১. করোনা মহামারির আঘাতে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কী অবস্থায় আছে বলে আপনি মনে করেন।
করোনা মহামারি নষ্ট করছে মানুষের জীবন ও জীবিকা উভয়ই। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের চলমান অর্থনৈতিক যন্ত্রের চাকা। প্রতিটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রতি মুহূর্তে দুর্বার গতিতে যে লেনদেনের জন্ম দিচ্ছিল প্রতিটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তা করোনার কারণে বাধাগ্রস্ত এবং বন্ধ। কবে চালু হবে তা জানে না এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মানুষরা। বলা হয়, স্বাভাবিক অবস্থায় একটি দেশের চলমান অর্থনৈতিক যন্ত্র প্রতি মুহূর্তে বিলিয়নস এবং বিলিয়নস অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্ম দেয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে। প্রতিটি লেনদেন ক্ষুদ্র আর বৃহৎভেদে মূল্য সংযোজন করে। এই প্রক্রিয়ায় দেশের সর্বক্ষেত্রে প্রতিটি উপকরণে দেশজ উৎপাদন ও সেবাশিল্পের সামগ্রিক লেনদেনের যোগফল দেশের জিডিপিতে যোগ হয়। সুনির্দিষ্টভাবে প্রতীয়মান যে, ২০১৯-এর শেষ দিকে চীনে জন্ম নেওয়া করোনা-১৯ প্রভাব সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং দ্রুত বিস্তার করে। বাংলাদেশও এ মহামারির আওতায় পড়ে মার্চ ২০২০ শেষের দিকে। হতভম্ব হয়ে পড়ে বিশ্বনেতৃবৃন্দ, চিকিৎসাশাস্ত্রের পণ্ডিত ও গবেষকগণ। চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা। এ ব্যবস্থাপনার পদ্ধতিগত কৌশল নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন সারা বিশ্বের অর্থনীতিবিদ ও অর্থ ব্যবস্থাপনা বিশারদরা। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের প্রেসক্রিপশন, সমাজবিজ্ঞানীদের মতামত, ফিন্যান্সিয়াল অর্থনীতিবিদ, ম্যাক্রো ইকোনমিস্ট, মাইক্রো ইকোনমিস্ট, পলিটিক্যাল সায়েন্টিস্ট, প্রশাসনবিদ, সিকিউরিটি এক্সপার্ট, ক্রাইম স্পেশালিস্ট, এডুকেশনালিস্ট, ইনোভেটরস ইন মেডিকেল সায়েন্সসহ সকল শ্রেণিপেশার মানুষ আজ চিন্তিত। বাংলাদেশও আজ এ চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন, সম্পূর্ণ লকডাউন না আংশিক, অর্থনৈতিক যন্ত্র পূর্ণ না আংশিক লকডাউন- এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে প্রতি মুহূর্তে কৌশল নির্ধারণে সতর্ক। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (১৫ মে, ২০২০) বলেছে, কভিড-১৯-এর ক্ষতির পরিমাণ বৈশ্বিক জিডিপিতে (৯.৭%) ৮ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বলেছে ৫০ শতাংশ শ্রমজীবী কাজ হারানোর ঝুঁকিতে। প্রতি ৫ জনের ২ জন চিরস্থায়ী বেকারত্বে যাওয়ার শঙ্কা আছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল কভিড-১৯কে নাম দিয়েছে 'মহা লকডাউন মন্দা'। বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন বিশেষ কিছু নির্দেশনা, তার মধ্যে 'করমর্দন থেকে বিরত থাকা, কোলাকুলি নিষেধ'। মানব ইতিহাসে এই প্রথম এ ধরনের অসামাজিক আচরণে বাধ্য করল কভিড-১৯ রাজমুকুট ভাইরাস।

২. করোনাভাইরাসে লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত উৎপাদনশীল অর্থনীতির কোন খাতগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে?
