়ো বিষয় মন্থন করতেন, চলতি কথায় রাজা-উজির মারতেন, সেসব স্থানে আমার যে শুধু প্রবেশাধিকার মঞ্জুর করেছিলেন তাই নয়, আমার অংশগ্রহণকেও তারা উৎসাহিত করতেন। আমার ছোটো মুখে বুড়ো কথা শুনে আড্ডাধারীদের কেউ কেউ অবশ্যই বিরক্ত হতেন, তবে অধিকাংশ এতটুকু যন্ত্র হতে এত শব্দ বের হতে দেখে বিস্ময়ে আপ্লুত হয়ে পড়তেন, তাদের চোখ একেবারে ছানাবড়া হয়ে যেত। আর এতে আমার বাবা ও ঠাকুরদার ছাতি যে অস্বাভাবিক রকম ফুলে উঠত, সেখানে উপস্থিত যে-কেউ তা বুঝতে পারতেন। আমাকে দ্রুত ইঁচড়ে পাকিয়ে ফেলার ব্যবস্থা এঁরাই সবাই মিলে করে ফেলেছিলেন।
ঠাকুরদা রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্নান করে গীতা পাঠ করতে বসতেন। আমাকেও পাশে নিয়ে বসাতেন। গীতা যে মহাভারতের একটি অধ্যায়, সেই মহাভারতের গল্প বড়ো সরস ভঙ্গিতে আমার কাছে বলে যেতেন, শুনতে শুনতে আমার তন্ময়তা এসে যেত। আসন্ন যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণাম আঁচ করতে পেরে পুণ্যক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের চিত্তে যে-বিষাদ উপজাত হয়েছিল, সে-বিষাদ দূর করার জন্য শ্রীকৃষ্ণ যে উপদেশ প্রদান করেছিলেন, সেই উপদেশের নামই যে শ্রীমদ্ভগবদ গীতা, সে-কথা আমি সাত বছর বয়সেই জেনে গিয়েছিলাম। শুধু তাই নয়, ওই বয়সেই আমাকে কুক্ষেত্রের যুদ্ধের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন আমার ঠাকুরদা। সে-সময়ে এসব কথা খুব একটা বুঝি বা না বুঝি, ঠাকুরদার কথাগুলোর কিছু ছাপ আমার মস্তিস্ককোষে পড়ে গিয়েছিল নিশ্চয়। গীতার 'চর্তুবর্ণ' বা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র সম্পর্কে ঠাকুরদার র‌্যাডিকেল ব্যাখ্যাও তখনই আমার চিত্তকে স্পর্শ করেছিল। তিনি বলতেন- জন্ম থেকেই কেউ ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য বা শূদ্র হয় না, গুণ ও কর্ম দিয়েই মানুষের বর্ণ বা জাতি নির্ধারিত হয়। প্রচলিত হিন্দু বিধান অনুযায়ী আমরা জাতে কায়স্থ, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ। কিন্তু ঠাকুরদা যখনই এই জন্মগত জাতকে অস্বীকার করে নানা শাস্ত্র থেকে চোখা চোখা সংস্কৃত শ্নোক আউড়িয়ে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিতেন এবং ওই ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতরা অতি সহজেই রণে ভঙ্গ দিত, তখন আমার আনন্দের সীমা-পরিসীমা থাকত না। হিন্দু সমাজের নানা জাতপাত ও হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ-বৈষম্য সম্পর্কে সে-সময় থেকেই আমার মনে নানা প্রশ্ন দানা বেঁধে উঠতে থাকে। প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর অবশ্যই পাইনি, কিন্তু তখন থেকেই প্রশ্নগুলোকে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে আমার খুব ভালো লাগে।

বিষয় : শৈশবের নানা প্রশ্ন আর তার উত্তর

মন্তব্য করুন