লকডাউনের আগে (ফেব্রুয়ারি ২০২০) কৃষিশিল্প ও সেবা খাতে মোট কাজে ছিল ৬ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার মানুষ। লকডাউনে ৬৬ দিনে কাজ হারিয়েছেন ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন। অর্থাৎ কর্মনিয়োজনের নিরিখে অর্থনীতি এখন ৪১ শতাংশের অর্থনীতি। মোট কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন। সবচাইতে বেশি কাজ হারিয়েছেন সেবা খাতের মানুষ ১ কোটি ৫২ লাখ ৯১ হাজার ৪৬০ জন (৪২.৫%), কৃষি ১ কোটি ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৭৯০ জন (৩১.৭%), শিল্প ৯২ লাখ ৮৩ হাজার ২১ জন (২৫.৮%)। লকডাউনের পরের ৬৬ দিনে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত মিলে মোট ক্ষতিগ্রস্ত কর্ম সময়ের পরিমাণ ১ হাজার ৮৯৯ কোটি কর্মঘণ্টা অথবা ২৩৭ দশমিক ৪ কোটি কর্মদিবস, যা মোট ক্ষতিগ্রস্ত কর্মসময়ের ৪২.৫ শতাংশ হয়েছে সেবা খাতে, ৩১.৭ শতাংশ কৃষি খাতে এবং ২৫.৮ শতাংশ হয়েছে শিল্প খাতে। তুলনামূলক বিচারে ৩টি বৃহৎ খাতের মধ্যে শিল্প খাতের কর্মীরা কাজ হারিয়েছেন ৭৪.৮ শতাংশ, সেবা খাতে ৬৪.১৬ শতাংশ, কৃষি খাতে ৪৬.১৬ শতাংশ। লকডাউনে ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন কাজ হারানো লোকের উপখাতওয়ারী বিভাজন হলো- কারখানা উৎপাদন থেকে ছিটকে পড়া ৬৩ লাখ (১৭.৫%), খুচরা পাইকারি ব্যবসা ৪৩ লাখ ১৮ হাজার (১২%), পরিবহন ও মজুদ উপখাত ৩৭ লাখ ২২ জন (১০.৪%), নির্মাণ উপখাত ৩ লাখ ৬৫ হাজার (৮.৫%), শিক্ষা খাত থেকে ছিটকে গেছেন ১৯ লাখ ৭০ হাজার মানুষ (৫.৫%), অন্যান্য সেবা থেকে কাজ হারিয়েছেন ১৭ লাখ ৩ হাজার মানুষ (৪.৭%), হকার, ফেরিওয়ালা, টি-স্টল ইত্যাদি থেকে ছিটকে গেছে ৮ লাখ ৫২ হাজার মানুষ (২.৪%)। কর্মক্ষেত্র থেকে ছিটকে পড়া/কর্মহীন হয়ে পড়া এসব মানুষের অধিকাংশই এখন দরিদ্র শ্রেণিভুক্ত। এই কর্মচ্যুত মানুষের ৯০ শতাংশের কোনো কাজ নেই তাদের মধ্যে নির্মাণ, বাসস্থান ও খাদ্যসেবা, রিয়েল এস্টেট কর্মকাণ্ড, শিক্ষা, পেশাগত বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি আর কমপক্ষে ৭০ শতাংশ অথবা কাছাকাছি কর্ম হারানো উপখাতের মধ্যে আছে কারখানায় উৎপাদন, পরিবহন ও মজুদ, তথ্য যোগাযোগ, কলা-বিনোদন-প্রমোদ, অন্যান্য সেবা কর্মকাণ্ড নিয়োগদাতা হিসেবে খানার কর্মকাণ্ড। লকডাউনে বিশাল জনগোষ্ঠী যে হারে কর্মচ্যুত হয়েছে তা থেকে এক ধরনের দুষ্টচক্র সৃষ্টি হতে পারে, যাতে স্বল্প আয়ের কারণে ব্যয় হবে স্বল্প, এর ফলে সঞ্চয় হবে না। হলেও তা হবে অতিস্বল্প, যার ফলে বিনিয়োগহীন পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। ফলে আবারও আয়স্বল্পতায় ভুগবে বেশিরভাগ মানুষ। এই চক্র চলতে থাকলে নিঃসন্দেহে আয়বৈষম্য, ঋণবৈষম্য, স্বাস্থ্যবৈষম্য ও শিক্ষাবৈষম্য সবই বাড়বে।

৩. আপনার দৃষ্টিতে এই সময়ে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সমাজের কোন শ্রেণির লোক, সেটা কেন?
কভিড-১৯ বিদ্যমান শ্রেণি কাঠামোর রূপান্তর ত্বরান্বিত করছে। লকডাউনের আগে লেনদেনভিত্তিক বাজার অর্থনীতিতে মানুষ দৌড়-ছুট করে বাড়ির বাইরে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে অভ্যস্ত, কিন্তু কভিড-১৯ সকলকে গৃহবন্দি করেছে। ফলে যেসব লোক দিন এনে দিন খেত দরিদ্র হলেও তাদের দিন যেত। লকডাউনে এসব মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর এবং নিঃস্ব হয়ে গেছে। যাদের অবস্থা 'দিন আনে দিন খাই'র একটু ওপরে তারা কর্মহীন হয়ে জীবন চালানোর জন্য খাদ্যভোগসহ অন্যান্য পারিবারিক ব্যয় কমিয়ে ফেলেছেন অথবা সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন অথবা উভয়ই। যাদের অবস্থা আরও একটু ওপরে তারা সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। ফলে নিম্নমুখী অর্থনৈতিক অবস্থার দিকে ধাবমান, মধ্যবিত্তরা নিম্নমধ্যবিত্তের দিকে ধাবমান। আবার মধ্য-মধ্যবিত্তদের একাংশ যাদের পরিবারে কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, যাদের খানায় কমপক্ষে একজন কোনো না কোনো অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত (হার্ট সমস্যা, কিডনি সমস্যা,ক্যান্সার ইত্যাদি) তারা নিশ্চয়ই নিম্ন-মধ্যবিত্তের তলানিতে অথবা দরিদ্র গ্রুপে যোগদানে বাধ্য হচ্ছেন। উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির যারা ধনী হতে পারেননি সম্ভবত তাদের বেশিরভাগ লকডাউন-পূর্ব অবস্থায় আছেন কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকার কারণে তাদেরও একাংশ সঞ্চয় ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন, ব্যয় বাড়াতে তারা মধ্যবিত্ত গ্রুপে যোগ দিয়েছেন। এটা বলা যায়, কভিড-১৯ ছয় মাসে মানুষকে গৃহবন্দি করে বাজারের স্বাভাবিক লেনদেন বন্ধ করে দেশের শ্রেণি কাঠামোকে পাল্টে দিয়েছে। বেড়েছে দারিদ্র্য, বেড়েছে বৈষম্য, ত্বরান্বিত হয়েছে মানুষের নিঃস্বায়ন- নিঃস্বকরণ ও সর্বস্বান্তকরণ প্রক্রিয়া। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা [(২০২০-২১) পৃষ্ঠা ৪১ সারণি-১)] কভিড-১৯ বাংলাদেশ শ্রেণি কাঠামোতে লকডাউনের প্রথম ৬৬ দিনে রূপান্তরের একটি চিত্র দেওয়া হয়েছে, তাতে দেখা যায়, দরিদ্র শ্রেণির ২০ শতাংশ খানার দেশের মোট আয়ের ৩.৮৫ শতাংশ লকডাউন পরবর্তী ৪০ শতাংশ খানাতে রূপান্তরিত হয়েছে, যা মূল ৩.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬.১২ শতাংশ হয়েছে। হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী ১০ শতাংশ খানায় মোট আয়ের ১.০২ শতাংশ বেড়ে ৪০ শতাংশ খানা মোট আয়ের ১০ শতাংশের স্থলে ২৫ শতাংশ এবং দেশের খানা ১.০২ শতাংশ বেড়ে ১.৫১ শতাংশে উন্নীত হয় করোনা-পরবর্তী ৬৬ দিনে। আশঙ্কা হলো করোনা প্রলম্বিত হলে এটা আরও বাড়বে। মধ্যবিত্ত খানা করোনা পূর্ববর্তী ৭০ শতাংশ কমে ৫০ শতাংশ করোনা-পূর্ববর্তী দেশের খানার মোট আয়ের ৫৮.০৭ শতাংশে নেমে ৪৭.৭৯ শতাংশে এসেছে ৬৬ দিনের লকডাউনে। নিম্ন-মধ্যবিত্তরা খানা ৩০ শতাংশ আয় থেকে নেমে এসেছে ২৩ শতাংশতে। মোট আয়ের করোনা-পূর্ববর্তী ১৫.৪২ শতাংশ কমে ১২.৬৯ শতাংশে নেমেছে। মধ্য-মধ্যবিত্ত খানা করোনা-পূর্ববর্তী ২০ শতাংশ থেকে ১৩ শতাংশে নেমেছে এবং খানার আয়ের অংশ ২৬.১১ শতাংশ থেকে নেমে ১৩.৬১ শতাংশ। উচ্চ-মধ্যবিত্তদের খানা ২০ শতাংশ থেকে কমেছে ১৩ শতাংশে, খানার আয়ের অংশ ২৬.১১ শতাংশ থেকে নেমে ২১.৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ধনি শ্রেণি খানার হার ১০ শতাংশ অপরিবর্তিত থেকেছে কিন্তু খানার মোট আয়ের অংশ করোনা-পূর্ববর্তী ৩৮.০৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৬.০৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। করোনা-পূর্ববর্তী বিনিয়োগ ০.৪৮২ থেকে বেড়ে পেয়ে ০.৬৩৫-এ উন্নীত হয়েছে। অপরদিকে পালসা অনুপাত ২.৯২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭.৫৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

৪. সার্বিক অর্থনীতিতে কভিড-১৯ উদ্ভূত ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়
সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান মানদণ্ড মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি। কভিড-১৯ মহাবিপর্যয় কাল শুরু হয় এ বছরের মার্চ মাস থেকে। সুতরাং ১২ মাসের ৯ মাসের হিসাব ধরে ২০১৮-২০১৯ এর চলতি বাজার মূল্যে জিডিপি ভিত্তি করে ২০১৯ সালের চলতি বাজারমূল্য বিবেচনায় ২৫,৩৬,১৭৭ কোটি টাকা। কভিড-১৯-এর সম্ভাব্য অভিঘাত ও প্রভাব যেভাবেই বর্ণনা করা হোক না কেন এর সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ হতে পারে- (বিকল্প বাজেট ২০২০-২১)
মোট জিডিপির ক্ষতির পরিমাণ বলা যায় ২৯৮৭৪২ কোটি টাকা প্রত্যাশিত ৪,৫৮,০২৬ কোটি টাকার (৬৫.২%)। অর্থাৎ লকডাউনের ৬৬ দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে। মোট জিডিপির সর্বোচ্চ পতন ঘটেছে সেবা খাতে (৫৬.৯%), তারপরে শিল্প খাত (৩৪.২%), তারপর কৃষি খাত(৯%)। মোট জিডিপির ক্ষতির (৬৮.২%) মাত্র ৬টি উপখাতে। ক্রমানুসারে ক্ষতির তালিকায় বৃহৎ ও মাঝারিশিল্প (১৬.৯২%) কর্মনীতি, সামাজিক ও ব্যক্তিগত সেবা (১১.০৩%), নির্মাণ (১০.৭০%), রিয়েল এস্টেট, ভাড়া ও অন্যান্য ব্যবসা (১০.১৭%), পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্য (৯.৭১%), পরিবহন সংরক্ষণ ও যোগাযোগ (৯.৭০%), যেখানে সর্বোচ্চ ক্ষতি স্থল পরিবহনে (৭.৩৮%)। যেসব উপখাতের কমপক্ষে ৯০ শতাংশ উৎপাদন ও সেবা উৎপন্ন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে অর্থাৎ কার্যত স্থবির হয়ে গেছে তাদের মধ্যে আছে নির্মাণ, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, আকাশপথ, ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাব্যবস্থা, ভাড়া ও সংশ্নিষ্ট ব্যবসা। সবচাইতে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত অনানুষ্ঠানিক খাত। হিসাব করলে দেখা যায়, মোট সক্রিয় শ্রমশক্তির ৮০-৮৫ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত মানুষ। যারা হলেন অণু-ব্যবসায়ী-ফেরিওয়ালা, হকার, ভ্যানচালক, ভ্যানে পণ্য বিক্রেতা, চা-পান, মুদি দোকানি, অণু-ক্ষুদ্র হোটেল-রেস্তোরাঁ, ক্ষুদ্র-মাঝারি পাইকার, নির্মাণ শিল্পের শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, রিকশা-ভ্যানচালক, কৃষি মজুর ইত্যাদি। তারা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের আনুষ্ঠানিক সংখ্যা সম্বন্ধে বলা প্রয়োজন। অর্থনীতি সমিতির (বিকল্প বাজেট ২০২০-২১) (দলিলে সারণি-৪ ও লেখচিত্র ০৯) হিসেবে বাংলাদেশে অণু-ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মুদিখানা, মনোহারি দোকান, মাঝারি পাইকারি ব্যবসা এবং অণু-ক্ষুদ্র হোটেল, রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীর সংখ্যা আনুমানিক ৮৬ লাখ ৫৩ হাজার ৮৯৪। তার মধ্যে গ্রামে ৩৪ লাখ ৮৮ হাজার ৯২০ জন (৪০.৩%) এবং শহরে ৫১ লাখ ৬৪ হাজার ৯৭৪ টি (৫৯.৭%)। ব্যবসার ধরন অনুযায়ী গ্রাম ও শহরের এসব ব্যবসা যেভাবে বিভক্ত তাদের আলোচনার স্বার্থে ৬ ভাগে বিভক্ত করা যায়। (ক) ভ্রাম্যমাণ অনু ব্যবসা (ফেরিওয়ালা, হকার, ভ্যানে পণ্য) বিক্রেতা :মোট ২৭ লাখ ৫৩ হাজার ৭৯৯, যার মধ্যে গ্রামে ৬ লাখ ১০ হাজার ৫৬১, আর শহরে ২১ লাখ ৪৩ হাজার ৯৫৮। তারা মোট অণু ব্যবসায়ীদের (৫৮.৩%) এবং মোট ৫ ধরনের ব্যবসায়ীদের (৩২%) (খ) স্থায়ী অণু ব্যবসা (চা-পান বিক্রেতা) :মোট আনুমানিক ১৯ লাখ ৪৫ হাজার ৬৮৫, যার মধ্যে গ্রামে ৯ লাখ ৫৯ হাজার ৮৫৩ আর শহরে ৯ লাখ ৮৬ হাজার ২৩২। তারা মোট অণু ব্যবসায়ীর ৪১.৪% এবং মোট ৫ ধরনের ব্যবসায়ীর ২২%। (গ) মোট অণু ব্যবসায়ী (ভ্রাম্যমাণ ও স্থায়ী):আনুমানিক ৪৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪০৪ জন। তার মধ্যে গ্রামে ১৫ লাখ ৭০ হাজার ১৪, মোট অণু ব্যবসায়ীর ৩৩.৪%। অপরদিকে শহরে ৩১ লাখ ২৯ হাজার ৩৯০ মোট অণু বসায়ীর ৬৬.৬%। অণু ব্যবসায়ীর মোট ৪ ধরনের ব্যবসায়ীর ৫৪.৩%। তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা নিজ উদ্যোগে কিছু না কিছু করেন অর্থাৎ আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন। তাদের প্রণোদনার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের দাবি ন্যায়সংগত। (ঘ) ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী (মুদিখানা, মনোহারি দোকান এবং অনুরূপ) : মোট ৩১ লাখ ১৫ হাজার ৫২ যার মধ্যে গ্রামে ১৩ লাখ ৯৫ হাজার (৪৪.৮%) এবং শহরে ১৭ লাখ ১৯ হাজার ৪৮৪ (৫৫.২%)। তারা দেশের ৫ ধরনের ব্যবসায়ের ২২%। (ঙ) মাঝারি পাইকারি :মোট ৩ লাখ ১৯ হাজার ৮৫২, তার মধ্যে গ্রামে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৪৪৬ (৫৪.৫%) এবং শহরে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৪০৬ (৪৫.৪%)। (চ) অণু-ক্ষুদ্র হোটেল-রেস্তোরাঁ :মোট ৫ লাখ ১৯ হাজার ৫৮৬, যার মধ্যে গ্রামে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৮৯২ (৬৭.১%), আর শহরে ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৯৪ (৩২%)। তারা দেশের মোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ০৬%।
উল্লেখিত সময়ের ক্ষতির পরিমাণ এর পরিমাপ স্বতন্ত্র, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক গবেষণা সংস্থা নিয়োগ করে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। কারণ, বর্তমানে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সংস্থা যাদের দিয়ে গবেষণাপত্র তৈরি করাতে অভ্যাস তারা কেউই এ সরকারের উন্নয়ন নীতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতির ও প্রগতির পক্ষে কোনো দিন ছিল না এবং ভবিষ্যতেও তারা থাকবে না। তারা সর্বকালের বিদেশি দালাল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের গত ১২ বছরের পরামর্শক কোম্পানি ও ব্যক্তিদের তালিকা ঘাটলে দেখা যায় তারাই সরকারের উপদেষ্টামূলক অর্থবিষয়ক গবেষণা পত্র, রিপোর্ট ইত্যাদি প্রস্তুত করেছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ঘাপটি মারা দেশি-বিদেশি দালালরা তাদের আসল পরিচয় ঢাকা দিয়ে সরকারকে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করছে। অথচ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একান্ত আন্তরিকতার পরও অনেক কিছু হচ্ছে না। কারণ, পরিকল্পনা তৈরির সহায়ক উপদেষ্টা পত্র প্রস্তুতকারী সরকারের বাইরের উপদেষ্টা পত্র প্রস্তুতকারীরা সরকারের অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক শত্রুদের সঙ্গে আঁতাতকারী। এমতাবস্থার মধ্যে করোনা মহামারি জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধিকে মহা হুমকিতে ফেলেছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে নিল্ফেম্ন বর্ণিত কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা জরুরি। সমস্যাকে বড় পর্দায় দেখতে হলে সমাধানের লক্ষ্যে কাজটি করতে হবে।

১. বাস্তবতার নিরিখে কভিডের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি নিরূপণে জাতীয় পর্যায়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন প্রয়োজন। এ কমিটিতে বিজ্ঞ প্রায়োগিক অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, চিকিৎসাবিদ, হিসাব বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে হতে পারে।
২. জাতীয় কমিটি গঠনের আগে এ কমিটির গঠন পদ্ধতিতে ঐকমত্য হয়ে টেনাস অব রেফারেন্স সময়সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে, রিপোর্টের সম্ভাব্য স্ট্রাকচার বর্ণনা করে সকল সদস্য একমত হবেন।
৩. কভিডের কারণে সেক্টরওয়াইজ ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করবে। কমিটি শুরু থেকে আগামী ডিসেম্বর, মার্চ এবং জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করবে।
৪. ১ জুলাই ২০২০ থেকে আগামী ৩ বছরে এ ক্ষতির সম্ভাব্য নির্ধারণ করবে।
৫. কভিড-পূর্ব সময় তুলনায় ও পরবর্তী সময়ে ক্ষতির নির্ধারণ করে সেই ক্ষতি পূরণের নিমিত্তে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পথনকশা দিতে হবে।

কভিডসৃষ্ট সংকট উত্তরণে ব্যবস্থাবলি :

১. ইতোমধ্যে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সরকার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে তার কার্যকর বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে। সরকার ব্যাংকের মাধ্যমে যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না, তাদের ঐতিহাসিক অদক্ষতা ও পশ্চাৎপদ কর্ম আচরণের কারণে। এ অবস্থার পরিবর্তন নিশ্চিত করতে হবে।
২. সরকারকে আরও এগিয়ে আসতে হবে স্বল্পমেয়াদি থেকে মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রণোদনা স্কিম তৈরিতে, যাতে অর্থনীতিযন্ত্র কোনোভাবে কোনো সেক্টরে, অফিসে, সংস্থায় বিচ্ছিন্ন না হয়ে স্বাভাবিক গতিতে চলবে, যেখানে লেনদেন বাধাগ্রস্ত না হয়। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে অর্থনৈতিক যন্ত্র চালু অবস্থায় একজনের ব্যয় আরেকজনের আয়। এভাবে দেশে বিলিয়নস ও বিলিয়নস টাকা লেনদেন হয়, তা প্রতিটি লেনদেন জিডিপিতে মূল্য সংযোজন করে। লেনদেন বন্ধ হলেই সংকট। কভিডের কারণে লেনদেন বন্ধ হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিযন্ত্রও গতি হারিয়েছে।
৩. লকডাউনের অর্থনীতি আনলক করা জরুরি :কভিডের আক্রমণে স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থার সঙ্গে অর্থনৈতিক মেশিনও সাময়িক, আংশিকভাবে লকডাউনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে ধীরে ধীরে আনলক শুরু হয়েছে। কিন্তু গতি অত্যন্ত ধীর। ফলে এটি বাংলাদেশের মতো উদীয়মান দেশের জন্য যথেষ্ট নয়। যেখানে বেসরকারি খাত, রপ্তানি খাত, আমদানি, শিল্পখাত ১-২ মাস পরেই কর্মে ফিরে এসেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারি (স্বাস্থ্য, নিরাপত্তাসহ কিছু সংস্থা বাদে) অফিসগুলো এখনও নিষ্প্রাণ, কর্মকাণ্ড নেই। অফিসের হাজিরা ২৫ শতাংশ (বিকল্প)। অথচ সরকারি অফিসগুলোই বেসরকারি খাতের বেশিরভাগ কাজের সহায়ক শক্তি। বেসরকারি-সরকারি কাজের এ অসমন্বয় দেশের অর্থনীতির মেশিন চলার পথে বিরাট বাধা। এ সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে কভিডের ৯ মাস। এ অবস্থার জরুরিভিত্তিতে উত্তরণ প্রয়োজন।
৪. জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ টিকে থাকতে হলে সর্বস্তরে আমাদের ধৈর্য সহিষ্ণুতার সর্বোচ্চ প্রমাণ দিতে হবে দেশের অর্থনৈতিক মেশিন চালু রাখার স্বার্থে। আমরা যে যেখানে আছি নিজ দায়িত্ব দেশাত্মবোধ থেকে পালন করার নিমিত্তে আমাদের সদা প্রস্তুত থাকতে হবে, দোষারোপ না করে কাজ করে যাই এ দীক্ষা আমাদের নিতে হবে।
৫. যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে দুর্যোগ হয়েছে, তার মোকাবিলাও হয়েছে। বাংলাদেশে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, কলেরা, ম্যালেরিয়া, বসন্তসহ অনেক বিপদ পেরিয়ে বাংলাদেশ আজ একটি পর্যায়ের দিকে অগ্রগামী। এই গতি ঠিক রাখতে হলে আমাদের অর্থনৈতিক যন্ত্রের চাকা ঠিক রাখতে হবে। মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হবে।
লেখক
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক
সাবেক সদস্য বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ
সাবেক চেয়ারম্যান জনতা ব্যাংক লিমিটেড।